মোদি সরকারের কৃষি সংস্কারের সম্ভাবনা নিয়ে কর্পোরেট লবি ও তাদের পেটোয়া কলমচিদের উল্লাসের কারণ, তারা মনে করছেন এতদিনে কৃষি ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থে সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হল। অনেকে তাই আনন্দে ঊর্ধ্ব বাহু হয়ে এই সময়টাকে ভারতের কৃষির ৯০`এর মূহূর্তের পুনরাগমন বলে আখ্যায়িত করছেন।
আরও পড়ুন: সংস্কার কর্মসূচি: ভারতীয় কৃষির সর্বনাশের নীল নকশা, পর্ব -৩
এই ভাবনা কিন্তু সঠিক নয়। একথা সত্য যে খনিজ সম্পদ,রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প, টেলিকম, তথ্য প্রযুক্তি সহ অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রে নব্বই-এর দশকে সংস্কার কার্য যে গতিতে শুরু হয়েছিল কৃষি ক্ষেত্রে তা হয়নি। কিন্তু সরকার নানান ভাবে আন্তর্জাতিক লগ্নি সংস্থা গুলির ব্যবস্থাপত্র মোতাবেক কৃষিতে সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে এসেছে। আলোচনার সুবিধার্থে তার এক অতি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা এখানে উপস্থিত করা হচ্ছে ——
# ১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাসে ভারত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ( WTO) সদস্য হয় ও এগ্রিমেন্ট অন এগ্রিকালচারে সই করে।
# ১৯৯৬ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্ক ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থার ইতিকর্তব্য সম্পর্কিত এক নির্দেশনামা জারি করে যাতে বলা হয়– প্রথমত বেশি মুনাফাদায়ক নয় এমন ফসলের চাষ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রফতানি নির্ভর শস্যের উৎপাদন বাড়ানো জরুরি এবং একই সঙ্গে দরকার খাদ্য শস্যের অধিক মাত্রায় আমদানি। দ্বিতীয়ত, এখনই রাসায়নিক সার,জল,বীজ ও কৃষি ঋণের ক্ষেত্রে সরকারি ভরতুকি হ্রাস করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে এই ভরতুকি সম্পূর্ণ তুলে দিতে হবে। তৃতীয়ত, কৃষি পণ্য আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রে কোন বিধি নিষেধ রাখা চলবে না।
# বিশ্ব ব্যাঙ্কের নির্দেশিকা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ২০০০ সালে প্রথম বার ` ন্যাশানাল এগ্রিকালচার পলিসি ` ঘোষিত হয়। এখানে পরিষ্কার ভাবে বলা হয় ` কৃষি প্রযুক্তি হস্তান্তর, পুঁজির সঞ্চালন এবং কৃষি পণ্যের নিশ্চিত বাজারজাতকরণের লক্ষে চুক্তি চাষ ও লিজ হোল্ডিং ব্যবস্থা চালু হবে।….. চাষ ও কৃষি বাণিজ্যর পথ সুগম করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইন সংস্কার করা হবে। `
# এই নয়া কৃষি নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভারতবর্ষের পেটেন্ট আইন সংস্কার করা হয়। এসময় ভারতে প্রবেশ করে বিশালাকৃতির বহুজাতিক বীজ বিপণন সংস্থা গুলো – যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারগিল ( মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), সিড- টেক ইন্টারন্যাশানাল( মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), স্যান্ডোজ (সুইজারল্যান্ড)।
# ২০০০ সালের জুলাই মাসে ভারত সরকারের পরিবেশ মন্ত্রক প্রথমবার জিন পরিবর্তিত বীজের ফিল্ড ট্রায়ালের অনুমতি দেয়।
# ২০০২ সালে সরকারের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি (যার নেতৃত্বে ছিলেন অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ সেন) ` long term grain policy ` ঘোষণা করে।
# ১৯৯৭ সালের জুন মাস থেকে সর্বজনীন গণবন্টন ব্যবস্থা তুলে দিয়ে নির্দিষ্ট গণবন্টন ব্যবস্থা ( targeted PDS) চালু হয়।
# ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয় ন্যাশনাল কমিশন অন ফার্মাস(NCF)। এখানে বলা হয় সরকারের লক্ষ্য ভারতের মাটিতে দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করা।
# ২০০৫ সালের ১৮ জুলাই তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং AKI চুক্তি সম্পাদন করেন। এই চুক্তির পুরো নাম-` indo- us knowledge initiative on agriculture, education, research services and commercial linkages`। এই চুক্তিকে বাস্তবে রূপদান করতে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়, যার মধ্যে রাখা হয় বিশ্বের এক নম্বর খুচরো ব্যবসার সংস্থা ওয়ালমার্ট, বিশ্বের বৃহত্তম খাদ্য দ্রব্য বিপণন সংস্থা আর্চার ড্যানিয়েল মিডল্যান্ড,জৈব প্রযুক্তি ও বীজ উৎপাদন সংস্থা মনস্যান্টো,ভারতীয় বণিক সংস্থা ফিকি ও সিআইআই-এর প্রতিনিধিদের। এই চুক্তির অন্যতম লক্ষ্য ছিল মেধাস্বত্ব আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে জিন পরিবর্তিত বীজের প্রচলনকে সুগম করা।
# ২০০৫ সালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর আমেরিকা সফরের সময় গঠিত হয় ইন্দো- মার্কিন ফোরাম। এই ফোরামের দুই মুখ্য আধিকারিক হলেন রতন টাটা(ভারত) এবং উইলিয়াম হ্যারিসন ( জে.পি মর্গান / মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)। এরা দাবি তোলে বিভিন্ন রাজ্যে প্রচলিত শস্য নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন (Agriculture Produce Market Committee Regulation) সংশোধনের, যাতে করে বহুজাতিক ক্রেতা ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের মালিকদের কোন অসুবিধা না হয়।
# এই পর্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল BRAI( Biotech Regulatory Authority Of India) বিল। ভারতে জিন পরিবর্তিত শস্য বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে মার্কিন করপোরেশনগুলোকে সাহায্য করার জন্য এই বিল তৈরি করা হয়।
সংক্ষেপে এই হল ভারতে বিশ্বায়নের দুই দশকে কৃষি ক্ষেত্রে সংস্কার কর্মসূচির ইতিবৃত্ত। বর্তমান তিনটি সংস্কার সেই কর্মসূচিরই ধারাবাহিকতা।
এই তিনটি সংস্কার ভারতের কৃষি ব্যবস্থায় কী ধরনের প্রভাব ফেলবে তাও বুঝে নেওয়া জরুরি —
প্রথমত এই সংস্কারের ফলে ১৪০ কোটি মানুষের দেশে কৃষি পণ্য বিপণনে বিদেশি কর্পোরেট পুঁজির প্রবেশের পথটি আরো প্রশস্ত হবে। বিভিন্ন জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানির মাধ্যমে এই বিকিকিনি সম্পন্ন হবে। আগামী দিনে হিমঘর ও রিটেল কর্পোরেট চেনগুলি কৃষি পণ্যের প্রধান ক্রেতা হিসাবে দেখা দেবে এবং এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ভবিষ্যতে বাড়বে।
দ্বিতীয়ত যে হারে কৃষি ক্ষেত্রে কর্পোরেট অনুপ্রবেশ ঘটবে সেই একই হারে কৃষি ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তার দায়-দায়িত্ব কমাতে শুরু করবে। ২০০৫-০৬ সালের আর্থিক সমীক্ষায় বলা হয়েছিল সরকার দ্বারা বহুল পরিমাণে কৃষি পণ্যের ক্রয় বেসরকারি সংস্থাগুলোর স্বার্থকে আঘাত করছে, ফলে তারা কৃষি বাণিজ্যে পুঁজি বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হচ্ছে না। সরকার এই সংস্কারের ফলে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করে ফসল কেনার প্রক্রিয়াটিকে ধীরে ধীরে কমিয়ে দেবে। উৎপাদন খরচের উপর ৫০ শতাংশ লাভ ধরে ফসলের দাম নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে সরকারের আর কোন দায় থাকবে না কারণ সরকার নয় এবার থেকে ফসলের দাম নির্ধারণ করবে বাজার।
তৃতীয়ত বহুজাতিক কৃষি পণ্য বিপণনে যুক্ত সংস্থাগুলির বহু দিনের লক্ষ্য আমাদের খাদ্য শস্যর স্বনির্ভরতাকে নষ্ট করে এদেশে বিদেশ থেকে খাদ্য পণ্য রফতানি করা। চুক্তি চাষের মাধ্যমে কৃষকদের অর্থকরী ফসল চাষে প্রলোভিত করা হবে। সেই ব্যয়সাপেক্ষ চাষ যেমন দীর্ঘমেয়াদি ভাবে কৃষকদের জন্য সর্বনাশ করবে তেমনি দেশের গরিব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা আরো কমবে।
চতুর্থত যাদেরকে সামনে রেখে এত আয়োজন সেই কৃষকরা কি ফসলের ন্যায্য দাম পাবে? এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা দেখে নেওয়া যেতে পারে। মুক্ত বাজার অর্থনীতি চালু হওয়ার আগে সেদেশের কৃষকরা ফসলের খুচরো মূল্যর ৪০ শতাংশ পেত। এখন তারা পায় খুচরো মূল্যর ১৫ শতাংশ মাত্র। আজ ইউরোপ ও মার্কিন দেশে কৃষিকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারগুলি হাজার হাজার কোটি টাকা ভরতুকি দেয়। বাজার নির্ভর কৃষি অর্থ নীতি ক্ষুদ্র ও মধ্য কৃষকদের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনবে। আর সাধারণ উপভোক্তারা কর্পোরেটদের সৌজন্যে আরো বেশি দাম দিতে বাধ্য হবেন। পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন না থাকার কারণে ফসল নিয়ে কালোবাজারি বাড়ার আশঙ্কাও থাকবে।
পঞ্চমত কেন্দ্রে বর্তমান শাসক জোট মতাদর্শগত ভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাবনার বিরুদ্ধে এবং কেন্দ্রীয়করণের পক্ষে। এই সংস্কার কর্মসূচি সেই মতাদর্শের পরিপূরক। কৃষি রাজ্য তালিকায় থাকলেও এই সংস্কারগুলি সাধিত হওয়ার পর নীতি নির্ধারণে রাজ্য সরকারগুলোর আর কোন ভূমিকা থাকবে না। আবার কর্পোরেট লবির চাহিদাও তাই কারণ সারা দেশে একটা কেন্দ্রীয় আইন থাকলে তাদের বাজার দখলে সুবিধা হবে।
যষ্টত এই সংস্কারগুলির শ্রেণি চরিত্র খুব স্পষ্ট। সরকার খোলাখুলি ভাবে কর্পোরেট বণিক সংস্থা, কৃষি ব্যবসায়ী ও বৃহৎ কৃষকের পক্ষে। এই সংস্কারের ফলে মধ্য, ক্ষুদ্র,প্রান্তিক কৃষক ও বিরাট সংখ্যক কৃষি মজুরের অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। সপ্তমত এ প্রশ্নটা ওঠা স্বাভাবিক যে এই সংস্কারগুলির ফলে ভারতের কৃষি ব্যবস্থার কি কোন চরিত্রগত পরিবর্তন ঘটবে? এখনো পর্যন্ত ভারতীয় কৃষি চরিত্রগত ভাবে আধা সামন্ততান্ত্রিক ও আধা ঔপনিবেশিক। বিগত তিরিশ বছরে সেখানে ফিনান্স পুঁজির প্রবেশ ঘটেছে। কিন্তু আমূল ভূমি সংস্কার ঘটিয়ে কৃষির বুর্জোয়া বিকাশ ঘটানোর ক্ষমতা ভারতীয় শাসকদের নেই। তাই উপরিকাঠামোয় পুঁজির চলাচল পরিমাণগত ভাবে বাড়লেও কৃষিক্ষেত্রে বুনিয়াদি উৎপাদন সম্পর্কের কোনো গুণগত পরিবর্তন তা ঘটাতে পারেনি।
খুব গুরুত্বপূর্ণ, প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ। ভাবনা যারা করতে চান সবার পড়া উচিৎ।