লকডাউনে কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা জনগণকে ত্রাণের মাধ্যমে সংগঠিত করার চেষ্টা করবে কিনা, এ নিয়ে কিছুদিন যাবত নানা মতামত ঘুরছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে এই পোর্টালে গত ১৪ মে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই কিছু ভিন্ন মত আমাদের নজরে এসেছে। তাই এ নিয়ে আরও একটি নিবন্ধ প্রকাশ করছি। এটিই শেষ। লকডাউন প্রায় শেষ পর্যায়ে। মোদি-নির্মলা দেশ বিক্রির শেষ ধাপটিও প্রায় সম্পূর্ণ করেছেন। আমাদের এবার রেশন দোকানের গণ্ডি ছেড়ে বেরোতে হবে বৈকি।
অবসান হোক বাস্তব পরিস্থিতির বাস্তব বিশ্লেষণ না করেই এই অতিমারির বিশেষ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের নেওয়া কোনো উদ্যোগ আর বিপ্লবী শক্তির সেই একই উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলাকে ডান পন্থী ঝোঁক বলে দাগিয়ে দেওয়ার। অবসান হোক লেগে পড়ে থেকে সংগ্রাম গড়ে তোলার কঠিন কাজ না করার মানসিকতার।
লকডাউনের শুরু দিকে এই রাজ্যের বেশ কিছু গ্রামীণ অঞ্চলে রাজ্য সরকারের তরফে শাসক দল কোয়ারান্টাইন সেন্টার গড়ার উদ্যোগ নিলে শাসক শ্রেণি্র আর এক অংশ ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিবাদী শক্তি এবং সংশোধনবাদীরা জনগণের পিছিয়ে থাকা চেতনাকে হাতিয়ার করে কোয়ারান্টাইন সেন্টার গড়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে – এখন প্রশ্ন বিপ্লবী শক্তি কি করেন্টাইন সেন্টার গড়ার স্বপক্ষে কথা বলবে নাকি রাজ্যের শাসক শ্রেণির স্বরে স্বর মিলে যাবার ভয়ে জনগণের পিছিয়ে থাকা চেতনার স্বরে সুর মেলাবে। বিপ্লবী শক্তি বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ করে কোয়ারান্টাইন সেন্টারের পক্ষেই অবস্থান নেয় এবং সংশোধনবাদীদের ‘অতিবামদের সাথে অতিডান’দের জোট এই অপবাদের তোয়াক্কা না করে কঠিন কাজটা বেছে নেয়, জনগণের কাছে যায়, লেগে পড়ে থাকে -কেন কোয়ারান্টাইন সেন্টার দরকার এটা বোঝানোর জন্য আর এলাকার শাসক গোষ্ঠীকে চাপ দেয় গোটা অঞ্চল স্যানিটাইজ করার জন্য। সংক্রমণ ছড়ালে আগে তা শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে বেশি ছড়াবে তাই তাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে শ্রমজীবী অংশকে বাঁচানো। তাদের কাছে সহজ কাজটা ছিল গ্রামীণ জনতার পিছিয়ে থাকা স্তর এবং তাদের চাহিদা অনুযায়ী কোয়ারান্টাইন সেন্টার গড়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা এবং পাদপ্রদীপের সামনে আসা। তাই ‘ডানপন্থী’ বলে দিয়ে বিপ্লবী মহলে থাকা কোনো বন্ধু যদি ‘শুধু গাছ দেখা অরণ্যকে না দেখা’ এই আধিবিদ্যক পদ্ধতিতে কোনো ঘটনাকে দেখে, তাহলে সে অতিমারি আর খাদ্য সঙ্কট দুটোকেই এক করে দেখার এই যান্ত্রিকতার শিকার হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
যেমন বলার অপেক্ষা রাখে না সিএএ বলতে কেউ যদি শুধু দেখে ২০০৩, ২০১৯ নয়। এই যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে এই উপলব্ধিতে পৌছে দেবে যে যারা এনআরসি-এনপিআর-সিএএ বিরোধী আন্দোলনের কথা বলছে তারা জনগণের সাথে অপরাধ করছে কারণ ‘সিএএ’ বললে হবে না বলতে হবে সিএএ ২০০৩।অতিমারিতে সংশোধনবাদীদের ভোট বাক্স ভরানোর জন্য ত্রাণ দেওয়া আর তরুণ বিপ্লবী কর্মীদের ত্রাণ দেওয়ার মধ্যেকার ফারাক, বিপ্লবী ছাত্রযুবর ‘ওয়ান টু ওয়ান’ পদ্ধতিতে যোগাযোগ বাড়ানোর মধ্যে দিয়ে আগামী দিনের জন্য সংগঠন গড়ে তুলে সংগ্রাম গড়ে তোলার কঠিন কষ্টসাধ্য পদ্ধতিকে উপলব্ধিতে না আনা আধিবিদ্যক দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা, যা প্রয়োগহীন তাত্ত্বিক কচকচানিরই জন্ম দেয়।
সঠিক বাম লাইন অনুশীলন করা অনেকটা সুতোর উপর দিয়ে হাঁটার মত, পা ফসকালে হয় দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদের খপ্পরে পড়তে হয় নতুবা অতিবাম বিচ্যুতি। বলার অপেক্ষা রাখে না দুটোই সংশোধনবাদ। একটা বিপ্লবী পরিস্থিতিকে কমিয়ে দেখে, আর একটা বাড়িয়ে, বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হয়। একটা শুধু ত্রাণ, ত্রাণ আর ত্রাণের মধ্যেই মুক্তি খোঁজে, আর একটা এখনই কিছু করতে হবে- এই মনোভাব থেকে তাড়াহুড়োবাদের শিকার হয়, আর তাড়াহুড়োবাদ ব্যক্তিসাতন্ত্রবাদের জন্ম দেয়, ব্যক্তিসাতন্ত্রবাদ জন্ম দেয় নৈরাজ্যবাদের। শ্রম আর পুঁজির দ্বন্দ্ব সব কারখানাতেই থাকে। কারখানাটা ছোটো না বড়ো এটা হিসাবের মধ্যে না রেখে শুধু শ্রম আর পুঁজির দ্বন্দ্ব মাথায় নিয়ে কেউ যদি ‘রাজনীতি যায় বাইরে থেকে’ যন্ত্রের মত মুখস্থ করে কোনো কারখানায় যায় সংগঠন গড়তে, সেখানে মুখ থুবড়ে পড়া ছাড়া তার আর কোনো গতি থাকে না। আধিবিদ্যক পদ্ধতিতে কেউ হাঁটতে শুরু করলে ২০২০-র ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে ঘটে চলা এনআরসি-এনপিআর-সিএএ বিরোধী সংগ্রামের যুব বিদ্রোহ সে কখনোই দেখতে পায়না, কারণ আধিবিদ্যক দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যাই হল যে তা যান্ত্রিকতায় ভরপুর।
হাঙ্গার রিপোর্ট অনুযায়ী ১০২তম দেশ ভারতবর্ষের সবথেকে পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোরঅন্যতম অন্ধ্র-ওড়িষা সীমান্তের বিপ্লবী শক্তি ‘খাদ্য আন্দোলনে’র ডাক না দিয়ে কেন রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করলো, তা উপলব্ধিতে না এনে যন্ত্রের মত দেখলে এটাকে দক্ষিণপন্থী ঝোঁক হিসাবেই চিহ্নিত করতে হয়। আর তারপর বাইরে থেকেই বিপ্লবী তত্ত্ব নিয়ে যেতে হয়। তবে চেয়ারম্যান মাও বলেছিলেন, দুটিই সংশোধনবাদ হলেও ডান বিচ্যুতির থেকে বাম বিচ্যুতি তুলনায় ভালো। কারণ সেই পথের পথিকদের সঠিক লাইনে আসার সম্ভাবনা থেকে যায়। সেই আশায় দিন গুনব, এই বিতর্ক আপাতত এখানেই বন্ধ করে।