পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: গত বছর চিনের উহানে যখন করোনা ভাইরাসের আবির্ভাব হল, ভারতবাসী ভাবতে পারেনি, এই ভাইরাস তাদের জীবনে এত বড়ো বিপর্যয় নামিয়ে আনবে। ভারতে অতিমারি থাবা বসানোর আগে থেকেই দেশের অর্থনীতিতে দুর্দশা চলছিল। বেকারত্ব চার দশকের মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ, অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকগুলি দীর্ঘমেয়াদি মন্দার ইঙ্গিত দিচ্ছিল, গত বছরের মাঝামাঝি থেকেই সংস্থাগুলো কর্মী ছাঁটাই করছিল। ভারত সরকার দেশে দুনিয়ার সবচেয়ে কড়া লকডাউন ঘোষণা করার পর এপ্রিল থেকে আর্থিক সমস্যাগুলি তীব্র গতিতে বড়ে গেল। ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বপ্ন বছরের শুরু থেকেই ধাক্কা খেতে শুরু করেছিল, অতিমারি তাকে একেবারে মাটিতে নামিয়ে আনল। গত কয়েক দশক ধরেই দেশের বিশাল সংখ্যক মধ্যবিত্ত শ্রেণি, ভারতের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। বিভিন্ন বাণিজ্য ও উৎপাদন ক্ষেত্রের বৃদ্ধির ফলে তা সম্ভব হয়েছে। এই শ্রেণিটা করোনা মহামারিতে বড়ো রকমের ধাক্কা খাওয়ার ফলেই সামগ্রিক ভাবে দেশের আর্থিক বৃদ্ধি ভূপতিত হয়েছে।
মধ্যবিত্তের উপার্জন ব্যাপক ধাক্কা খেয়েছে
চাহিদা, চাকরিবাকরির অবস্থা এবং পারিবারিক উপার্জন সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যই দেখাচ্ছে, অতিমারির ফলে তৈরি হওয়া তীব্র মন্দায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি কতটা ধাক্কা খেয়েছে। মুম্বইয়ের ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি’র মতে, অতিমারির ফলে ভারতের মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপার্জনই সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছে এবং পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হবে। অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল অংশের মানুষের উপার্জনেও বড়ো ধাক্কা লাগলেও, মধ্যবিত্তের উপর তলার অংশের ক্ষতি হয়েছে বেশি, কারণ তাদের হারানোর মতো জিনিসও বেশি। সংসংথার রিপোর্টে প্রকাশ, যে সব পরিবারের বার্ষিক উপার্জন ৫ লক্ষের বেশি, গত বছরের এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে তাদের ৫০ শতাংশের আয় বেড়েছিল। অন্যদিকে এ বছর একই সময়কালে তাদের মাত্র ১৫ শতাংশের উপার্জন বেড়েছে। যাদের উপার্জন যত বেশি, তারা ধাক্কা খেয়েছে তত বেশি। যাদের আয় বছরে ১৮ থেকে ২০ লক্ষের মধ্যে, তাদের অনেকেই উপার্জনহীন হয়ে পড়েছেন এই সময়। অথচ গত বছর একই সময়ে বার্ষিক ১০ লক্ষের বেশি উপার্জনকারীদের ৬০ শতাংশের আয় বেড়েছিল। গড়ে গত বছর এপ্রিল থেকে জুন মাসে ৩৩ শতাংশ পরিবারের আয় বেড়েছিল, এ বছর ওই সময়ে আয় বেড়েছে মাত্র ৬.৭ শতাংশ পরিবারের।
কর্মচ্যুতির সংকট তীব্র
শহর এবং আধা শহর এলাকায় বাস করা বেতনভূক মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে কর্মহীনতার সংকট সবচেয়ে বেশি। সাম্প্রতিক একটি তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ১.৮ কোটি চাকরি- মোট চাকরির ২২%- অর্থনৈতিক সংকটের জেরে চলে গেছে। তার ৫০ শতাংশই জুলাইতে।
কোভিড ১৯-এর জেরে হওয়া লকডাউনে সবচেয়ে ধাক্কা খেয়ে ‘মাইনে পাওয়া’ চাকরি। ২০১৯-২০ তে ভারতে বেতনভূক কর্মী ছিলেন ৮ কোটি ৬১ লক্ষ। এ বছরের এপ্রিলে সংখ্যাটা কমে দাঁড়ায় ৬ কোটি ৮৪ লক্ষ, জুলাইতে সেটা হয়েছে ৬ কোটি ৭২ লক্ষ। বোঝাই যায়, পুরো ধাক্কাটাই পড়েছে মধ্যবিত্তের ওপর। কারণ বেতননির্ভর চাকরিই তাদের পছন্দের জায়গা।
২০১৭-১৮ থেকেই ভারতে বেতননির্ভর চাকরির বাজারের বৃদ্ধি আটকে গেছে। বর্তমান সংকটে তা বিশাল ধাক্কা খেয়েছে। এর ফলে অসংগঠিত ক্ষেত্র এবং গ্রামাঞ্চলে কাজে নিযুক্ত মানুষের জীবনে গভীর সংকট নেমে এসেছে।
শহরাঞ্চলের পরিবারগুলির উপার্জন কমে যাওয়ায় নিত্য ধাক্কা লেগেছে বিভিন্ন পণ্যের চাহিদাতেও। এর ফলে বহু সংস্থাকে কর্মী ছাঁটাই করতে হয়েছে বা কারখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
এর ফলে নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি বড়ো রকমের ধাক্কা খেয়েছে। সিএমআইই-র তথ্যে জানা যাচ্ছে, পর্যটন এবং হোটেল শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু যে মানুষের চাকরি গেছে, তাই নয়, বেতনও কমানে হয়েছে।
ভারতের পিছিয়ে থাকা আধা পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে গরিব মানুষের উপার্জনের অনেকটাই নির্ভর করে মধ্যবিত্তের আর্থিক সচলতার উপর। অথচ সমাজের একেবারে পিছিয়ে থাকা অংশের জন্য কিছু আর্থিক সাহায্য ঘোষণা করলেও সরকারগুলো মধ্যবিত্তের জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। অথচ এই সময়েই মুনাফা বাড়িয়েছে বড়ো পুঁজিপতিরা। অম্বানির মতো ব্যবসায়ীরা একের পর এক বহুজাতিকদের সঙ্গে নানা চু্ক্তি করে নিজেদের সংস্থায় বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। এই সময়েই একের পর এক দেশের সম্পদ বিক্রি ও বেসরকারিকরণের পথে হেঁটেছে ভারত সরকার। আইন পালটে চাকরির নিরাপত্তা কমানো হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতায় কোনো অধিকার না থাকায় জীবন সংগ্রাম তীব্র হয়েছে আম জনতার। করোনা-সংকট ভারতের উচ্চাতাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বহু সত্য দর্শন করিয়ে দিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির অধীনে নিজেদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার স্বপ্ন দেখলে এই ধরনের সংকট তাদের জীবনে বারবার নেমে আসবে। দেশের স্বাধীন অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি না হলে, এই শ্রেণিটার পক্ষে সুস্থ জীবন পাওয়া অসম্ভব। সমস্যা শুধু শ্রমিক-কৃষকের নয়।