গরিব ও প্রান্তিক পড়ুয়াদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ কেড়ে চূড়ান্ত বেসরকারিকরণের বন্দোবস্ত নয়া শিক্ষানীতিতে
(Thecompanion.in পোর্টালে প্রকাশিত এই লেখাটি আমরা ভাবানুবাদ করলাম।)
জনগণের বিবেচনা ও মতামতের জন্য কিছুদিন প্রকাশ্যে রাখার পর নয়া শিক্ষানীতিতে অনুমোদন দিল কেন্দ্রীয় সরকার। এই নতুন শিক্ষানীতি সম্পর্কে যেটুকু তথ্য সরকার জানিয়েছে, তাতে স্পষ্ট যে,সরকারি উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার নীতিতে যে ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়েছে, তার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে যথেষ্ট চর্চা করা হয়নি। আপাত দৃষ্টিতে যে নীতি পরিবর্তনগুলি খুবই ইতিবাচক বলে মনে হচ্ছে, সেগুলি দীর্ঘমেয়াদে উচ্চশিক্ষায় অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিষয়টি আমি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি।
১. বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মতো একটি স্বশাসিত অর্থমঞ্জুর সংস্থাকে তুলে দিয়ে তার বদলে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা তৈরি করার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বশাসন ক্রমেই দুর্বল হবে।
নয়া শিক্ষানীতি অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের জায়গা নেবে উচ্চশিক্ষা কমিশন। তৈরি হবে উচ্চশিক্ষা মঞ্জুরি কাউন্সিল। ভারতের উচ্চশিক্ষা কমিশন তৈরির যে খসড়া আইন তৈরি হয়েছে, তাতে স্পষ্ট, এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি হস্তক্ষেপ বাড়বে এবং উচ্চশিক্ষায় অর্থ মঞ্জুর করার দায়িত্ব সরকার ধীরে ধীরে কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলবে। উচ্চশিক্ষায় অর্থ মঞ্জুরি কমিশন তৈরির মধ্য দিয়ে যে বৃত্ত আঁকা শুরু হয়েছিল, ভারতের উচ্চশিক্ষা কমিশন আইনের মধ্য দিয়ে তা সম্পূর্ণ হল। স্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে উচ্চশিক্ষায় অর্থ মঞ্জুর কাউন্সিল দ্বারা প্রতিষ্থাপনের কী কী বিপজ্জনক ফল হতে চলেছে, তা দেখা যাক-
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নাম থেকেই বোঝা যায়, এই সংস্থা শুধু উচ্চশিক্ষার বিধিনিয়ম তৈরি এবং তার পরিপোষণের জন্য তৈরি হয়নি, এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রয়োজন অনুযায়ী সরকারি তহবিল বরাদ্দ ও বণ্টন করা। কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো নির্দিষ্ট প্রয়োজনে অর্থের প্রয়োজন হলে সেটাও ইউজিসি দেখত। এখন সেটা সম্পূর্ণ ভাবে উচ্চশিক্ষা মঞ্জুরি কাউন্সিলের কাছে আউটসোর্স করে দেওয়া হল। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রয়োজনে জনগণের অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। উচ্চশিক্ষার জন্য অর্থদানকারী এজেন্সি(এইচইএফএ)-র মাধ্যমে সরকার যে টাকা দেবে, তা ঋণ, অনুদান নয়। অর্থাত সেটা শোধ করতে হবে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক চরিত্র ধ্বংস হবে এবং উচ্চশিক্ষা সার্বিক ভাবে ধনী, সুবিধাভোগী শ্রেণি ও বর্ণের সংরক্ষিত এলাকায় পরিণত হবে। আসলে এই নীতির মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নিজেদের খরচ নিজেদেরই তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এর ফলে ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ ধরনের কোর্স বাড়বে, বিপুল ফি বৃদ্ধি হবে, চুক্তিবদ্ধ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী পদ তৈরি হবে এবং শিল্পক্ষেত্রের প্রয়োজন মতো গবেষণার গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হবে। অর্থাত দীর্ঘমেয়াদে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও কর্পোরেট কায়দায় চলবে, তাতে খরচ কমানো হবে(চুক্তিবদ্ধ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ, শিক্ষক ওপড়ুয়াদের বিভিন্ন সুযোগসুবিধা কেড়ে নেওয়া) এবং আয় বৃদ্ধি করতে হবে(পয়সা খরচ করে পড়তে হবে এবং কোর্স তৈরি, ফি বৃদ্ধি, বিভিন্ন বাণিইজ্যিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি ইত্যাদি)।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আইন ১৯৫৬ অনুসারে, প্রকৃতপক্ষে এই সংস্থা ছিল একটি স্বশাসিত অর্থ বরাদ্দ সংস্থা। কিন্তু এই কমিশনের বদলে সরকারি নিয়ন্ত্রিত এইচইএফএ এবং এইচইজিআই তৈরি করার ফলে কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কাজে হস্তক্ষেপ করবে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি সরকারের নীতি বা অবস্থানের সঙ্গে একমত না হয়, তাহলে তার অর্থ বরাদ্দ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে, ফলে তারা সরকারি নীতি মানতে বাধ্য হবে।
২. বিধিনিয়মের কড়াকড়ি হালকা করার প্রকৃত অর্থ বিধিনিয়ম তুলে দেওয়া: উচ্চশিক্ষার দ্রুত ও ব্যাপক বেসরকারিকরণ করাই এর লক্ষ্য
ইউজিসি, এআইসিটিই-র মতো নির্দিষ্ট ধরনের শিক্ষার জন্য তৈরি নিদি৪ষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলি ভেঙে দিয়ে ন্যাশনাল হায়ার এডুকেশন অথোরিটির মতো একক নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন করা হয়েছে। যার লক্ষ্য ‘লাল ফিতের ফাঁস’ হালকা করা। এর মধ্য দিয়ে আসলে বেসরকারি সংস্থার শিক্ষা ক্ষেত্রে লগ্নির প্রক্রিয়াকে সরল করা হয়েছে। শিক্ষাদানের নামে মুনাফা করতে সাহায্য করার এ এক আশ্চর্য পদ্ধতি। শিক্ষাদানের নামে এই সব সংস্থাগুলো নানা অস্বচ্ছ কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত থাকে। হায়ার এডুকেশন কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার বিবৃতিতে বলা হয়েছে,তারা ‘সশরীরে উপস্থিত না হয়েও প্রযুক্তির মাধ্যমে সবকিছু দেখাশোনা করবে’। যার অর্থ হল, ইউজিসি এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা যেমন এতকাল কোনো প্রতিষ্ঠানে সরাসরি পরিদর্শন করে তার ভালোমন্দ যাচাই করত, সেই প্রক্রিয়া এবার তুলে দেওয়া হবে। একই ভাবে গত ২৯ জুলাই পিআইবি এ প্রসঙ্গে যে বিবৃতিটি দিয়েছে, তার সঙ্গে একটি পিডিএফ দলিল সংযুক্ত রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, “‘পরিদর্শনে’র দ্বারা অনুমোদনের বদলে অনলাইনে কোনো প্রতিষ্ঠানের নিজেদের দেওয়া তথ্যের স্বচ্ছ ব্যবস্থার ভিত্তিতে তাদের অনুমোদন দেওয়া হবে”।
বোঝাই যাচ্ছে, এক বিশাল ও নানা ধরনের প্রতিষ্ঠানে বিভক্ত শিক্ষা ব্যবস্থায় সব প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি চালানো একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষে অসম্ভব, তাই নজরদারি উঠে যাবে, যার ফলে ওই সব ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি নানা রকম স্বল্পমেয়াদের ‘মুনাফাভিত্তিক’ কার্যক্রম চালাবে, যার গুণমান বলেতে কিছুই থাকবে না আর পড়াশোনার সুযোগও পাবে খুব কম পড়ুয়া। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ‘স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান’ বানানোর মধ্য দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলিকে পড়ুয়াদের থেকে যত বেশি সম্ভব টাকা কামানোর অভূতপূর্ব স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। স্বশাসনের নামে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির যাবতীয় কুকীর্তি মেনে নেওয়া হবে। এটা মুরগির খাঁচা পাহাড়া দেওয়ার জন্য শিয়ালকে নিয়োগ করার মতো ব্যাপার। সব দিক থেকেই বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির লাভ।
২০১৮-১৯ সালে গোটা দেশ জুড়ে উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত যে সমীক্ষা হয়েছিল, তার রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৮ সালে ভারতে ৯৯৩টি বিশ্ববিদ্যালয়, ৩৯৯৩১টি কলেজ এবং ১০,৭২৫টি একক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। কলেজগুলির মধ্যে মাত্র ২২ শতাংশ ছিল সরকারি এবং বাকি ৭৮ শতাংশের ইতিমধ্যেই বেসরকারিকরণ হয়ে গিয়েছে। কলেজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান কারণ যতজন পড়ুয়া উচ্চশিক্ষায় যুক্ত হন, তাদের ৮০ শতাংশই স্নাতক স্তর অবধি পড়াশোনা করেন। অর্থাত বেশিরভাগ কলেজই গরিব এবং সামাজিক ভাবে প্রান্তিক অংশের পড়ুয়াদের হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। যারা ভারতের জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বেসরকারিকরণ কী গতিতে চলছে, তা বোঝা যাবে একটা তথ্য থেকে, গত ৮ বছরে যে ৩৫১টি বিশ্বিদ্যালয় তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে ১৯৯টি বেসরকারি।
৩. সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সমস্যা সম্পর্কে নীরব
ঐতিহাসিক ভাবে পিছিয়ে থাকা ও সামাজিক ভাবে প্রান্তিক অংশের মানুষের উচ্চশিক্ষা থেকে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা প্রসঙ্গে নয়া শিক্ষানীতি একেবারে নীরব। যা রীতিমতো কৌতূহলজনক। একটা বুড়িছোঁয়া বিবৃতি ছাড়া এতে সামাজিক ভাবে প্রান্তিক মানুষের উচ্চশিক্ষার সুযোগের অভাব প্রসঙ্গে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নেই। ২০১৮-১৯ সালে হওয়া উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত সর্বভারতীয় সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ১৮-২৩ বছর বয়সিদের মধ্যে যতজন উচ্চশিক্ষায় নথিভুক্ত হয়েছে, তার মধ্যে ২৬.৩% সামাজিক ভাবে এগিয়ে থাকা বর্ণের, তফসিলি জাতিভুক্ত ২৩%, তফসিলি উপজাতি ভুক্ত ১৭%, মুসলমান ৫.২%। উচ্চশিক্ষায় সার্বিক ছাত্রভুক্তির হিসেবে, সামাজিক ভাবে এগিয়ে থাকা বর্ণের পড়ুয়া ৪৩%, তফসিলি জাতিভুক্ত ১৪.৯%, তফসিলি উপজাতিভুক্ত ৫.৫% এবং অন্যান্য পিছিয়ে থাকা শ্রেণির অংশ ৩৬.৩%। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণের দিক থেকে দেখলে মুসলিম পড়ুয়া রয়েছে ৫.২%, অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু পড়ুয়া রয়েছে ২.৩%।
২০১৭-১৮ সালের ইউজিসির বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ৩০টি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্যে ৯৫% উচ্চবর্ণের, তফসিলি উপজাতি ১%, অন্যান্য পিছিয়ে থাকা অংশ ১% এবং তফসিলি জাতিভুক্ত ৩%। ওই একই ক্ষেত্রের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরদের মধ্যে ৯৩% উচ্চবর্ণের, ১.৮% তফসিলি উপজাতিভুক্ত, অন্যান্য পিছিয়ে থাকা অংশ ০.১% এবং তফসিলি জাতিভুক্ত ৫.২%। দেশের ৪৯৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের মধ্যে ৯১% উচ্চবর্ণের, তফসিলি উপজাতিভুক্ত ১%, তফসিলি জাতিভুক্ত ১% এবং অন্যান্য পিছিয়ে থাকা অংশের প্রতিনিধি ৭%। উচ্চশিক্ষায় সামাজিক ভাবে প্রান্তিক অংশের অংশগ্রহণের ৭এ৬এ এই বিপুল অসাম্য সম্পর্কে নয়া শিক্ষানীতি একেবারে নীরব।
৪. বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ওপর আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি বৃদ্ধি
বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন ও অন্যান্য বিষয়ে সরকার বা শাসক দলগুলির অযাচিত হস্তক্ষেপের সমস্যা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এমনিতেই জেরবার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বেশিরভাগ উঁচু পদগুলিতে রাজনৈতিক ভাবেই নিয়োগ হয়। সরকার বা শাসক দলের স্বার্থ যাতে সুরক্ষিত থাকে, সেটাই তারা দেখেন। এই বিষয়টি ভারতবর্ষের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সৃজনশীলতার স্বাধীনতা ও পঠনপাঠনের উৎকর্ষ অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। নয়া শিক্ষানীতি অনুযায়ী সরকার ‘ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিস’ তৈরি করবে এবং তার ক্যাডারদের সরকাই বাছাই করবে। এই আইইএস-বাবুরা দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পদে নিযুক্ত হবে, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন ঘটনাক্রম কেন্দ্রীয় সরকারকে রিপোর্ট করবে।
২০১৮ সালের খসড়া এইচইসিআই আইনেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে স্বশাসনের মডেল গ্রহণ করতে উৎসাহিত করা হয়েছিল। অর্থাত কপোর্রেট সংস্থার মতো মুনাফা বাড়ানোর কথাই তাদের বলা হয়েছিল। আর আইইএস বাবুদের হাতে বিপুল ক্ষমতাও দেওয়া হয়। তারা চাইলে সরকারি খরচে চলা ‘স্বশাসিত নয়’ এমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অনুমোদন কেড়ে নিতে পারে বা সেগুলিকে বন্ধ করে দিতে পারে। এর ফলে একই সঙ্গে এই আইন স্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার বেসরকারিকরণের লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে এবং স্বশাসিত নয় এমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে সরকারি নির্দেশ ও খেয়ালখুশি মানতে বাধ্য করে সেগুলিকে সরকারের মুখপাত্র বানিয়ে নিতে পারবে। শিক্ষণ প্রক্রিয়ার ফলাফল মাপা এবং কলেজ/ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নিয়মিত দেখাশোনা ও মূল্যায়নের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা আসলে অধ্যয়ন প্রক্রিয়ার ওপর নজরদারি এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া ‘অধ্যয়নের মান’ রক্ষার জন্য অন্ধ ইঁদুর দৌড়ে সামিল করার ধান্দা ছাড়া কিছু নয়। জেনে রাখা ভাল, উচ্চশিক্ষার যে কাউন্সিল এই মানের মাপকাঠি তৈরি করবেন, তার ১২ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র ২ জন শিক্ষাবিদ থাকবেন, বাকিরা হবেন আমলা। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হল, ‘অধ্যয়নের মান’ যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় রক্ষা করতে না পারে, তাহলে কাউন্সিল, সেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ অবধি করে দিতে পারে।
এই ধরনের ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পঠনপাঠনের স্বাধীনতার পক্ষে ক্ষতিকারক। এর ফলে এই প্রতিষ্ঠানগুলি সরকারের ‘খাঁচাবন্দি তোতাপাখি’তে পরিণত হবে।
৫. স্বশাসনের যে মডেলের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রকৃত স্বশাসনকে ক্ষুণ্ণ করবে।
নয়া শিক্ষানীতিতে স্বশাসনের যে মডেলের কথা বলা হয়েছে (মান অনুযায়ী স্বশাসন), তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রকৃত স্বশাসনের অন্তরায়। ইউজিসি-র বিধিতেও মান অনুযায়ী স্বশাসনের মডেল ছিল। ২০১৮ সালের ২২ মার্চ মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক এক ধাক্কায় ৬২টি প্রতিষ্ঠানকে স্বশাসন দেয়। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় সহ ৫টি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ২১টি রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়, ২৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১০টি কলেজকে স্বশাসন দেয়। বর্তমানে এই স্বশাসনের অর্থ হল, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তাদের ভর্তি প্রক্রিয়া, পাঠক্রম, পড়ুয়াদের ফি নির্ধারণ করতে পারবে। তাছাড়াও তারা-
ক) ২০% বিদেশি শিক্ষককে চুক্তি বা নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য নিয়োগ করতে পারবে (স্থায়ী চাকরি শেষ হওয়ার দিন শুরু এবং ২০% সংরক্ষণ বাতিল), পাশাপাশি মোট আসনের ২০% বিদেশি পড়ুয়া নিতে পারবে।
খ) ক্যাম্পাসের মধ্যে বা বাইরে সরকারের পয়সা না নিয়ে, পড়ুয়াদের অর্থে কোনো ভোকেশনাল/পেশাদারি দক্ষতা বৃদ্ধির পাঠক্রম চালু করতে পারবে। অর্থাত সময়ের সাথে সাথে স্বাভাবিক কোর্স ফি-ও বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে উচ্চশিক্ষার বেসরকারিকরণ হবে। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা অংশের পড়ুয়ারা পয়সার অভাবে এই সব কোর্সের সুযোগ কাজে লাগাতে পারবে না। এই অংশের পড়ুয়াদের যে বিপুল ভাবে উচ্চশিক্ষা থেকে বাদ দেওয়া হবে, তা ইতিহাসে কখনও দেখা যায়নি। পাশাপাশি পাঠক্রমগুলো এমন ভাবে সাজানো হবে, তা যেন শিল্প ও বাজারের কাজে লাগে, সমাজের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকার প্রয়োজন নেই। উচ্চশিক্ষার পাঠক্রম এবং উচ্চশিক্ষার পড়ুয়াদের চরিত্রে যে পরিবর্তন এর ফলে হবে, তা সামাজিক ভাবে পশ্চাদগামী এবং প্রতিক্রিয়াশীল।
গ) শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীদের বেতন হবে নানারকম। তা ঠিক করবে সেই কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতি। যেহেতু এই প্রতিষ্ঠানগুলি কর্পোরেট সংস্থার মতো খরচ কমানোর নীতিতে চলবে, তাই তারা স্থায়ী চাকরিগুলিকে চুক্তিবদ্ধ/ক্যাজুয়ালে পরিণত করবে। কাজের পরিবেশ যেমন খারাপ হবে, তেমনি বেতনও হবে সামান্য।
ঘ) শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, পড়ুয়ারা কোনো বিষয়ে কলেজ পরিচালন সমিতির সঙ্গে দরাদরি করতে পারবে না, কারণ সমস্ত ইউনিয়ন নিষিদ্ধ হবে। এর অর্থ হল, উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্র থেকে ছাত্র রাজনীতিকে উচ্ছেদ করা হবে (ছাত্রস্বার্থ নিয়ে লড়াই)। ২০০০ সালের বিড়লা-অম্বানি রিপোর্টের স্বপ্ন অবশেষে সত্যি হবে। ওই রিপোর্টে () উচ্চশিক্ষায় ছাত্র রাজনীতি এবং ছাত্র ইউনিয়ন বন্ধ করার প্রস্তাব ছিল(কারণ তা ভারতে উচ্চশিক্ষার বেসরকারিকরণের পথে বিশাল বাধা)।
ঙ) আমরা জানি, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে সামাজিক ভাবে প্রান্তিক সম্প্রদায়ের পড়ুয়াদের বিরুদ্ধে বর্ণগত পক্ষপাত রয়েছে। তাদের জন্য সংরক্ষিত আসন ভর্তি না করার ইতিহাসও আমাদের জানা। স্বশাসনের নামে ভর্তির প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণের নীতি না মানার সম্ভাবনা তাই ব্যাপক।
চ) বিদেশি পড়ুয়াদের জন্য বাড়তি ফি ধার্য করার যে নীতি নেওয়া হয়েছে, তা দেখিয়ে ভবিষ্যতে ভারতীয় ছাত্রদের ফি-ও বাড়ানো হবে।
ছ) বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পঠনপাঠনের গুণমান অত্যন্ত সন্দেহজনক। এগুলির ওপর নজরদারির ব্যবস্থা পূর্বতন ইউজিসি-রও ছিল না, এখন এইচইসিআই-এরও থাকছে না। এর ফলে এরা নিয়ম বহির্ভূত ভাবে যা খুশি তাই করে যাবে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, উচ্চশিক্ষায় নয়া উদারনীতির সামগ্রিক প্রয়োগ হয়েছে এই নয়া শিক্ষানীতিতে। ন্যূনতম নিয়মবিধির মধ্য দিয়ে বেসরকারি সংস্থাকে যত বেশি সম্ভব মুনাফা করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে অধ্যয়নের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে, সমাজের প্রান্তিক শ্রেণিকে উচ্চশিক্ষা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে পাশাপাশি জনস্বার্থ ও জনকল্যাণের জন্য যে কোনো কার্যক্রমের ওপর অগণতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞা ও বিধি চাপানো হয়েছে।