নদিয়ায় দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের যুবক যুবতীর বিয়ে- সুযোগ বুঝে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে সাম্প্রদায়িক শক্তি
(এই প্রেস বিবৃতিটি আমাদের হাতে এসেছে। এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে আমরা এটি প্রকাশ করলাম।– পিপলস ম্যাগাজিন)
নদিয়ার হাঁসখালিতে দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের যুবক যুবতীর বিবাহ- সুযোগ বুঝে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে সাম্প্রদায়িক শক্তি
গত ২৯ আগস্ট ফেসবুক সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই ভিডিওটি থেকে আমরা জানতে পারি নদিয়া জেলার হাঁসখালি থানার মামজোয়ান গ্রামের জয়িতা হালদার পাশের গ্রাম ধানতলা থানার হাজরাপুর গ্রামের ফুরকান আলি মন্ডলকে ৩.২.২০২০ তারিখে বিয়ে করেন। জয়িতা ধর্ম পরিচয়ে বিবাহ পূর্বে হিন্দু ছিলেন এবং ইসলামি শরিয়তি আইনে বিয়ে করার দুদিন আগে তিনি ধর্ম পরিবর্তন করেন, তার বর্তমান নাম আয়েষা মন্ডল। ভিডিওটিতে দেখা যায় আয়েষা (জয়িতা) -কে হাঁসখালি থানার ওসি জিজ্ঞাসাবাদ করছেন ও তার প্রশ্নের উত্তরে আয়েষা জানাচ্ছেন তিনি প্রাপ্তবয়স্কা,বিএড করছেন, সম্পূর্ণ সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় ভারতীয় আইনে ন্যায়সঙ্গতভাবে ফুরকান আলি মন্ডলকে-বিয়ে করেছেন।থানায় তার বাবা ও ভাইয়ের উপস্থিতিতেই তিনি জানাচ্ছেন যে তিনি বাবার সঙ্গে যাবেন না বরং তিনি তার স্বামীর কাছে যেতে চান। এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয়, ভিডিওটিতে স্পষ্ট ওসি নিজে আয়েষা-র মত পরিবর্তন করার চেষ্টা করছেন বাবার সঙ্গে তাকে ফিরে যেতে বলছেন। এই বিয়ের ফলে দুই গ্রামে সাম্প্রদায়িক সমস্যা তৈরি হতে পারে তার এই ব্যক্তিগত ধারণা আয়েষা-র উপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন এবং এই ভিডিওটিতে কোথাও দেখা যাচ্ছে না যে- ভিডিওটি যে জনসমক্ষে আনা হবে তার অনুমতি থানায় উপস্থিত আয়েষা বা তার পরিবার ও প্রতিবেশীরা ওসি-কে দিচ্ছেন (informed consent)। তারপরেও ভিডিও-টি গণমাধ্যমে (ফেসবুকে) আনা হয়েছে এবং অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়,তারপর থেকে গত কয়েকদিনে এই ভিডিও-কে কেন্দ্র করে সমস্ত মুসলিম যুবকেরা হিন্দু মেয়েদের বিরুদ্ধে ‘লাভ জিহাদ’ চালাচ্ছে এবং ফুরকান-আয়েষার(জয়িতা) বিয়েও এরকমই একটি বিবাহ এই বলে নানা প্ররোচনামূলক বক্তব্য ছড়ানো হচ্ছে (যেমন Hindu Communist National Revolution নামের একটি সংগঠনের তরফে জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য নামে এক ব্যক্তি প্ররোচনা ছড়াচ্ছেন)।
বর্তমানে একটি ভাইরাল ভিডিওজয়িতা হালদার নামে একটি মেয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। জয়িতা হালদার কে নিয়ে পুরা ভারতবর্ষে তোলপাড় শুরু হয়েছে, জয়িতা হালদার একটি শিক্ষিত মেয়ে, নিজের ইচ্ছায় ইসলামকে যেন বোঝো কলেমা পড়েছে। নওমুসলিম ওর জন্য সবাই দোয়া করবেন সে যেন ইসলামের উপর থেকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে পারে এবং তার সাথে আল্লাহ তালা যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন।
Posted by অমুসলিম থেকে মুসলিম on Sunday, 30 August 2020
এইরকম উদ্বেগ জনক পরিস্থিতিতে গত ২.৯.২০ তারিখে এপিডিআর কৃষ্ণনগর শাখা ও আমরা এক সচেতন প্রয়াস-এর তরফ থেকে আমরা ধানতলা থানার হাজরাপুর গ্রামে ফুরকান আলি মন্ডলের বাড়িতে যাই। বাড়িতে ফুরকান ও আয়েষা-কে না পেলেও আমরা কয়েকজন প্রতিবেশীর উপস্থিতিতে ফুরকান আলির বাবা কিরণ আলি মন্ডল এবং ফুরকানের দাদির সঙ্গে কথা বলি। তারা আমাদের জানান বিয়ের পর থেকেই ফুরকান ও আয়েষা আলাদা থাকেন। এই বিয়েকে কেন্দ্র করে তারা নানা ভাবে ভীষণ সমস্যার মধ্যে আছেন। এমনকি গত কয়েকদিন আগে (২৪/৮ বা ২৫/৮,তারিখটি তারা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি) আয়েষা-র গ্রাম মামজোয়ান থেকে প্রায় ১০০/১৫০ জনের উন্মত্ত একটি দল মদ্যপ অবস্থায় তাদের বাড়িতে রাত ১১টার সময় হামলা করে। তারা ফুরকান ও আয়েষা-র খোঁজ চালায় এবং তাদের না পেয়ে বাড়িতে ভাঙচুর চালায় এবং কিরণ আলির অসুস্থ স্ত্রী ও মাকে অপহরণ করার হুমকি দেয়। কিরণ আলি বাড়িতে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। আবার পরের দিন রাত ৯টার সময় ধানতলা থানার পুলিশ ফুরকান আয়েষা-র খোঁজে কিরণ আলির বাড়িতে আসে এবংফুরকানকে না পেলে তাকে ছাড়বে না এই বলে তার স্ত্রী মিনিকা মণ্ডল-কে (কোনও মহিলা পুলিশ ছাড়াই) থানায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায়। থানায় সারারাত জেরা ও মানসিক অত্যাচারে মিনিকা মন্ডল আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরের দিন কিরণ আলি তার স্ত্রী-কে অনেক অনুরোধে বাড়িতে নিয়ে আসেন। কিরণ আলি জানান তাদের গ্রামে হিন্দু মুসলিম এই দুই সম্প্রদায় এতদিন যথেষ্ট সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে বসবাস করে এসেছে। এখনও সে সম্পর্ক অটুট আছে। বিপদের দিনে তার প্রতিবেশীরাও তার পাশেই আছেন। এর আগেও এই গ্রামে দুই-সম্প্রদায়ের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু কোনো সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। কিরণ আলি ও তার প্রতিবেশীদের মতামত পাশের গ্রাম মামজোয়ান-এর নির্দিষ্ট রাজনৈতিক শক্তির সক্রিয় মদতে এই উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্ক ফুরকান ও আয়েষা পরস্পরকে ভালবেসে নিজেদের সিদ্ধান্তে এই বিয়ে করেছেন,কিন্তু উপুর্যপরি ঘটনার চাপে কিরণ আলি ও তার পরিবার দৃশ্যতই আতঙ্কিত ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। উপস্থিত গ্রামবাসীরা জানান, গত ফেব্রুয়ারি মাসে ফুরকান-আয়েষা বিয়ে করার এতদিন পর সম্প্রতি মামজোয়ান গ্রামের একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের লোক আয়েষা( পূর্বের নাম জয়িতা হালদার)-র বাবাকে ফুরকানের পরিবারের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য ও এই বিয়ে অস্বীকার করার জন্য চাপ দেয় এমনকি নিগ্রহও করে। তাদের চাপে পরবর্তীতে আয়েষা-র বাবা বাসুদেব হালদার হাঁসখালি থানায় মেয়ে নিরুদ্দেশ জানিয়ে (Missing diary No-713,Dated-24.8.2020) অভিযোগ করেন। কিরণ আলি জানান এমতাবস্থায় ফুরকানের মামা ফুরকান ও আয়েষা-কে কৃষ্ণনগর কোতোয়ালি থানায় নিয়ে আসেন, সেখান থেকে ফুরকানকে ধানতলা থানায় ও আয়েষাকে হাঁসখালি থানায় নিয়ে আসা হয়। বর্তমানে তাদের ঠিকানা কেউই জানেন না।
এই ঘটনায় তথ্যানুসন্ধান দলটি নির্দিষ্টভাবে কিছু প্রশ্ন সামনে আনতে চায়: ১) প্রথমতঃ ফুরকান ও আয়েষা-র বিয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে হলেও প্রায় ৬মাস পরের কেন এই বিয়েকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করা হচ্ছে? ২)ধানতলা থানার পুলিশ রাত ৯টায় কোনও মহিলা পুলিশের সাহায্য ছাড়া ফুরকানের মা মিনিকা মণ্ডল-কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়।এটা সম্পূর্ণ বেআইনি।পুলিশ কী করে এই বেআইনি আটক করলো? অথচ আগের রাত্রে কিরণ আলির বাড়িতে যারা তাণ্ডব চালায় তারা এখনও বিনা বাধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনকি এই বিয়ের ঘটনাকে সূত্র করে মামজোয়ান গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে মসজিদে নামাজ পড়তে বাধা দেওয়া থেকে ধর্মীয় পরব উৎসবে অংশ নিতেও বাধা দিচ্ছে ওই বিশেষ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা লুম্পেন বাহিনী। ৩) সর্বোপরি, ফুরকান আলি মন্ডল ও আয়েষা মন্ডল দুজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক যুবতীর পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্মতিতে হওয়া আইনানুগ একটি বিবাহকে ঘিরে হাঁসখালি ও ধানতলা থানার পুলিশ,গ্রামের রাজনৈতিক মদতপুষ্ট দুর্বৃত্তরা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এমন উত্তেজনা তৈরি করছে কেন?- যা থেকে আমরা অদূর ভবিষ্যতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার ও ধর্মীয় আগ্রাসনের উন্মত্ত রূপ নেওয়ার আশঙ্কা করছি, যে বিদ্বেষ ও আগ্রাসনকে অবিলম্বে প্রতিহত করা উচিৎ।
APDR (কৃষ্ণনগর শাখা) ও আমরা এক সচেতন প্রয়াস
ছবি: প্রতীকী (সৌজন্য: দ্য কুইন্ট)