Home রাজনীতি গরিবরা যা পেটের টানে ভাঙে আর মধ্যবিত্ত বিদ্যুতের দাবিতে, তাকেই বলে লকডাউন

গরিবরা যা পেটের টানে ভাঙে আর মধ্যবিত্ত বিদ্যুতের দাবিতে, তাকেই বলে লকডাউন

গরিবরা যা পেটের টানে ভাঙে আর মধ্যবিত্ত বিদ্যুতের দাবিতে, তাকেই বলে লকডাউন
0
প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী

তখন ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। বিদ্যুত আসেনি। অপেক্ষার বাঁধ ভেঙেছে মানুষের। তারা পথ অবরোধ করেছেন। কাছেই দাঁড়ানো পরিচিত রিক্সাচালকের সঙ্গে কথা বলছিলাম। বললেন, ‘বেশ হয়েছে’। কেন তাঁর এহেন প্রতিক্রিয়া? জিজ্ঞাসা করতে জানা গেল, পথ অবরোধ কর্মসূচির নেতৃস্থানীয় দু’জনের একজন লকডাউনের দ্বিতীয় দিন রিক্সা নিয়ে বেরনোর জন্য তাঁর রিক্সার একটি চাকার হাওয়া খুলে দিয়েছিলেন। অন্যজন পাশে দাঁড়িয়ে তা সরবে সমর্থন করেছিলেন। রিক্সাচালক খুব অবাক হয়েছিলেন, কারণ ওই দ্বিতীয় ব্যক্তি তাঁর অতি পরিচিত যাত্রী।

ঘটনাটা আমার পাড়া থেকে একটু দূরের। জোর করে সাধারণীকরণ করতে চাই না, তবে চিত্রটা কলকাতার বেশিরভাগ অঞ্চলে একই রকম হওয়ার কথা। অথচ বেশ কয়েক দশক নাগরিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হওয়া মানুষের তিন দিনেরও বেশি সময় বিদ্যুৎ না থাকলে চূড়ান্ত ক্ষোভ হওয়া তো অস্বাভাবিক নয়।সুন্দরবনের ভেসে যাওয়া মানুষের দুর্গতির খবর দিয়ে তাদের চুপ করে থাকতে বলার মধ্যে মহান হওয়ার ঝোঁক থাকতে পারে, কাব্যিক সৃজনশীলতা থাকতে পারে, এমনকি অতিবাম বিপ্লবীয়ানাও থাকতে পারে, কিন্তু তাতে বিপর্যস্ত নগরবাসীর প্রতি ন্যায় করা হয় না। পাম্পে জল তোলা যাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের অঙ্গ হয়ে গিয়েছে বহুদিন, সেই বন্দোবস্ত দিন তিনেকের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই বিকল্প খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এটা শুধু শারীরিক পরিশ্রমের প্রশ্ন নয়। রেফ্রিজারেটর নির্ভর জীবনে অনির্দিষ্ট কালের বিদ্যুৎহীনতা জটিল সমস্যা তৈরি করে তো বটেই। এমন অনেক ওষুধও বাড়িতে রাখতে হয়, যা রেফ্রিজারেটর ছাড়া সংরক্ষিত হয় না। তালিকা দীর্ঘ করার প্রয়োজন নেই। মূল কথা হল, সুন্দরবনবাসীর সমস্যার কথা বলে, নগরবাসী মধ্যবিত্তর সমস্যাকে হালকা করে দেখা উচিত না।

যাই হোক। যে মুহূর্তে রাষ্ট্র বুঝতে পারে, তাদের আধা সামন্ততান্ত্রিক, বেসরকারিকরণ নীতির ফলে দুর্বল হয়ে পড়া বিপর্যয় মোকাবিলা ব্যবস্থা দিয়ে উমপুনের মতো বিপর্যয়ের পর স্বাভাবিক নগরজীবন ফিরিয়ে আনা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। তখনই শাসক শ্রেণির মধ্যেকার দ্বন্দ্ব(তৃণমূল-বিজেপি)গৌণ হয়ে যায়। নগরবাসী ওপর তলার জনগণকে স্বস্তি দিতে মঞ্চে হাজির হয়ে যায় সেনাবাহিনী। যুদ্ধের প্রয়োজনেই, যাদের পেশাগত দক্ষতা যেকোনো রাষ্ট্রীয় এজেন্সির তুলনায় কয়েকগুণ এগিয়ে। যদিও সেটা নয়া ঔপনিবেশিক পেশাগত প্রশিক্ষণের হাত ধরেই। মজার ব্যাপার, গোটা দুনিয়া জানে, উমপুনে সবচেয়ে বিপর্যস্ত হয়েছেন সুন্দরবন ও পূর্ব মেদিনীপুরের মানুষ। কিন্তু পাঁচ কলাম সেনার চার কলামই নিয়োজিত কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। অন্যটিও প্রশাসনিক প্রয়োজনে ডায়মন্ডহারবারে।

এবার আসল সমস্যার কথা। এবার হয়তো মধ্যবিত্তকে রক্ষা করতে রাষ্ট্র সেনা নামিয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় না। দেশের মধ্যে সেনাবাহিনী যে যে কারণে মোতায়েন হয়ে থাকে, তার বেশিরভাগই গণ আন্দোলন দমনের জন্য। ইতিহাস তাই বলে। লকডাউন পরবর্তী দুনিয়ায় বেকারি, ছাঁটাইয়ের আঁচ মধ্যবিত্ত ইতিমধ্যেই পেতে শুরু করেছে। কেউ চাক বা না চাক, বেঁচে থাকার জন্য মধ্যবিত্তের একটা বড়ো অংশকে আগামী দিনে পথে নামতেই হবে। আর তখনই তারা দেখবেন, যে পুলিশ একদিন তাদের ফ্ল্যাটের সামনে গান গেয়েছিল, যে সামরিক বাহিনী একদিন তাদের জন্য গাছ কেটেছিল, রাষ্ট্রের নির্দেশে তারা তখন ন্যায্য দাবিদাওয়ার আন্দোলনে সামিল জনগণের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনছে। সে আন্দোলন সফল হতে হলে সার্বিক শোষিত জনগণের ঐক্য একান্ত জরুরি। মধ্যবিত্তর দূরবস্থা দেখে বুনিয়াদি জনগণ খুশি হলে, সে লড়াই সফল হওয়ার নয়। তাই লকডাউন ভাঙার জন্য যে সব মধ্যবিত্ত কিছুদিন আগে খেটে খাওয়া জনতাকে হেনস্থা করেছেন, তাদের ‘গুলি করে’ দেওয়ার নিদান হেঁকেছেন, তাদের এবার সত্যদর্শনের দিন আসছে।

মেহনতি মানুষ যদি তাদের রুটিরুজির লড়াইতে মধ্যবিত্তকে পাশে পান, তাহলেই তারা মধ্যবিত্তর সংকটে পাশে দাঁড়াবেন। গত তিরিশ বছরের উদারিকরণের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ভারতের শাসক শ্রেণি নীচের তলার মানুষের সঙ্গে মধ্যবিত্তর ব্যাপক দূরত্ব তৈরি করতে অনেকটাই সফল হয়েছে। মোদি-নির্মলা ঘোষিত সংস্কার কর্মসূচির হাত ধরে সেই দূরত্ব এবার কমে আসতে চলেছে। ‘অরাজনৈতিক’ মধ্যবিত্তর এবার রাজনৈতিক হওয়ার পালা। আজকের মেহনতি মানুষের রুটিরুজির সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজের অদূর ভবিষ্যতকে দেখার পালা।‘নগর পুড়লে দেবালয় বাঁচে না’- এ কথা বোঝার পালা।

না বুঝলে, নিজেদের অপরিণামদর্শীতায় বন্ধুদের শত্রু বানিয়ে ফেললে, কখন কী হয়ে যায়, কিচ্ছু বলা যায় না।              

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *