Home খবর স্বৈরতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্র- অতিমারিতেও মুনাফা বাড়াতে বেপরোয়া নয়া উদারবাদ

স্বৈরতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্র- অতিমারিতেও মুনাফা বাড়াতে বেপরোয়া নয়া উদারবাদ

স্বৈরতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্র- অতিমারিতেও মুনাফা বাড়াতে বেপরোয়া নয়া উদারবাদ
0

পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: হাঙ্গেরির অতি দক্ষিণপন্থী, জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরব্যানের বিশেষ ‘কোভিড ১৯’ ক্ষমতা গত ১৬ জুন হাঙ্গেরির সংসদের নির্দেশে শেষ হয়েছে। গত মার্চে যখন দুনিয়ার বেশির ভাগ দেশ লকডাউনের পথে হাঁটছিল, তখন অরব্যান ‘করোনাভাইরাস আইন’ জারি করে অনির্দিষ্ট কালের জন্য দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। এই আইনের বলে তিনি যত দিন খুশি সংসদকে এড়িয়ে অধ্যাদেশের মাধ্যমে দেশ শাসন করে যেতে পারতেন।  

আরও পড়ুন: কোভিডের আগেও ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অথৈ জলে ছিল, পরেও থাকবে, একটি বিশ্লেষণ

এখন সংসদকে দিয়ে ওই আইন তুলিয়ে দিয়ে অরব্যান এবং তার অতি দক্ষিণপন্থী ফিডসেজ পার্টি সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিলেন এবং দুনিয়াকে দেখালেন হাঙ্গেরিতে গণতন্ত্র দিব্যি বেঁচে আছে। কিন্তু এটা আসলে একটা রাজনৈতিক ভোজবাজি। কারণ অতিমারি-পূর্ব অবস্থায় ফেরার বদলে, অরব্যান জরুরি অবস্থাকে প্রতিস্থাপিত করেছেন ‘চিকিৎসা সংকট’ দিয়ে। এর মধ্যে দিয়ে অরব্যান অনির্দিষ্টকাল অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। এমনকি সংবিধানের শেষ রক্ষাকবচটিও তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন সরকার প্রয়োজন বোধে সংবিধান না মেনেও কাজ করতে পারবে।

হাঙ্গেরির সংসদে ফিডসেজ পার্টির দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা আছে। তাকে কাজে লাগিয়ে অরব্যানকেই যে শুধু অস্বাভাবিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তাই নয়, সংসদ একটি সর্বব্যাপী বিল পাস করেছে। বলা হয়েছে, বর্তমান সংকটকে সামাল দিতেই ওই বিল কিন্তু বাস্তবে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার হরণের ক্ষেত্রে এই বিল অত্যন্ত আশঙ্কার। এই বিলকে কাজে লাগিয়ে বিরোধী দল চালিত পুরসভাগুলির তহবিল ছেঁটে দেওয়া হচ্ছে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি হচ্ছে, শ্রম আইন শিথিল করা হচ্ছে, সামরিক বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি করা হচ্ছে, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে এবং রূপান্তরকামীদের ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে।    

অরব্যান একাই নন। সর্বত্রই অতি দক্ষিণপন্থী নেতারা অতিমারিকে কাজে লাগিয়ে স্ব স্ব দেশে স্বৈরতন্ত্র নামিয়ে আনছেন। হাঙ্গেরির প্রতিবেশী পোল্যান্ডেও দক্ষিণপন্থী শাসক দল লকডাউনের মধ্যেই গত ১০ মে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে নিতে চাইছিল পোস্টাল ব্যালটে। কিন্তু তা নিয়ে বিতর্ক হয়। কারণ সে সময় ভোট হলে বিরোধীরা প্রচার করতে পারত না। পোস্টাল ব্যালটে নানা দুর্নীতিরও সুযোগ ছিল। পোল্যান্ডে ভোট এখন চলছে।  

আরেকটা নতুন ব্যাপার হল, জনস্বাস্থ্য সংকটের মোকাবিলায় সামরিক বাহিনীর ব্যবহার। এটা হাঙ্গেরিতে হয়েছে, তাছাড়া ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপিনসেও হয়েছে। দুটি দেশই অতিমারি সামলানো শুরু করতে দেরি করেছে। তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সরকারি বিনিয়োগ অত্যন্ত কম হওয়ায় পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে ওঠে। সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ থেকেই বোঝা যায়, দেশগুলির জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো কত দুর্বল।

ফিলিপিনসে করোনা ভাইরাস টাস্ক ফোর্সের দায়িত্বে রয়েছেন প্রতিরক্ষা সচিব(তিনি স্বাস্থ্য দফতরের কর্তা নন)। টাস্ক ফোর্সের তিন সিনিয়র সদস্যই প্রাক্তন সামরিক কর্তা। এপ্রিলে ফিলিপিনসের প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুয়ের্তে নির্দেশ দেন পুলিশ ও মিলিটারি সারাক্ষণ রাস্তায় থাকবে এবং কেউ নিভৃতবাসের নিয়ম না মানলে তাকে গুলি করে দেওয়া হবে। এখনও অবধি ১,২০,০০০ লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এই স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতার সঙ্গে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। অতিমারির মধ্যে ব্রিটেনেও পুলিশের তৎপরতা বেড়েছে। তারা যখন তখন পথচলতি মানুষকে থামিয়ে সার্চ করছে। বিশেষত পরিযায়ী সম্প্রদায় ও অশ্বেতাঙ্গদের ওপর এই ধরনের কার্যকলাপ বেড়েছে। ফ্রান্সের দক্ষিণপন্থী প্রেসিডেন্ট ম্যাকরঁ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধে জয়ী’ হওয়ার কথা বলেছেন। একগাদা অধ্যাদেশ জারি করে সপ্তাহে ৩৫ ঘণ্টা কাজের নিয়ম পালটে তা ৬০ ঘণ্টা পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন।   

অস্ট্রেলিয়াতেও কিছু গণতন্ত্র বিরোধী আইন পাস করা হয়েছে।

সত্যি বলতে কি, যে সব দেশ বিভিন্ন গণতন্ত্রবিরোধী পদক্ষেপ করছে, তারা তা অতিমারির আগে থেকেই করছিল। হাঙ্গেরি আগে থেকেই সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছিল এবং বিরোধীদের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনছিল। ফিলিপিনসে দুয়ের্তে ড্রাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে বেআইনি হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছিল। ম্যাকরঁ শ্রমিকদের অধিকার আগেই কেড়ে নেওয়া শুরু করেছিল, যার মধ্যে সাম্প্রতিকতম হল পেনশন বিল। ৯/১১-র পর থেকে অস্ট্রেলিয়ায় একের পর এক সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইন পাস হচ্ছিল। অতিমারির মধ্যেও সেই গতিই বজায় রয়েছে। সব মিলিয়ে নয়া উদারনৈতিক রাষ্ট্রগুলিতে কয়েক দশক ধরে যা চলছে, অতিমারি তা খুল্লমখুল্লা করে দিয়েছে।   

ফ্রান্স কিংবা ফিলিপিনস- সব পুঁজিবাদী জাতিরাষ্ট্রতেই জনসংখ্যার একটি ছোট্ট অংশ সংখ্যাগরিষ্ঠকে শোষণ করে। নয়া উদারবাদের যুগে ধনীদের হাতে আরও বেশি করে সম্পদ তুলে দওয়া হচ্ছে। তার জন্য শ্রমিক শ্রেণির ওপর বেশি করে অত্যাচার নামানো হচ্ছে। শ্রমিকদের লড়াই করার ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া চলছে। যেসব দেশগুলি স্বৈরতান্ত্রিক নয়, তারাও সুযোগ পেলেই এই কাজগুলি করছে। অতিমারি তেমনই একটি সুযোগ। কোভিড শাসক শ্রেণির মুখোশ খুলে দিয়েছে।

এবার আসা যাক ব্রাজিল ও আমেরিকার কথায়। এই দুই দেশের শাসক ট্রাম্প ও বলসোনারোকে প্রায়শই অরব্যান ও দুয়ের্তের সঙ্গে তুলনা করা হয়। কিন্তু তারা ওই দুজনের মতো বিরোধীদের ভয় দেখানো বা নিজেদের ক্ষমতাবৃদ্ধির চেষ্টা অতিমারিতে করেনি। বরং তারা করোনাকে অস্বীকার করতে চেয়েছে। বলাবাহুল্য, এই অবস্থানও দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সমর্থকদের খুশি করতেই নেওয়া হয়েছে।

ফলে এই দুই দেশই অ্যাকটিভ করোনা রোগী ও মৃতের সংখ্যায় প্রথম। দুই জায়গাতেই শারীরিক দূরত্ব ও লকডাউনের বিষয়টি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।   

বলসোনারো জনস্বাস্থ্যর বিষয়টাকে ‘বামপন্থী’ বিষয় বলে তকমা দিয়ে থাকেন। তিনি নিজে লকডাউনের বিরুদ্ধে বহু মিছিল করেছেন মুখোশ ছাড়া এবং শারীরিক দূরত্বের নিয়ম না মেনে। তার সমর্থকরা নিয়মিত বিভিন্ন শহরে মিছিল করেছে। তারা অবশ্য বিরোধিতারও মুখোমুখি হয়েছে।  সম্প্রতি তিনি নিজেও করোনা সংক্রমিত হয়েছেন। করোনার জেরে ব্রাজিলের অর্থনীতি বেশ কিছুটা ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা। তিনি এর পুরো দায়টাই আমপন্থীদের উপর চাপিয়ে দিতে চান। করোনা নিয়ে ব্রাজিলে শাসক শ্রেণির দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করেছে। বলসোনারো চাইছেন সামরিক শাসন জারি করে লকডাউনপন্থীদের শায়েস্তা করতে।

সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং জনস্বাস্থ্যের সংকট যতই তীব্র হচ্ছে, দুনিয়ার শাসক শ্রেণি ততই মুনাফা বাড়াতে এবং ক্ষমতা নিজেরে হাতে রাখতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এর জন্য তারা নানা পন্থা নিচ্ছে। শাসকের রং যাই হোক- তারা সরকারি ক্ষমতা বাড়াচ্ছে, জনস্বাস্থ্যে খরচ কমাচ্ছে, শ্রমিক শ্রেণি ও গরিব মানুষের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনছে। ব্রাজিল, ফ্রান্স কিংবা আমেরিকায় যে গণ সংগ্রাম গড়ে উঠেছে, সেটাই একমাত্র শাসকদের গণমুখী নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য করতে পারে।

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *