Home লোকাচার যারা চলতি ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে চায়, তাদের কাছে প্রতিবাদের কোনো পন্থাই যথাযথ নয়

যারা চলতি ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে চায়, তাদের কাছে প্রতিবাদের কোনো পন্থাই যথাযথ নয়

যারা চলতি ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে চায়, তাদের কাছে প্রতিবাদের কোনো পন্থাই যথাযথ নয়
0

রেডফ্ল্যাগ পোর্টালে প্রকাশিত ডেভিড ব্লিন্ডারম্যানের এই নিবন্ধটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে লিখিত হলেও, এর প্রতিটি অক্ষরের সঙ্গে ভারতের অবস্থার মিল রয়েছে। আসলে শ্রমিক শ্রেণির মতো বুর্জোয়ারাও একটি আন্তর্জাতিক শ্রেণি। তাদের আচার-আচরণে সব দেশেই মিল খুঁজে পাওয়া যেতে বাধ্য। সে কথা বিবেচনা করে আমরা প্রবন্ধটির ভাবানুবাদ প্রকাশ করলাম।

জাতীয় সঙ্গীতের সময় হাঁটু মুড়ে বোসো না, সেটা অসম্মানজনক! পথ অবরোধ কোরো না, আমায় কাজে যেতে হবে! জানলার কাঁচ ভেঙোনা, তুমি নিজের সম্প্রদায়েরই ক্ষতি করছ! যদি তোমার কাউকে পছন্দ না হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে ভোট দিলেই তো হয়! পুঁজিবাদী স্থিতাবস্থার পক্ষের লোকরা প্রতিবাদের কোনো পন্থীকে কোনোদিনই যথাযথ পন্থা বলে মেনে নেবে না। হয় সেটা খুব হিংস্র, খুব বিভেদমূলক বা খুবই অসুবিধাজনক। অথবা হয়তো প্রতিবাদটা করার সেটা ঠিক সময় নয় বা প্রতিবাদের স্থানটা ভুল নির্বাচন হয়েছে। হয়তো সেই ঠিক সময় বা স্থানটা কোনোদিনই খুঁজে পাওয়া যাবে না।

আরও পড়ুন: দাঙ্গাবাজের দল, তোমাদের ধন্যবাদ !

যখন মার্কিন ফুটবল তারকা কলিন কেপারলিঙ্ক জাতীয় সঙ্গীতের সময় হাঁটু মুড়ে বসলেন, তখল তাঁকে এনএফএল কালো তালিকা ভুক্ত করে দিল। বাস্কেটবল খেলোয়াড় লেব্রন জেমস প্রতিবাদী টি শার্ট পরে গা গরম করলে বহু মার্কিন ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার ও ভক্তরা বললেন, ‘খেলায় রাজনীতি ঢোকানো উচিত নয়’। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স অভিবাসীদের জন্য আয়োজিত একটি খেলা দেখতে গিয়েছিলেন, সেখানে অভিনেতারা একটি প্রতিবাদপত্র পাঠ করেন। তাতে পেন্স সেখান থেকে বেরিয়ে যান। সবচেয়ে বিনীত, সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদও এইসব লোকদের কাছে ন্যায়সঙ্গত নয়।  

এমনকি উদারনৈতিকরা(লিবারেল, যারা আজকাল সামান্য হলেও প্রতিবাদ সমর্থন করেন, তাদের মধ্যেও অনেকে আছে যারা হিংসার নিন্দা করেন। তাদের কাছে প্রতিবাদের আদর্শ রূপ হল, গ্রীষ্মের দিনে শান্ত হ্রদের মতো, যাতে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো প্রকৃত সংঘর্ষের বিপদ না থাকে। তারা আশা করেন সেই সম্মানজনক পথেই রক্ষণশীলদের হৃদয় জয় করা যাবে এবং পরিবর্তন আসবে। তাঁরা ভুলে যান যে সেই ১৯৬০ সালের নাগরিক অধিকার আন্দোলন থেকে আজকের জলবায়ু নিয়ে আন্দোলন পর্যন্ত কোনোদিন ক্ষমতাসীনরা লড়াই ছাড়া এক ইঞ্চিও জমি ছাড়েনি।

যারা অন্য়ায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভে সম্পত্তি ধ্বংস করে বা নিজেদের বসতি অঞ্চলের ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে লুঠপাট চালায়, তাদের সকল রকমের মধ্যপন্থীরাই নিন্দা করে। আগামীকাল এই লোকগুলোই এই বসতিগুলো ভেঙে অভিজাতদের থাকার জায়গা তৈরি হলে এবং স্থানীয় ব্যবসাকে তুলে দিয়ে বড়ো কর্পোরেট হাউজের ফ্র্যানচাইজি চেন গেঁড়ে বসলে, দু’হাত তুলে সমর্থন করবে। বিদ্রূপাত্মক খবরের ওয়েব সাইট ‘ওনিয়ন’ তাদের শিরোনামে এই বিষয়টা চমৎকার তুলে ধরেছে, ‘প্রতিবাদীদের সমালোচনা করা হচ্ছে, কারণ তারা একটি বেসরকারি অংশীদারি সংস্থা তৈরি না করেই অন্য ব্যবসায় লুঠপাট চালাচ্ছে’।  

এই উদারনীতিবাদী ‘প্রগতিশীল’রা পরিবর্তনের প্রৃত সমর্থক নয়। তারা এমন ভাব করে যেন তারা বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিকার চায়, কিন্তু সংগ্রামের প্রতিটি মুহূর্তে যারা লড়াইটা এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়, তাদেরকে এরা ধৈর্য ধারার পরামর্শ দিয়ে চলে।

এই সব লোকদের জন্যই লেখক জেমস বল্ডউইন ১৯৮৯ সালে তাঁর সেই বিখ্যাত মন্তব্যটি করেছিলেন।“আমাকে তুমি নিজের সঙ্গে কী মিটমাট করে নিতে বলছো? এখানে ৬০ বছরেরও আগে জন্মেছি। আমি আরও ৬০ বছর বাঁচব না। তুমি বরাবর বলে এসেছ, সময় লাগবে। আমার বাবার জীবন গেছে, আমার মার জীবন গেছে, আমার কাকার জীবন গেছে, আমার দাদার, দিদির, খুড়তুতো দিদির এবং দাদার জীবন- প্রগতির জন্য তুমি কত সময় চাও?”  

মধ্যপন্থীরা ঝটপট পুলিশের হাঁটু মুড়ে বসা এবং প্রতিবাদীদের জড়িয়ে ধরার দৃশ্য নিয়ে উদ্‌যাপন করা শুরু করে দিয়েছে। তারা বলতে চাইছে, যে পরিবর্তন তারা চাইছিল সেটা আসতে শুরু করেছে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিভ্রম তৈরি হয় যে জাতিবিদ্বেষ ও অন্যায়কে শান্তিপূর্ণ পথে সংস্কারের মাধ্যমে দূর করা যাবে। বাস্তবাটা হল, ঘণ্টাখানের মধ্যেই পুলিশ সেই প্রতিবাদীদেরই পেটানো, পিটিয়ে বিকলাঙ্গ করে দেওয়া, অন্ধ করে দেওয়া, জমায়েতের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালানো ইত্যাদি কাজ শুরু করে দিয়েছে।

যে মুহূর্তে ট্রাম্প সেনা আইন জারি ও আরও রাষ্ট্রীয় হিংসার পক্ষে সওয়াল শুরু করল, সাথে সাথেই প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও লিবারলদের সম্রাট বারাক ওবামা প্রতিবাদের হিংসার নিন্দা করে।মিডিয়াম ডট কমে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে ওবামা বলেন, হিংস্র প্রতিবাদীরা ‘নিরীহ মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে’। তাঁর দেখা একটি সাক্ষাৎকারের কথা ওবামা বলেন, যেখানে ‘এক বয়স্ক মহিলা কাঁদছেন…কারণ এলাকার একমাত্র মুদিখানাটি ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। যদি আমরা ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব, ওই দোকানটি নতুন করে তৈরি হতে কয়েক বছর লেগে যাবে। অতএব হিংসার জন্য কোনো অজুহাত দিও না, তার কার্যকারণ ব্যাখ্যা কর না অথবা তাতে অংশগ্রহণ কর না’।

এই কথার মধ্যে একটাই বার্তা লুকিয়ে আছে- হও তুমি যা পেয়েছ, সেটা মেনে নাও নইলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। ওই মুদিখানাটি ভেঙে দিও না, কারণ কেউ সেটা আবার তৈরি করে দেবে না। তোমার সম্প্রদায়ের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে লড়াই কর না, পুষ্টিকর খাদ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য সুযোগসুবিধার অভাবের বিরুদ্ধে লড়াই কর না, কারণ যদি তুমি সে পথে হাঈঁচ তাহলে তোমায় আরও শাস্তি পেতে হবে। ডেমোক্রাটিক পার্টির মধ্যপন্থী ওবামার কথা মানতে হলে, তুমি সবচেয়ে বেশি যেটা করতে পার, তা হল আগামী নভেম্বরে জো ‘ওদের পায়ে গুলি কর’ বিডেনকে ভোট দিতে পার।

বাস্তব পৃথিবীর যা পরিস্থিতি, তাতে কালো আমেরিকানদের কাছে সেটা একটা হাস্যকর প্রস্তাব। মার্কিন রাষ্ট্রের জাতিবিদ্বেষ ও নিষ্ঠুরতা এতটাই তীব্র যে তা হোয়াইট হাউজ বা কংগ্রেসের একটি চেয়ারে বসে সুইচ টিপে পালটে দেওয়া সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে। ‘হিংসা’র বিরুদ্ধে তাদের ভয় দেখানো নিয়ে মাথা ঘামানোর দিন বহু আগেই চলে গিয়েছে। চলতি বিদ্রোহের যা মেজাজ, সেটা ম্যালকম এক্স তার স্বাধীনতার স্লোগানে বলে গিয়েছেন, ‘যে কোনো উপায়ে হোক না কেন’। সেটাই এখন উদ্‌যাপন করার বিষয়।    

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *