Home রাজনীতি আড়াল সরিয়ে ভারতের শাসক শ্রেণিকে চেনাচ্ছে প্রণবকে নিয়ে স্মৃতিচারণের ডালি

আড়াল সরিয়ে ভারতের শাসক শ্রেণিকে চেনাচ্ছে প্রণবকে নিয়ে স্মৃতিচারণের ডালি

আড়াল সরিয়ে ভারতের শাসক শ্রেণিকে চেনাচ্ছে প্রণবকে নিয়ে স্মৃতিচারণের ডালি
0

পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: বামেদের সঙ্গে গভীর সখ্য থেকে আরএসএসের সদর দফতরে গিয়ে বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে ‘ভারতের মহান সন্তান’ লিখে আসা, অর্ধশতকের অন্যতম কংগ্রেস ‘হাইকমান্ড’ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে যে ভারতের শাসক শ্রেণির সব মহল থেকে শোক ও স্মৃতিচারণের ঢল নামবে, সেটা আশ্চর্য কিছু নয়। সেই ঢলের মধ্যে দিয়ে প্রচুর জানা-না জানা কথা বেরিয়ে আসছে। রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের মহীরুহরা এমন অনেক কথা জানাচ্ছেন, যা তাদের কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক। সত্যি বলতে, স্বাধীন ভারতের ৭৩ বছরের অভিজ্ঞতায় জনগণের কাছেও সেগুলো স্বাভাবিকই হয়ে গিয়েছে। তবু ধারণা এক জিনিস আর কাঠখোট্টা তথ্য আরেক। মুখোশের আড়ালে যত্ন করে লুকিয়ে রাখা মুখের একটু দেখা পেলেও চমক লাগে বইকি! তেমন কিছু তথ্য গত তিনদিনে আমরা খুঁজে পেয়েছি মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে। সব সংবাদপত্র না হাতরিয়ে আমরা বেছে নিয়েছি সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকাকে।

প্রথমেই আসা যাক, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণে। ‘ভালবাসতেন, চোখের জলও ফেলিয়েছিলেন’ শীর্ষক তার স্মৃতিচারণ প্রকাশিত হয়েছে ১ সেপ্টেম্বরের আনন্দবাজারের প্রথম পাতায়। সেখানে তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, “…সেই সময় এক বার তাঁর বাড়িতে দেখি, দোতলার ড্রয়িংরুমে এক ভদ্রলোক এসেছেন। মুখটা চেনা লাগছে। কোথাও কোনও ছবিতে যেন দেখেছি। প্রণবদাকে আড়ালে ডেকে বললাম, ‘উনি কি ধীরুভাই অম্বানী? যদি তা-ই হন, তা হলে একটু বলুন না, আমাদের ওখানে ‘স্যাপ’ কারখানাটি যাতে খুলে দেন। অনেক লোক বিপন্ন।‘ প্রণবদা হেসে বলেছিলেন, ‘তুই তো সাঙ্ঘাতিক’!” বোঝাই যায়, শিল্পপতিদের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের সম্পর্ক দফতের সীমাবদ্ধ থাকার কথা হলেও সেটা থাকে না, মন্ত্রীদের বাড়ির ড্রইংরুম অবধি তা অনায়াসে পৌঁছে যেতে পারে। এমনকি জনহিতে তাদের কোনো কাজ ঠিক বলে মনে হলেও, সেক্ষেত্রে তাদের ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করতে হয়। অর্থাত সম্পর্কটা নিতান্তই দেওয়ানেওয়ার।

ওই লেখাতেই মুখ্যমন্ত্রী আরেক জায়গায় লিখেছেন, ‘…হৃদয়ের উষ্ণতাই বা ভুলি কী করে! তাঁর রাষ্ট্রপতি পদে শপথে আমি যাতে থাকি, তাই বিশেষ বিমান পাঠিয়েছিলেন যাতায়াতের’। নিজেদের শখ মেটাতে শীর্ষস্তরের রাজনীতিবিদরা কীভাবে অকাতরে জনগণের করের টাকা খরচ করতে পারেন, তার প্রমাণ এই তথ্য। একজন ব্যক্তির জন্য একটি বিমান!

এমন উদাহরণ আরও আছে। ২ সেপ্টেম্বর কংগ্রেস নেতা প্রদ্যোৎ গুহ ‘দলের সিদ্ধান্ত, আমার কপাল’ শীর্ষক স্মৃতিচারণে লিখেছেন, “…প্রণববাবু প্রথম লোকসভায় নির্বাচিত হলেন। বললেন, ‘গ্রাসরুট পেলাম। জঙ্গিপুরকে ভুলব না’। প্রণবদার সে দিনের টেনশন এবং আনন্দ ভুলতে পারব না। জয়ের শংসাপত্র আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘চ, দিল্লি যাই, সনিয়াজি প্লেন পাঠিয়েছেন’।’’ মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

স্বজনপোষণ এবং নিজের লোককে পাইয়ে দেওয়ার খোলামেলা ইতিহাসও উঠে এসেছে। ১ সেপ্টেম্বর তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়, ‘না জনভিত্তি, না পারিবারিক গরিমা, তবু রূপকথার চেয়ে কম ছিল না প্রণববাবুর যাত্রাপথ’ শীর্ষক লেখায় বলেছেন, ‘…আগেই বললাম যে, শুরু থেকেই আমি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্নেহের পাত্র ছিলাম। সেই স্নেহ কী ভাবে বর্ষিত হয়েছিল, আজ আর তা বলতে কোনও দ্বিধা নেই। ১৯৭৩ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রথম বার দেশের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পান। তখন উপমন্ত্রী পদ ছিল। এখন আর সে পদ নেই, উঠে গিয়েছে। কিন্তু মন্ত্রিসভায় প্রণববাবুর প্রবেশ ঘটেছিল ওই পদ দিয়েই। আর সে বছরই প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আশীর্বাদে আমারও পদপ্রাপ্তি। আমাকে তিনি একটা সরকারি কোম্পানির ডিরেক্টর পদে বসিয়ে দিয়েছিলেন’। অর্থাৎ দেশের কোটি কোটি বেকার যুবক যখন কাজের খোঁজে হন্যে হয়ে আছে। তখন শুধু শাসক দলের হয়ে ছাত্র রাজনীতি করার সুবাদে এই ধরনের সুযোগ পাওয়াটা নিতান্তই স্বাভাবিক। বাড়তির মধ্যে ঠি্কঠাক নেতার গুডবুকে থাকতে হয়।

টাকাপয়সা, ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা অনেক হল, দু-একটা রাজনীতির কথা বলে, এই নিবন্ধ শেষ করা যাক। লালকৃষ্ণ আডবাণী, উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডু প্রণবকে নিয়ে সশ্রদ্ধ স্মৃতিচারণ করেছেন। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গডকরি জানিয়েছেন, মন্ত্রী থাকার সময়, প্রণব বিভিন্ন শাসক দলের সঙ্গে বিরোধীদেরও সুযোগসুবিধার দিকে খেয়াল রাখতেন। পরবর্তীকালে তিনি যখন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, তখন গডকরি একবার অনুরোধ করাতেই সংঘপ্রধান মোহন ভগবতের সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। ‌আর ভগবত লিখেছেন, একবার অনুরোধেই দীর্ঘদিনের ‘কংগ্রেস ম্যান’ আরএসএসের সদর দফতরে যেতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন।

১ সেপ্টেম্বর প্রণবের স্মৃতিচারণে কলম ধরেছেন সিপিআইএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি্ও। তাঁর লেখার শিরোনাম, ‘লোকসভায় লড়া ঠিক হবে কি না জানতে চেয়েছিলেন’। ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি ও এনডিএ বিরোধী শক্তির মহাজোট তৈরি হয়েছিল দেশজুড়ে। খুব কাছাকাছি এসেছিল বাম ও কংগ্রেস। সে সময় অন্ধ্রপ্রদেশেও ভোট ছিল। সেখানেও তাদের মধ্যে আসন সমঝোতা হয়েছিল। সে সময়কার অভিজ্ঞতার কথা ইয়েচুরি লিখেছেন, ‘…এ রকমই একটা বৈঠকের সময়ে এক দিন হঠাৎ এক পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে ওঁর লোকসভা ভোটে লড়া ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে আমার মতামত চাইলেন। তার আগে উনি কখনও লোকসভায় সাংসদ হিসেবে জিতে আসেননি। মনে আছে, প্রথমটায় কিছু বলতে চাইনি। ওঁর মতো কাউকে এ বিষয়ে উপদেশ দেওয়াটা ঠিক হবে না বলে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। উনি কিন্তু জোর করলেন। বললাম, জেতার ব্যাপারে নিশ্চিত হলে তবেই লড়ুন। সে বারের ভোট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিজেপি-কে হারাতে আমরা সবাই মিলে কাজ করছিলাম। প্রণবদা হারলে ভুল বার্তা যেত’। বোঝাই যাচ্ছে জঙ্গিপুর থেকে জেতার জন্য নিজের দলের চেয়েও রাজ্যের শাসক দল ও মূল প্রতিপক্ষ সিপিএমের ওপরই ভরসা রাখতে চেয়েছিলেন প্রণব। এবং সিপিএমও তাকে ওয়াকওভার দিয়েছিল কেন্দ্রে ক্ষমতার চালিকাশক্তি হওয়ার স্বাদ উপভোগ করতে। অনেকেরই মনে থাকবে, সেবার জঙ্গিপুরে প্রণবের বিরুদ্ধে বামপ্রার্থী ছিলেন আরএসপি দলের। সিপিএমের অবস্থানের জন্য বামফ্রন্টের মধ্যে ব্যাপক দ্বন্দ্বও হয়েছিল।

ওই লেখারই অন্য একটি জায়গায় ইয়েচুরি লিখেছেন, ‘…এক বার, ২০০৮-এর বিশ্ব জুড়ে আর্থিক মন্দা থেকে ভারতকে আগলে রাখার সাফল্য দাবি করে প্রণবদা রাজ্যসভায় বললেন, ইন্দিরা গাঁধীর ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের জন্যই দেশের ব্যাঙ্ক ও আর্থিক ব্যবস্থা বেঁচে গেল। ঘটনাটা ২০০৮-এ পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করে বামেদের সমর্থন প্রত্যাহারের ঠিক পরে-পরে। আমি ওঁর বক্তৃতার মাঝখানে বাধা দিয়ে একটা কথা বলতে চাইলাম। উনি অম্লানবদনে সুযোগ দিলেন। সংসদে এই রকম শিষ্টাচার ও পারস্পরিক সম্মান এখন অতীত। বললাম, ভি ভি গিরিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সমর্থনের বিনিময়ে বামেরা ইন্দিরা গাঁধীর সামনে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের শর্ত রেখেছিল। তার সঙ্গে কয়লা ক্ষেত্রের জাতীয়করণের শর্তও ছিল। প্রণবদার ছিল হাতির মতো স্মৃতিশক্তি। ওঁর সেই আলোচনার খুঁটিনাটি মনে ছিল। আমিই বরং খুব সামান্য জানতাম। উনি বললেন, বামেরা আরও একটা দাবি জানিয়েছিলেন। তা হল, প্রিভি পার্সের অবসান। তত দিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল, ওই দাবি অন্য কারও ছিল’। পাঠকদের মনে করিয়ে দিই ভিভি গিরি ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন ১৯৬৯ সালে। অর্থাৎ ভারতের রাজনীতিতে সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসের সহযোগিতার সম্পর্কের ইতিহাস অর্ধশতাব্দী পার করেছে। আজকের বাংলায় বাম-কংগ্রেস জোটের প্রেক্ষিতে সেই ইতিহাসটাই ইয়েচুরি সুকৌশলে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন এই লেখায়। কিন্তু সে ইতিহাস শাসক শ্রেণির ইতিহাস। অথচ জনগণ রাজ্যের দীর্ঘ বাম শাসনে দেখেছে, সিপিএম তাদের সব প্রচারে কংগ্রেসের হাতে তাদের কর্মীদের অত্যাচারের ইতিহাস কলের পুতুলের মতো বলে গেছে। অন্যদিকে কংগ্রেস বাম আমলে তাদের কত কর্মী খুন হয়েছে, তার খতিয়ান দিয়ে গেছে। ক্ষমতার খেলায় নিচুতলার কর্মীদের বলি দেওয়ার এর চেয়ে বড়ো উদাহরণ আর কীই বা হতে পারে!

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *