Home কৃষি সংস্কার কর্মসূচি : ভারতীয় কৃষির সর্বনাশের নীল নকশা ,পর্ব -১
2

সংস্কার কর্মসূচি : ভারতীয় কৃষির সর্বনাশের নীল নকশা ,পর্ব -১

সংস্কার কর্মসূচি : ভারতীয় কৃষির সর্বনাশের নীল নকশা ,পর্ব -১
2
সুমনকল্যাণ মৌলিক

কোভিড জনিত আর্থিক বিপর্যয় ও শ্রমজীবি মানুষের বিপন্নতার সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এই সময় পর্বে ভারতে সাম্রাজ্যবাদী এজেন্সিগুলি নির্ধারিত অ্যাজেন্ডা সমূহ রূপায়ণে সচেষ্ট হয়েছে। একদিকে আত্মনির্ভরতার মায়াবী শ্লোগান, অন্যদিকে দেশ বেঁচে দেওয়ার নীল নকশা। শ্রম আইন সংস্কার, কয়লা ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণ, প্রতিরক্ষা শিল্পে একশ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতির ধারাবাহিকতায় কৃষি ক্ষেত্রে এসেছে একগুচ্ছ সংস্কার, যেগুলিকে দুহাত তুলে স্বাগত জানাচ্ছে কর্পোরেট সংস্থাগুলো।

খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে এর মধ্যে রয়েছে অত্যাবশকীয় পণ্য আইনের সংশোধন করে দানাশস্য,ভোজ্য তেল,তৈলবীজ,ডাল,পিঁয়াজ, আলু সহ সমস্ত খাদ্যশস্যকে নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করা। সমস্ত রকম বানিজ্যিক বিধিনিষেধকে সরিয়ে মুক্ত বাজার করা যাতে কৃষক তার ফসল ইচ্ছে মতো জায়গায় বিক্রি করতে পারে। তার জন্য ই-কমার্স পরিকাঠামোকে শক্তিশালী করা সর্বোপরি সমস্ত ফসলের ক্ষেত্রে চুক্তি চাষ চালু করা।

আমরা পর্ব ভিত্তিক ভাবে এই সংস্কার কর্মসূচির প্রেক্ষাপট, বর্তমান নকশা ও ভারতের কৃষি ব্যবস্থায় তার দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করব।

অত্যাবশকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন

ভারতের শ্রমজীবী মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইনের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।এই আইনের উৎস লুকিয়ে আছে ১৯৪৩ সালের `ভারত রক্ষা ` আইনে। সে সময় ভারতের অর্থনীতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া ও উদ্ভূত দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্য পণ্যর বেআইনি মজুত ও কালোবাজারি রুখতে সরকার পণ্যের নিয়ন্ত্রণ চালু করে যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট ছিল না। ৪৭` পরবর্তী সময়ে নতুন প্রজাতন্ত্রের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল খাদ্যের জোগান। সে সময় আমাদের দেশ খাদ্যের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর বহুলাংশে নির্ভর করতে শুরু করে এবং অত্যন্ত নিম্ন মানের পি এল-৪৮০ গম আমদানি করতে বাধ্য হয়। অনেক এই পর্ব টাকে `ship to mouth economy ` বলে আখ্যায়িত করেন। সে সময় একদিকে যেমন সরকারি স্তরে খাদ্য নির্ভরতা অর্জনের জন্য পরিকল্পনা নেওয়া হয় তেমনি খোলাবাজারে খাদ্য ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য ১৯৫৫ সালে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন চালু হয়। সে সময়ে কেন্দ্রের আইনে বলীয়ান হয়ে রাজ্যগুলি পণ্যের অবাধ যাতায়াতের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ চালু করে যা সাধারণ ভাবে জনমানসে `কন্ট্রোল` বলে পরিচিত ছিল। এক কথায়  বলা চলে ভারতের মত বিশাল ও আর্থিক ভাবে দুর্বল দেশে ফসলের বিষয়টা যাতে ব্যবসায়ী ও মজুতদার রা কুক্ষিগত করতে না পারে তার জন্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন চালু হয়।

ভারতের ধীরে ধীরে খাদ্য নিরাপত্তার ক্রমিক উন্নতির পেছনে এই আইনটিরও সদর্থক ভূমিকা আছে। কিন্তু নব্বই- এর দশকে নয়া উদারবাদের চাপে এবং বিশ্বব্যাঙ্ক,আইএমএফ, এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক প্রভৃতি আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির অভিভাবকত্বে ভারত সরকার যে আর্থিক সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করে তার মূল লক্ষ্য ছিল ভারতের কৃষি ক্ষেত্রকে মুক্ত বাজার অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত করা। সেক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন ছিল অবশ্যই প্রতিবন্ধকস্বরূপ। স্বাভাবিক ভাবেই ২০০২ সালে তৎকালীন বাজপেয়ী সরকার এই আইন প্রথমবার সংশোধন করে গম,ধান,চাল,বাজরা,রাগি প্রভৃতি দানাশস্যকে নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করে। কিন্তু ঘটনার গতি পরিবর্তন হতে বেশি সময় লাগে না। ২০০৬-০৭ সময় পর্বে বিশ্বজোড়া খাদ্য সংকট দেখা দেয়, ফলে সরকার বাধ্য হয় আবার পূর্ববর্তী নিয়ন্ত্রণগুলি ফিরিয়ে আনতে। সে সময় দেশে খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। দেখা যায় বাজপেয়ী সরকারের কর্পোরেট বান্ধব সংশোধনীর কারণে দেশে গমের মজুত কমে গেছে। ২০০৬ সালের ১ এপ্রিল দেশে গমের মজুত ভাণ্ডার ছিল ২০ লক্ষ মেট্রিক টনেরও কম অথচ সরকারি আইন মোতাবেক গমের ন্যূনতম মজুতভাণ্ডার (buffer stock)থাকার কথা ৪০ লক্ষ মেট্রিক টন।এই সংকট থেকে বাঁচার জন্য সরকার ২০০৬-০৮ সময়পর্বে ৫৫ লক্ষ মেট্রিক টন গম বিদেশ থেকে আমদানি করে। এর পাশাপাশি আমরা যদি করোনা পর্বের অভিজ্ঞতা স্মরণ করি তাহলে দেখব দেশে যে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি তার প্রধান কারণ খাদ্যের মজুত ভাণ্ডার ও  গণবন্টন ব্যবস্থার অস্তিত্ব। আমাদের মত দেশে যে সমস্ত খাদ্য শস্য উৎপাদন হয় তার মধ্যে ধান ও গম ছাড়া বেশিরভাগ  কৃষি পণ্যের পরিমাণ অভ্যন্তরীণ চাহিদার চেয়ে সামান্য বেশি। ফলে প্রায়শই দেখা যায় বিভিন্ন পণ্যের হঠাৎ করে গগনচুম্বী মূল্য বৃদ্ধি হয় এবং সরকারকে জনমতের চাপে হস্তক্ষেপ করতে হয়। ২০১৮ সালে প্রকাশিত OFCD-ICRIER এর রিপোর্ট অনুযায়ী গম,চাল,আলু,পিঁয়াজ, চিনি প্রভৃতি শস্য এর দাম নিয়ন্ত্রণ করতে গত দশবছরে সরকারকে অসংখ্যবার হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির প্রথম পর্বের শাসনকালে ( অক্টোবর, ২০১৫) রাতারাতি অড়হড় ডালের দাম  হয় কেজি প্রতি ২০০ টাকা। আয়কর দফতরের তদন্তে উঠে আসে ২.৫ লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতির গল্প। কী করে অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্র রাতারাতি দাম বাড়িয়ে দেয় তার রোমাঞ্চকর বিবরণ আছে   `aprisal report in the case of pulse imports and traders group `  শীর্ষক প্রতিবেদনে। সে সময় এই অত্যাবশ্যক আইনকে কাজে লাগিয়ে সরকারি এজেন্সি গুলি ৭০,০০০ মেট্রিক টন ডাল বাজেয়াপ্ত করে।

আজ যখন দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করতে আরো কার্যকর অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন আমরা চাইছি, তখন মোদি সরকার করোনা অতিমারিকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে সেই আইনটিকেই বাতিল করে দিল।সমস্ত কৃষি পণ্যের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে তাকে বাজারের মুখাপেক্ষী করে তুলল।  `the essential commodities ( amendment) ordinance 2020`তে বলা হয়েছে একমাত্র যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়,অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি প্রভৃতি ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রণ বলবৎ করা হবে। অবশ্য তাতেও কিছু চাতুরি আছে। কর্পোরেট ফুড চেনের সংগৃহীত পণ্য ও তাদের ব্যবসাপত্রের ক্ষেত্রে কোন নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। অবশ্য এই বিশেষ পরিস্থিতিগুলিতে নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাবও বাজার অর্থনীতির মুক্তকচ্ছ সমর্থকদের না পসন্দ। এদেরই একজন অধ্যাপক অশোক গুলাঠি প্রশ্ন তুলেছেন পেঁয়াজের দাম যদি ২২ টাকা কেজি থেকে হঠাৎ করে ৪৪ টাকা কেজি হয় ( ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি) তাহলে কি সরকার হস্তক্ষেপ করবে?  অধ্যাপকের মতে তাহলে নাকি সংস্কারের উদ্দেশ্যটাই মাঠে মারা যাবে।এখনো পর্যন্ত  এই আইন থাকার কারণে খাদ্যের মজুত ভাণ্ডার সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা আমাদের সবার থাকত। কিন্তু আইন উঠে যাওয়ার পর কোন ব্যক্তি বা কর্পোরেট গোষ্ঠীর কাছে কত খাদ্যের ভাণ্ডার আছে তা কারো জানা থাকবে না। এবার ইচ্ছে মতো  দাম বাড়ানো বা কমানোর লাইসেন্স পেয়ে যাবে অসাধু মজুতদাররা। একই সঙ্গে  খাদ্য পণ্য বেচাকেনার নিয়ন্ত্রণটা চলে যাবে বহুজাতিক কর্পোরেট কৃষি বিপণন সংস্থা গুলোর হাতে। সরকারের লক্ষ্য কৃষি বিপণনের হাত ধরে এগ্রি ডলার কামানো, তার জন্য আইন বদল।  কিন্তু  তা একই সঙ্গে আম আদমির খাদ্য নিরাপত্তাকে যে বিপন্ন করবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়।

আগামী পর্বে— শস্যের বেচাকেনা ও ই-কমার্স

Share Now:

Comment(2)

  1. খুবই সময়োপযোগী ভাল লেখা। ভাল লেগেছে । একটি ব্যাপার লক্ষ্য করবেন আই. আর. 480 গম থাকতে পারে ,চাউল টা ছিলই। বেশি ফলন শীল এই I.R.480’র পরীক্ষা মূলক চাষ হয় ফিলিপিন্স এ। কিন্তু এর food value খুব কম থাকায়, ভোক্তারা অপুষ্টি জনিত রোগে ভুগছিলেন ।

  2. Amendment ordinance 2020 কত তারিখে পাশ হল?
    অর্ডিন্যান্স আর act এর মধ্যে পার্থক্য কি?

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *