পশ্চিমবঙ্গে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে জিতে বিজেপি ক্ষমতায় আসুক বা নাই আসুক, সারা দেশের মতো এরাজ্যেও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের গতি রুদ্ধ হওয়ার এখনই কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এটা নতুন কথা নয়,কিন্তু নতুন করে চিন্তায় ফেলছে যে বিষয়টি তা হলো রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা। মালদার কালিয়াচক (২০১৬) থেকে বসিরহাট-বাদুড়িয়া (২০১৭), আসানসোল-রানিগঞ্জ (২০১৮) থেকে নৈহাটির হাজিনগর (২০১৮)। এবং সম্প্রতি হুগলি নদীর দু’পারে দুই জুটমিল নির্ভর জনপদ ভাটপাড়া (২০১৯) ও তেলেনিপাড়া (২০২০)। গত কয়েক বছরে এই অঞ্চলগুলোতে পরপর ছোটো মাত্রার দাঙ্গা হয়েছে।
সঙ্ঘ পরিবার গত কয়েকবছরের চেষ্টায় এরাজ্যেও ‘দাঙ্গা মডেল’ কে ‘জনপ্রিয়’ করে তুলতে পেরেছে। এমন নয় যে পশ্চিমবঙ্গে বাম আমলের ক’দশকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। সরকারি বামেদের দাবি মিথ্যে, বাম আমলেই হয়েছে। তবে বিচ্ছিন্ন ও কিছুটা স্বতঃস্ফূর্ত। নদিয়া, মালদা, মুর্শিদাবাদের কিছু সীমান্ত লাগোয়া, স্পর্শকাতর, বিশেষ জনবিন্যাসের অঞ্চলে গ্রামস্তরে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ আগে হয়েছে বা এখনও ঘটে। কিন্তু শুরুতেই বলা সাম্প্রতিক অতীতে ঘটা বসিরহাট বা ভাটপাড়া দাঙ্গার মতন ঘটনাগুলো দেখলে আলাদা করে কিছু ছক বা প্যাটার্ন চোখে পড়বে। এখানে স্পষ্টতঃই সহাবস্থানের শর্তকে অসহিষ্ণুতা দিয়ে ভেঙে ফেলা হচ্ছে। বিভাজনের স্বার্থে দুই সম্প্রদায়ের Difference বা ‘পার্থক্য’কে বড়ো করে দেখানো হচ্ছে। হিন্দু আরো ‘হিঁদুয়ানি’ বাড়াচ্ছে মুসলমান ঝুঁকছে ‘মোল্লা তন্ত্রে’র দিকে। দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করা হচ্ছে। এবং একটা ‘দাঙ্গা সংস্কৃতি’ তৈরি করা হচ্ছে। কর্মহীন বেরোজগার যুবকদের মধ্যে জনপ্রিয় হচ্ছে এই দাঙ্গা সংস্কৃতি। তাই আসানসোল রানিগঞ্জের বয়েসে প্রবীণ পুরোনো বাসিন্দাদের কাছে গেলে জানা যাবে, গত কয়েকবছরে রামনবমী-র মিছিলের এই সশস্ত্র অগ্রাসী চেহারা তারা অতীতে দেখেননি। বাদুড়িয়া-তেঁতুলিয়ায় কান পাতলে শোনা যাবে ইসলামি ‘জালসা’ র উগ্র ইন্ধন। বসিরহাটের ক্ষেত্রে যেমন নমঃশুদ্র,পৌন্ড্রক্ষত্রিয় হিন্দুদের মধ্যে সংগঠন বানিয়ে ক্ষেপিয়ে তুলছে আরএসএস, রানিগঞ্জ বা তেলিনিপাড়ার ক্ষেত্রে বিহার ঝাড়খণ্ড থেকে আসা দলিত হিন্দিভাষী হিন্দুদের দাঙ্গায় ব্যবহার করেছে তারা। ভাটপাড়া বা তেলিনিপাড়ার গোন্দোলপাড়া, দিনেমারডাঙার সন্ত্রস্ত গরিব মুসলমানরা শ্রমিক বস্তির পুড়ে যাওয়া ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন এত সংগঠিত, পরিকল্পিত লুঠ, ঘর বেছে বেছে আগুন লাগানো তারা আগে কখনও দেখেননি।
২০২১-এ রাজনৈতিক পালাবদলের আঁচ পেয়ে পুলিশ প্রশাসনের মধ্যেও যে বিভাজন শুরু হয়েছে তা বোঝা যায় দাঙ্গা কবলিত এলাকায় পুলিশ দমকলের দেরিতে পৌঁছনো বা নিষ্ক্রিয় থাকায়। দাঙ্গা লাগানোর আগে পরিকল্পিত ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে গুজব। বসিরহাটে যেমন এক স্কুল পড়ুয়া হিন্দু কিশোরের মোবাইল থেকে নবী মুহাম্মদ সম্পর্কে অশালীন ধর্মীয় বিদ্বেষ-মূলক কার্টুন ছড়িয়ে পড়া থেকে দাঙ্গার সূত্রপাত, সম্প্রতি তেলিনিপাড়ার ক্ষেত্রে তেমন ‘মুসলিমরা করোনা ভাইরাস ছড়াচ্ছে’ এমন গুজব রটানোর থেকে অশান্তি বাধে। এমনকি চন্দননগরের সাংসদ লকেট চ্যাটার্জি ফেসবুকে এই গুজব ছড়িয়ে পোস্ট করেছেন। ভাটপাড়ার সাংসদ অর্জুন সিং-এর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভাবে দাঙ্গায় মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সুচতুর ভাবে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়াকে দাঙ্গার আগে পরে ব্যবহার করেছে হিন্দুত্ববাদীদের ‘আইটি সেল’। ঘনিয়ে আসা বিপদের গুরুত্ব বুঝেও ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে রাষ্ট্রীয় অঙ্গুলী হেলনে চুপ করে আছে প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যম। সংখ্যাগুরু হিন্দু ‘ভোট ব্যাংক’ হারানোর ভয়ে রাজ্যে তৃণমূলও পাল্লা দিয়ে রামনবমী পালনে মেতে উঠেছে। বরাবরের নিয়মে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দুই সম্প্রদায়েরই গরিব মানুষ। এমনকি তেলিনিপাড়ার ক্ষেত্রে সংলগ্ন ভিক্টরিয়া, গোন্দোলপাড়া বা অ্যাঙ্গাস জুটমিলে কর্মরত হিন্দু মুসলিম শ্রমিকেরা এতো দিন জুটমিলের মালিক পক্ষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাম শ্রমিক ইউনিয়নের ছত্রছায়ায় জোট বেঁধে লড়াই করেছেন, কিন্তু আজ পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঙ্গায় মেতে উঠছেন। অত্যন্ত আশঙ্কার বিষয় হলো, ফ্যাসিবাদের বিকাশের অন্যতম শর্ত তা আক্রমণকারীকে নিজের অন্যায় অস্বীকার (denial) করতে শেখায়, নৈতিক ভাবে সমর্থন (legitimization) যোগায়। এক্ষেত্রেও দাঙ্গাকারী হিন্দু যুবকদের মধ্যে ‘যা করেছি বেশ করেছি’ মনোভাব তৈরি হয়েছে। এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে, প্রতিক্রিয়ায় তুলনামূলক ভাবে দুর্বল হলেও, মুসলিম যুবকদের মধ্যেও মৌলবাদী প্ররোচনায় পা দেওয়ার প্রবণতা টের পাওয়া যাচ্ছে। যেমন বাদুড়িয়া ‘জে এম বি’ তৎপরতার খবর পুলিশেরই গোয়েন্দা রিপোর্টে এসেছে। উল্লেখযোগ্য, দাঙ্গা কবলিত এলাকাগুলোতে বড়ো অংশ সংখ্যালঘু মানুষ উছেদ হওয়ার ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকছেন এবং তাদের নানা ভাবে সন্ত্রস্ত করে কুঁকড়ে রেখে ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে’ বা সস্তা শ্রমিকে পরিণত করার দেশজোড়া যে ‘মাস্টার প্ল্যান’ বা গেরুয়া ছক তা তারা টের পাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গে ছোটো ছোটো দাঙ্গার ঘটনা বেড়ে চলবে। ব্যবহৃত ‘pseudo-secular’ চোখ দিয়ে দেখে দেখে সুঁচ খুঁজে পেতে দেরি হয়েছে, তবে এখনই প্রতিরোধে রাস্তায় না নামলে ‘ফাল’ হয়ে বেরোনোর সময় বড্ড অসহায় লাগবে আমাদের।
ঋণ স্বীকার: “আমরা এক সচেতন প্রয়াস”