সম্প্রতি কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক ‘ইআইএ ২০২০’(পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন) নীতির একটি খসড়া প্রস্তাবনা পেশ করেছে। এই খসড়া প্রস্তাবনায় পোস্ট-ফ্যাক্টো পরিবেশগত ছাড়পত্র বৈধ করেছে। অর্থাত এর ফলে পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই গড়ে ওঠা প্রকল্পগুলি চালিয়ে যেতে বাধা নেই। এই খসড়া প্রস্তাবনাটি ‘কৌশলগত প্রকল্প’গুলিকে সংজ্ঞায়িত করেনি, ফলে কেন্দ্রীয় সরকার যে কোনো প্রকল্পকে ‘কৌশলগত’ বলে স্বীকৃতি দিতে পারে। সেই প্রকল্পগুলির পরিবেশগত প্রভাব, মূল্যায়ন করা হবে না।এই ধরনের ‘কৌশলগত’ প্রকল্পগুলি জনসাধারণের সামনেও আনা হবে না। এই খসড়া প্রস্তাবনাতে আরো একটি দিক হচ্ছে ইআইএ আওতাধীন প্রকল্পগুলিতে পরিবেশগত আইনলঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার ক্ষমতা শুধু সরকারি কর্তৃপক্ষ ও নির্মাণকারীর হাতেই রয়েছে। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ ও স্থানীয় মানুষের এই সুযোগ নেই, ফলে স্থানীয় ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষরা কোনোরকম আইনি পদক্ষেপ করা থেকে বঞ্চিত হবে।
প্রস্তাবিত নতুন ইআইএ ২০২০ অনুসারে নির্মাণপূর্বে নেওয়া পরিবেশগত ছাড়পত্র খনিপ্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে নির্মাণ ও স্থাপন পর্যায়ে ৫০ বছর অবধি বৈধ হতে পারে। অর্থাত এই বৈধতা ইআইএ ২০০৬-এ উল্লিখিত সময়কালের সাথে আরো ২০বছর বাড়ানো হল। এই খসড়া প্রস্তাবনায় কোন ক্ষতিকর প্রকল্প রূপায়ণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া এবং প্রকল্পটি বন্ধ করার পরিবর্তে যে কোনো বা সমস্ত আইনলঙ্ঘনকারী প্রকল্পকেই আইনি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
পরিবেশ মন্ত্রকের এই পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের নতুন নীতি আসলে কর্পোরেট দ্বারা প্রকৃতি ও মানবসাস্থ্যকে ধ্বংস করার সরকারি ছাড়পত্র মাত্র।
নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, যে তার সকারের আমলের পরিবেশ নীতির ফলে দেশে ৯০০০ বর্গ কিমি বনাঞ্চল যোগ হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে কর্পোরেটদের স্বার্থে বুলেট ট্রেনের জন্য ৫৩০০০ ম্যানগ্রোভ কাটা পড়েছে, উত্তরাখণ্ডে তীর্থযাত্রীদের জন্য হাইওয়ে বানাতে ২৫০০০ গাছ কাটা হয়েছে। মোদি সরকার জঙ্গলে বসবাসকারী আদিবাসী মুলবাসীদের জঙ্গলের অধিকারকে আইনত ভাবে কেড়ে নিয়ে সেখানে কর্পোরেট রাজ তৈরি করতে উঠেপড়ে লেগেছে।
গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কর্পোরেট পুঁজির কাছে ম্যানগ্রোভ অরণ্যকে তুলে দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। প্রচুর ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ধ্বংস হয়েছিল গুজরাটে।
আসল কথা হচ্ছে ভারতে আজ পর্যন্ত একটিও সরকার কখনোই প্রকৃতি পরিবেশ নিয়ে ভাবেনি, উল্টে পরিবেশের ক্ষতি করেই চলেছে একচেটিয়া মুনাফালোভী পুঁজিপতিদের হাত ধরে। যেমন ব্রিটিশ শাসনে নীল চাষ করিয়ে চাষের জমিকে, চাষের অযোগ্য করে তুলেছিল, সেরমই জিনিস আজ গ্রামাঞ্চলে দেখা যায়। যেমন ধরুন, যাতে দেশীয় গমের বীজ নষ্ট হয় যায় আর চাষিদের বিদেশি কোম্পানিগুলো থেকে বিষাক্ত বীজ কিনতে হয়, সেই ব্যবস্থা সুপরিকল্পিত ভাবে করে গম চাষ দু বছরের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটা শুধু একটি ঘটনা, অন্য দিকে রাস্তা চওড়া করার নামে যশোর রোডের হাজার হাজার ঐতিহ্যবাহী গাছ কাটা। এগুলো মামুলি ব্যাপার।
বাংলাতেও আমরা দেখেছি বামফ্রন্ট নেতৃত্বাধীন সরকার কিভাবে কৃষি জমি অধিগ্রহণ করে সেই জমি কর্পোরেট টাটার হাতে তুলে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। বিদেশি সালেম গোষ্ঠীর কেমিক্যাল হাব নির্মাণের নামে জঙ্গল কেটে সাফ করার চক্রান্ত করা হয়েছিল।
দেশে জমির উৎপাদনশীলতার উপাদান কেড়ে নিচ্ছে ভারত সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নির্দেশে। ক্ষতিকারক কৃষিপ্রক্রিয়ার ফলে ওপরের স্তরের ভূমিক্ষয় ও মরুভূমির সম্প্রসারণ, শিল্পজাত বর্জ্য মজুত এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অত্যাধিক ব্যবহারের দরুণ মাটি ও উপরিস্তরের জল দূষণ চলছেই। সরকার এই সব ক্ষতিকারক কীটনাশক ও সার রফতানি করার ছাড়পত্র দিচ্ছে কর্পোরেট কোম্পানিগুলোকে।
সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে বাংলাদেশের সরকার সেখানকার কর্পোরেট দের কারখানা তৈরির ছারপত্র দেওয়ার পরিকল্পনা করছে, যাতে পশ্চিমবাংলারও একই পরিমাণ ক্ষতি হবে । আমফানের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই ম্যানগ্রোভ অরণ্যের জন্য স্থানীয় মানুষদের জীবনজীবিকায় কিছু কম প্রভাব ফেলতে পারে, আর কর্পোরেটদের স্বার্থে সেই ম্যানগ্রাফ অরণ্যগুলোকেই কেটে সাফ করার পরিকল্প করে সরকারগুলো।
ভারতের বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে নাইট্রোজেন অক্সাইড। তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সব থেকে বেশি আদানি পাওয়ার রাজস্থান লিমিটেডের ইউনিট থেকে নির্ধারিত সীমার ওপর নাইট্রোজেন অক্সাইড দূষণ করছে। কর্পোরেট কোম্পানির স্বার্থে ভারত সরকার নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গমনের সীমা বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতেই বোঝা যায় যে বিজেপির সবকা সাথ সবকা বিকাশ আসলে কর্পোরেটদের বিকাশের কথাই বলছে।
বস্তুত, আধুনিক বিশ্ব অর্থনীতি পরিবেশের কাছে যে দাবি পেশ করছে, তা মেটানোর ক্ষমতা পরিবেশের নেই- এর থেকেই পরিবেশ সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যার সূত্রপাত।
যেহেতু আমরা পরিবেশের ক্ষমতা বাড়াতে পারবো না তাই যারা প্রকৃতির ওপর এই ভার চাপিয়ে দিচ্ছে তাদেরকে আটকানো ছাড়া আমাদের অন্য পথ নেই।
পরিবেশ প্রকৃতির ক্ষতি করে আদতে মানব সমাজকেই বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে পুঁজিবাদী সমাজ। প্রকৃতিকে বাঁচাতে ও মানব জীবনকে সুস্থ রাখতে তাই আজ আমাদের ‘জল-জঙ্গল-জমি বাঁচাও, উপকূলের লোক বাঁচাও’ এই আওয়াজ তুলতেই হবে।