Home খবর হাজিয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর: এরদোগানের পরিকল্পনা ও গ্রিসের বুর্জোয়াদের সুবিধাবাদ
0

হাজিয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর: এরদোগানের পরিকল্পনা ও গ্রিসের বুর্জোয়াদের সুবিধাবাদ

হাজিয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর: এরদোগানের পরিকল্পনা ও গ্রিসের বুর্জোয়াদের সুবিধাবাদ
0

পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: গত ১০ জুলাই বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ৫৩৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে তৈরি বাইজানটাইন গির্জা হাজিয়া সোফিয়াকে, জাদুঘর থেকে মসজিদে পরিণত করলেন। ১৪৫৩ সালে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের পতনের পর অটোমান তুর্কি শাসকরা একে মসজিদে পরিণত করেন। এই বাইজানটাইন স্মারকটিকে ১৯৩৪ সালে আধুনিক বুর্জোয়া তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতার্তুক পাশা জাদুঘরে পরিণত করেছিলেন। তা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ক রাষ্ট্রের প্রতীক। বর্তমান রূপান্তর, ‘সুলতান এরদোগান’ এবং তুর্কি বুর্জোয়াদের নয়া অটোমান সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনারই অংশ।

মসজিদের উদ্বোধন হতে চলেছে ২৪ জুলাই। এই তারিখটিরও একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। ১৯২৩ সালের এই তারিখেই লুসানের চুক্তি সাক্ষরিত হয়। যে চুক্তি অনুসারে আধুনিক তুরস্ক রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারিত হয়েছিল। যে সীমানা এরদোগান পালটে দিতে চান।

তুরস্কের বুর্জোয়ারা এই পদক্ষেপ এবং তাদের সামগ্রিক কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে এই বার্তাই দিচ্ছেন যে, তারা ওই অঞ্চল জুড়ে বৃহত্তর ভূমিকা পালন করতে চান এবং দক্ষিণপূর্ব ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে যে তেল ও গ্যাস তোলার কর্মসূচি চলছে, তার অংশীদার হতে চান। পাশাপাশি মধ্য প্রাচ্যে কুর্দদের সাহায্য করার চেষ্টা কেউ করলে, সেটা তারা মানবেন না।

তবে এরদোগান সরকার শুধুই প্রতীকী কার্যকলাপের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখছে না। সাম্প্রতিক কালে তারা মধ্য প্রাচ্য ও লিবিয়ায় সামরিক কার্যকলাপ তীব্র করেছে। লিবিয়ায় তারা যুদ্ধরত জেহাদিদের উন্নত সামরিক অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়েছে এবং সাময়িক ভাবে ত্রিপোলি সরকারের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। সেখানে উলটো দিকে রয়েছে জেনারেল হাফতার। তাকে সাহায্য করছে রাশিয়া, মিশর ও ফ্রান্স। পাশাপাশি তারা ফ্রান্সের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তীব্র করেছে। ফ্রান্সের একটি জাহাজকে আক্রমণও করেছে। ওই জাহাজটি লিবিয়ায় অস্ত্র নিয়ে যাওয়া তুরস্কের একটি জাহাজকে আটকানোর চেষ্টা করছিল। উত্তর ইরাকে কুর্দদের সায়ত্তশাসিত অঞ্চলেও কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির ওপরেও আক্রমণ হেনে তুরস্ক।      

 ‘কাগুজে বাঘ’

যদিও ‘সুলতান’ এরদোগানের সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্খা তার ‘কাগুজে বাঘ’-এর চরিত্রকে আড়াল করতে পারছে না। এলাকার বৃহৎ ক্ষমতাশালী শক্তিগুলির সঙ্গে লড়ার মতো শক্তি তুরস্কের অর্থনীতির নেই। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের স্মরণকালের সবচেয়ে বড়়ো মন্দায় বিশাল ধাক্কা খেয়েছে তুরস্কও। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার হিসেব অনুযায়ী ২০২০ সালে তুরস্করে জিডিপি ৫ শতাংশ কমবে, কর্মহীনতা হবে ১৭.২ শতাংশ জনগণের, মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে ১২ শতাংশ এবং তুর্কি পাউন্ড আবারও চূড়ান্ত পতনের জায়গায় পৌঁছে যাবে। যদিও জাদুঘরকে মসজিদ ঘোষণার পরদিনই তার সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ফোনে কথা হয়েছে।

সংকটের গভীরতা এবং তুরস্কের জনগণের দুর্গতি অবশ্যই সে দেশে শ্রেণি সংগ্রাম তীব্র করবে, পাশাপাশি ইতিমধ্যেই বিভাজিত তুরস্কের বুর্জোয়াদের মধ্যে দ্বন্দ্বও তীব্র করবে। আগ্রাসী বিদেশনীতির মাধ্যমে এরদোগান সরকারের যাই প্রত্যাশা থাক, এর আসল লক্ষ্য হল জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করে তুরস্কের মানুষের মন থেকে দেশের জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে সরিয়ে রাখা। তারই অংশ হল হাজিয়া সোফিয়াকে মসজিদে পরিবর্তন। গত কয়েক বছর ধরেই তুরস্কের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি এই দাবি করে আসছিল।  

এই পদক্ষেপের ফলে সাময়িক ভাবে দেশে এরদোগানের জনপ্রিয়তা হয়তো বাড়বে কিন্তু তা দিয়ে তুরস্কে ক্রমেই বাড়তে থাকা জনগণের অসন্তোষকে কমানো যাবে না। গত কয়েক বছর ধরে নির্বাচনে এরদোগানের পার্টি একেপি-র রাজনৈতিক প্রভাব কমছে। সম্প্রতি ইস্তানবুল ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলির পুরসভা নির্বাচনে একেপি হেরেছে।  

গ্রিসের শাসক শ্রেণির অবস্থান

এরদোগানের এই পদক্ষেপ প্রতিবেশী গ্রিসের বুর্জোয়া শাসকদের কাছে উপহারের মতো এসেছে। এই ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে তারা তাদের দেশে জাতীয়তাবাদে শুড়শুড়ি দিচ্ছে(বাইজানটাইন সভ্যতা ও বাইজানটাইন গির্জার সঙ্গে গ্রিকদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে)। এর আগে ম্যাসেডোনিয়া প্রশ্নে এবং নির্বাসিত অপরাধীদের এভরোসে ঢুকতে চাওয়ার সময়েও তারা এটা করেছে। তুরস্কের মতোই গ্রিক বুর্জোয়ারাও জাতীয়তাবাদকে কাজে লাগিয়ে দেশের মধ্যেকার সমস্যাগুলিকে জনগণের মন থেকে আড়াল করতে চাইছে।

এটা ঠিক যে, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কোনো ঐতিহাসিক স্মারককে জাদুঘর থেকে ধর্মীয় উপাসনার স্থানে পরিবর্তন করার অর্থ ইতিহাসের পশ্চাদগতি। এটা কোনোমতেই সমর্থন যোগ্য নয়। তুরস্ক ও গ্রিসের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি সঠিক ভাবেই এরদোগানের এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু গ্রিসের সংসদীয় বামপন্থী দলগুলি সেটুকুতেই তাদের অবস্থানকে সীমিত রেখেছে। এটা ভুল। পাশাপাশি তাদের নিজেদের শাসক বুর্জোয়াদের অবস্থানেরও সমালোচনা করা দরকার। যে বুর্জোয়ারা সম্প্রতি ভূমধ্যসাগর থেকে হাইড্রোকার্বন তোলার জন্য ইজরায়েল, মিশর ও সাইপ্রাসের সঙ্গে জোট করেছে। ওই অঞ্চলে তুরস্কের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করাই তাদের লক্ষ্য। এরদোগানের সিদ্ধান্তকে ব্যবহার করে দেশে জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে, সেটা তারা নিজেদের মুনাফার স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। তুরস্কের সর্বহারার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে গেলে গ্রিসের সর্বহারাকে অবশ্যই নিজেদের শাসক শ্রেণিরও বিরোধিতা করতে হবে। মনে রাখা দরকার, তুরস্কও থেমে নেই। তারা সম্প্রতি ভূমধ্যসাগরে ভূকম্পনের প্রবণতা পরীক্ষা করেছে। সব মিলিয়ে দক্ষিণপূর্ব ভূমধ্যসাগর থেকে হাইড্রোকার্বন তোলা নিয়ে যুদ্ধের পরিস্থিতি ঘনিয়ে উঠছে। দুই দেশের শক্তিশালী সর্বহারা আন্দোলনই এই যুদ্ধকে ঠেকাতে পারে।

গ্রিসের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সাম্প্রতিক বিবৃতিতে অবশ্য এই বক্তব্যই উঠে এসেছে। তারা বলেছেন সাম্রাজ্যবাদীদের নির্দেশে চালিত এই দুই দেশের বুর্জোয়াদের দ্বন্দ্বে কোনোভাবেই তুরস্ক, গ্রিস ও সাইপ্রাসের জনগণের জড়ানো উচিত নয়।    

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *