Home কৃষি সংস্কার কর্মসূচি: ভারতীয় কৃষির সর্বনাশের নীল নকশা, পর্ব -২

সংস্কার কর্মসূচি: ভারতীয় কৃষির সর্বনাশের নীল নকশা, পর্ব -২

সংস্কার কর্মসূচি: ভারতীয় কৃষির সর্বনাশের নীল নকশা, পর্ব -২
1
সুমনকল্যাণ মৌলিক

নির্মলা সীতারামন ঘোষিত কৃষি সংস্কার কর্মসূচির দ্বিতীয়  গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা হল প্রচলিত বাজার ব্যবস্থার অনিবার্যতাকে অপ্রয়োজনীয় করে দিয়ে কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রে ই-কমার্স চালু করা।এর ফলে এতদিনের প্রচলিত মান্ডি ব্যবস্থার (agriculture produce market committees /APMC) পরিবর্তে বিপণন ব্যবস্থাকে প্রসারিত করা যায় যাতে বাজার বলে এতদিন যে সীমাবদ্ধ কাঠামোর অস্তিত্ব ছিল তাকে অস্বীকার করা যায়। সরকার এই নতুন ব্যবস্থার জন্য  `farmers producer trade and Commerce (promotion and facilation) ordinance -2020` ঘোষণা করেছে। এই অর্ডিনান্সের মূল কথাগুলো নিম্নরূপ –

আরও পড়ুন: সংস্কার কর্মসূচি : ভারতীয় কৃষির সর্বনাশের নীল নকশা ,পর্ব -১

# এই নতুন ব্যবস্থা ভৌগোলিক ভাবে সীমাবদ্ধ বাজার ব্যবস্থা থেকে ভারতীয় কৃষকদের মুক্তি দেবে ও তাদের জন্য নতুন সুবিধার বার্তা বয়ে আনবে। কৃষকরা এখন তাদের পছন্দ মতো জায়গায় যে কাউকে ফসল বিক্রি করতে পারবে।

#এখানে বাজারে বিকিকিনির জন্য আলাদা করে কোন বাজার ফি, সেস বা লেভি লাগবে না।

# কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্যান কার্ড থাকলেই তারা বিকিকিনিতে অংশ নিতে পারবে।

# সাধারণত বাজার / মান্ডিতে সেদিনই ফসলের দাম মেটানোর ব্যবস্থা থাকে। এখানেও তাই বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো কারণে তা সম্ভব না হলে পরবর্তী তিনটি সাপ্তাহিক কাজের দিনের মধ্যে ফসলের দাম মিটিয়ে দিতে হবে।

#এই অর্ডিনান্সের ফলে সে অর্থে বাজার পরিচালনার ক্ষেত্রে এপিএমসি-গুলির আর কোন ক্ষমতা থাকল না।

যদিও এই অর্ডিন্যান্স অসম্পূর্ণ এবং আগামী দিনে আরো বিস্তৃত নিয়মবিধি লাগু হবে তবুও কতকগুলি পর্যবেক্ষণ অবশ্যই সামনে আসে — প্রথমত যেহেতু এখানে বাজারের মত একাধারে পণ্য বিক্রি ও পয়সা পাওয়ার ব্যবস্থা নেই তাই প্রশাসনিক স্তরে নজরদারির ব্যবস্থা আরো কঠোর করা দরকার। যদিও সে ব্যাপারে এ অর্ডিন্যান্সে কিছুই বলা হয়নি।দ্বিতীয়ত সাধারণ ভাবে এখন মান্ডি ব্যবস্থায় ক্রেতা ও বিক্রেতাদের পরিষেবা মূল্য বাবদ (১%-৩%) একটা খরচ দিতে হয়,যা আর লাগবে না। কিন্তু ই-কমার্সের বিকিকিনিতে প্রসেসিং ফি লাগবে কি না তা স্পষ্ট নয়। তৃতীয়ত নিয়ন্ত্রক হিসাবে এপিএমসির অস্তিত্ব আজ সংকটে ফলে মান্ডির সঙ্গে যুক্ত একটা বড়ো অংশের মানুষ আজ কাজ হারাবেন। চতুর্থত ওয়ারহাউস ও কোল্ড স্টোর চেনগুলি কৃষি পণ্যের বাজারে নতুন ক্রেতা হিসাবে আবির্ভূত হবে। এতদিন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানগুলির কাজকর্মকে নজরদারি করত `warhousing development and regulating act` দ্বারা গঠিত বিধিবদ্ধ সংস্থা।কিন্তু ফসল কেনার ব্যাপারে এই সংস্থার কোনো দায়িত্ব থাকবে না। পঞ্চমত এই অর্ডিনান্সের ফলে কর্পোরেট কৃষি বানিজ্য সংস্থাগুলো সদলবলে ভারতের বাজারে প্রবেশ করবে। কৃষক ফসল  বিক্রির ব্যাপারে ঠকলে বা ফসলের উপযুক্ত দাম না পেলে সে ব্যাপারে আইনি লড়াই সে কীভাবে লড়বে তার কোনো ধারণাই অর্ডিনান্সের পাতায় নেই। আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে যে বৃহৎ কর্পোরেশনগুলির আর্থিক ক্ষমতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আইনি লড়াই চালাবার মত অবস্থা ভারতীয় কৃষকদের আদৌ থাকবে কি না!

একথা পরিষ্কার করে বলা ভালো যে কর্পোরেট স্বার্থে বিপণন ব্যবস্থায় বদল কোনো নতুন কথা নয়  বরং  বিগত সংস্কারগুলির ধারাবাহিকতা।ভারতে উদারীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবার পর থেকেই কৃষি বিপণনে কর্পোরেট প্রবেশের দাবি জোরালো হতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ সেনের নেতৃত্বে এক উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করে। এই কমিটির কাছে কৃষি পণ্যের কারবারি বহুজাতিক কোম্পানিগুলো প্রতিনিধিরা জানায় যে তারা কৃষি পণ্যের বিপণনে শর্ত সাপেক্ষে পুঁজি বিনিয়োগ করতে রাজি।এই শর্তগুলোর মধ্যে ছিল কৃষিপণ্য ক্রয়কারী সরকারি এজেন্সিদের গুরুত্ব ও ক্ষমতা হ্রাস করতে হবে। গণবন্টন ব্যবস্থার পরিধি সংকুচিত করতে হবে।পাশাপাশি মান্ডি ব্যবস্থার সমান্তরালে তাদের সরাসরি কৃষক দের কাছ থেকে ফসল কিনতে দিতে হবে। বহুজাতিকদের এই চাপ বিফলে যায়নি।এর ফলে ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া সহ বিভিন্ন সরকারি এজেন্সি গুলোর ক্ষমতা ধারাবাহিকভাবে হ্রাস করা হয়। সর্বজনীন গণবণ্টন ব্যবস্থার বদলে লক্ষ্য ভিত্তিক ( এপিএল ও বিপিএল) গণবন্টন ব্যবস্থা চালু হয়। উদারীকরণ ও সংস্কার প্রক্রিয়ার দুই দশকে প্রায় প্রতিটি রাজ্য APMC act-এর প্রয়োজনীয় সংস্কার করে কর্পোরেটদের স্বার্থে। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট আমলে রাজ্য সরকার কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে  APMC আইন বদলের সিদ্ধান্ত নেয়। এ ব্যাপারে তাদের পরামর্শদাতা ছিল ম্যাকিনসে কোম্পানি। কিন্তু গণ আন্দোলনের চাপে বুদ্ধবাবুর সরকার তাতে সফল হননি।কিন্তু পরে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার ২০১৪ সালের ৮ ডিসেম্বর বিধানসভার একদিনের বিশেষ অধিবেশন ডেকে সংশোধিত এপিএমসি বিল পাশ করিয়ে নেয় যা কেন্দ্রীয় সরকার ও কর্পোরেট পুঁজিকে বিশেষ আহ্লাদিত করেছে।

একথা অনস্বীকার্য যে প্রচলিত মান্ডি ব্যবস্থায় বহু ত্রুটি আছে যার ফলে কৃষকের স্বার্থ লুন্ঠন হয়। তাই দরকার ছিল কৃষক স্বার্থে সরকারের উদ্যোগে এপিএমসি আইনের সংশোধন। বদলে মান্ডি ব্যবস্থাকে দুর্বল করে কর্পোরেট অনুপ্রবেশের পথ আরো প্রশস্ত করল মোদি সরকার। মুক্ত বাজার অর্থনীতির সমর্থকদের দাবি কৃষি বিপণন কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিলে কৃষকরা বাজারের ফড়েদের হাত থেকে রক্ষা পাবেন। এখানে একটা প্রশ্ন ওঠা খুব যুক্তিযুক্ত।ভারতবর্ষে গত পনেরো বছরে রিলায়েন্স,বিড়লা,টাটা,ভিয়ানি গ্রুপ পরিচালিত অজস্র সুপার মার্কেট ও শপিং মল গড়ে উঠেছে। এর ফলে ভারতে নতুন নতুন হিমঘর তৈরি হয়েছে, কৃষকেরা ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে, ফড়েদের উৎপাত কমছে– এমন কোনো উদাহরণ আছে  কি?

আমরা  বরং  বিগত সময়ে কৃষি ক্ষেত্রে ই-কমার্স-এর দুটি উদাহরণ পেশ করতে চাই যা কিছুটা হলেও আমাদের সংস্কার কর্মসূচির ভবিষ্যৎ বুঝতে সাহায্য করবে।

উদা-১: আইটিসি(ইন্ডিয়ান টোবাকো কোম্পানি)  একটি বহুজাতিক সংস্থা যার ৩১.৭শতাংশের মালিক ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানি (ব্যাট)। তামাক জাত সামগ্রী বিক্রয় এদের প্রধান ব্যবসা হলেও নব্বই- এর দশকে এরা কৃষি ক্ষেত্রে প্রবেশ করে। আইটিসি সয়াবিন জাত সামগ্রী সারা পৃথিবীতে বিক্রি করছে। ২০০০ সালে আইটিসি চৌপল কৃষকদের কাছ থেকে সয়াবিন কিনতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবেই উন্নত ওজনযন্ত্র,নগদ পেমেন্ট প্রভৃতির কারণে চিরাচরিত মান্ডির থেকে ই-চৌপল অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০০১-০২ সালে চৌপলের মাধ্যমে আইটিসি ৬০,০০০ মেট্রিক টন সয়াবিন সংগ্রহ করে। ২০০২-০৩ সালে পরিমাণটা বেড়ে হয় ২,১০,০০০ মেট্রিক টন। এর ফলে একদিকে যেমন মান্ডি ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল,তেমনি সয়াবিনের সমস্ত ছোটো ছোটো কোম্পানিগুলো কাঁচামালের সংকটে পড়ল।এই একচেটিয়া করণের ফলে দেখা গেল কিছু দিন পর অতিরিক্ত আর্দ্রতা বা কম গুনমানের অজুহাতে আইটিসি সয়াবিনের দাম কমিয়ে দিচ্ছে বা কিনতে অস্বীকার করছে।ফলে কৃষকেরা বিপন্ন হয়ে পড়ল,কারণ মান্ডিগুলো ভেঙে পড়ার জন্য পণ্য বিক্রি করার বিকল্প ব্যবস্থা আর অবশিষ্ট ছিল না।

উদা-২: আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে ভারতে প্রবেশ করে কর্পোরেট সংস্থা পেপসিকো। প্রতিশ্রুতি ছিল প্রথমে পাঞ্জাব ও পরে সারা দেশে এই কোম্পানিটি উদ্যান বিপ্লব ঘটাবে। কৃষি ফার্ম থেকে উপভোক্তার খাবার থালা পর্যন্ত সমস্ত ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করবে পেপসিকো। সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরি করার জন্য তারা কোটি কোটি টাকা লগ্নি করবে।৩০ বছর কেটে গেছে,একদা ভারতের শস্য গোলা বলে পরিচিত পাঞ্জাব আজ কৃষকের আত্মহত্যা ও ক্যানসার রোগের কারণে সংবাদের শিরোনামে। কিন্তু আজ পর্যন্ত পেপসিকোর গালভরা প্রতিশ্রুতি কেন বাস্তবায়িত হল না তার কোন উত্তর মেলেনি।

ই-ট্রেডিং- এর মাধ্যমে কৃষক  তার  ফসলের ন্যায্য দাম পাবেন  বলে যারা স্বপ্ন ফেরি করছেন  তাদের কাছে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আজ আমাদের দাবি করতেই হবে!

আগামী পর্বে চুক্তি চাষ

Share Now:

Comment(1)

  1. পেপসিকো এর প্রতিশ্রুতি নিয়ে আলাদা আলোচনা চাই।

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *