Home খবর কেন্দ্রের শ্রমিকবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ২২মে প্রতিবাদ দিবস, কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির বিবৃতি

কেন্দ্রের শ্রমিকবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ২২মে প্রতিবাদ দিবস, কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির বিবৃতি

কেন্দ্রের শ্রমিকবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ২২মে প্রতিবাদ দিবস, কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির বিবৃতি
0

দেশের বেশিরভাগ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোই শ্রমিক শ্রেণিকে অর্থনীতিবাদী আন্দোলনের পরিধিতে আটকে রাখতে চায়। অনেক সময়ই তাদের কর্মসূচিগুলি শ্রমিক শ্রেণিকে জঙ্গি আন্দোলনের পথে হাঁটতে বাধা দেয়। কিন্তু আমরা মনে করি লড়াইয়ের ময়দানে শ্রমিকদের শ্রেণিগত ঐক্য জরুরি। আর এই সময় এই ধরনের কর্মসূচির পথ ধরে এগোনো খুবই দরকার। তাই এই বিবৃতিটির বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করলাম।

দেশজোড়া লকডাউনে কঠিন সমস্যায় পড়েছে শ্রমজীবী মানুষ। এই পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য গত ১৪ মে এক বৈঠকে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির যৌথ মঞ্চ, যৌথ কর্মসূচি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।   

কোভিড১৯ অতিমারির সুযোগ নিয়ে প্রতিদিন কেন্দ্রীয় সরকার লকডাউনে ধাক্কায় ইতিমধ্যেই বিধ্বস্ত শ্রমিক শ্রেণি ও সাধারণ মানুষের ওপর নতুন নতুন আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

ট্রেড ইউনিয়নগুলি একক ও যৌথ ভাবে বহুবার প্রধানমন্ত্রী ও শ্রমমন্ত্রীকে এই বিষয়গুলি জানিয়েছে। পাশাপাশি সরকারের নির্দেশ/পরামর্শ অনুযায়ী লকডাউনের সময় শ্রমিকদের পূর্ণ বেতন দেওয়া কাজ থেকে না ছাড়ানোর কথাও যে বহু সংস্থা মানছে না, সে ব্যাপারেও তাদের অবহিত করা হয়েছে।  

একই ভাবে বলা যায়, রেশন বণ্টন, মহিলা ও প্রবীণদের হাতে সরাসরি টাকা পৌঁছে দেওয়ার যে ঘোষণা সরকার করেছিল, তা বেশিরভাগ মানুষের কাছে পৌঁছয়নি।

চাকরি চলে যাওয়া, মাইনে না পাওয়া, বাড়ি থেকে উচ্ছেদ- প্রভৃতি নানা কারণে শ্রমজীবী মানুষ ৪৮ দিনের লকডাউনে অমানবিক ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন। ক্ষুধার যন্ত্রণা তাদের মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রাসী শ্রমিকবিরোধী নীতিগুলি তাদের কার্যত দাসে পরিণত হওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।  

পরিযায়ী শ্রমিকরা মরিয়া হয়ে রাস্তা, রেললাইন, মাঠ, জঙ্গল দিয়ে শত শত মাইল হাঁটছেন ঘরে ফেরার জন্য। খিদে, ক্লান্তি ও দুর্ঘটনায় বহু মূল্যবান প্রাণ প্রতিদিন ঝরে যাচ্ছে।

তিনদফা লকডাউনের পরেও সরকারের যাবতীয় ঘোষণা(১৪মের সাম্প্রতিকতম ঘোষণাটি সহ)দুর্ভোগ ও দুর্দশায় ডুবে থাকা সাধারণ মানুষ ও শ্রমিকদের যন্ত্রণার একটুও উপশম ঘটাতে পারেনি। সরকারের বড়ো বড়ো কথা ও দাবির সঙ্গে বাস্তবের কোনো সম্পর্ক নেই। অধিকাংশ জনগণের জীবনযন্ত্রণার ব্যাপারে এই সরকার যে কতটা অসংবেদনশীল, এর থেকেই তা বোঝা যায়। এখন কেন্দ্রীয় সরকার দীর্ঘ লকডাউনের সুযোগ নিয়ে অত্যন্ত সন্দেহজনক ভাবে শ্রম আইন বিলোপ করে শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়নগুলির অধিকার কেড়ে নেওয়ায় নজর দিয়েছে।

তারা তাদের অনুগত রাজ্য সরকারগুলিকে শ্রমিকবিরোধী ও জনবিরোধী কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করছে এবং অন্যান্য বেশ কিছু সরকারকে শ্রমিকদের অধিকার ও জীবনজীবিকার বিরোধী পথে হাঁটতে চাপ দিচ্ছে। কেন্দ্রের শ্রম ও নিয়োগ মন্ত্রক থেকে ওই রাজ্য সরকারগুলির কাছে এই মর্মে বারবার ‘পরামর্শ’ পাঠানো হচ্ছে।

উত্তরপ্রদেশ সরকার অর্থনৈতিক কাজকর্মকে উৎসাহিত করার নামে ‘উত্তর প্রদেশ কিছু শ্রম আইন অস্থায়ী মকুব অধ্যাদেশ, ২০২০’ নামে একটি দানবীয় অধ্যাদেশ জারি করেছে। কলমের এক খোঁচায় ৩৮টি আইন ১০০০ দিনের(প্রায় তিন বছর) জন্য বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। কার্যকর আছে শুধু মজুরি প্রদান আইন, ১৯৩৪-এর ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ, নির্মাণ শ্রমিক আইন ১৯৯৬, ক্ষতিপূরণ আইন ১৯৯৩ ও অঙ্গীকারবদ্ধ শ্রমিক আইন ১৯৭৬। যেগুলি বিলুপ্ত করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ট্রেড ইউনিয়ন আইন, শিল্পক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব আইন, পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক আইন, চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক আইন, সম বেতন আইন, মাতৃত্বকালীন সুবিধা আইন ইত্যাদি।     

মধ্যপ্রদেশ সরকার কারখানা আইন, চুক্তি আইন এবং শিল্পক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব আইনে ব্যাপক পরিবর্তন করেছে যাতে নিয়োগকর্তারা যখন খুশি শ্রমিকদের কাজে লাগাতে বা তাড়াতে পারেন। মালিক পক্ষের সঙ্গে বিতর্কে জড়ানো ও অভিযোগের প্রতিকার চাওয়ার অধিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ৪৯জন পর্যন্ত শ্রমিক সরবরাহ করার জন্য ঠিকেদারদের কোনো লাইসেন্স লাগবে না অর্থাত তাদের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। নজরদারি কার্যত তুলে নেওয়া হয়েছে এবং এনফোর্সমেন্ট ব্যবস্থাকে ঠান্ডাঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে যাবতীয় আইন এবং মজুরি, ক্ষতিপূরণ, নিরাপত্তা সংক্রান্ত শ্রমিকদের যাবতীয় অধিকার কার্যত পুরোপুরি অর্থহীন হয়ে গেছে।

শুধু তাই নয়, এতদিন নিয়োগকারীদের, মধ্যপ্রদেশ শ্রমিক কল্যাণ বোর্ডকে শ্রমিক পিছু ৮০ টাকা করে দিতে হত, তা থেকেও এবার ছাড় দেওয়া হল। মধ্যপ্রদেশ সরকার শপ অ্‌যান্ড এসটাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট-কে সংশোধন করেছে যাতে সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত টানা ১৮ ঘণ্টা কোনো দোকান খুলে রাখা যায়।    

গুজরাট সরকারও কাজের সময় ৮ ঘণ্টা থেকে বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করার বেআইনি সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং উত্তরপ্রদেশ সরকারের মতো তারাও বেশ কিছু আইন ১২০০ দিনের জন্য বাতিল করে দিয়েছে। অসম, ত্রিপুরা এবং আরও কিছু সরকার একই পথে হাঁটার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এর আগে কারখানা আইনকে উড়িয়ে দিয়ে লকডাউনকে কাজে লাগিয়ে গুজরাট, হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানা, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, বিহার এবং পঞ্জাবের মতো ৮টি রাজ্য এর আগে কাজের সময় ৮ ঘণ্টা থেকে বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করার নির্দেশ দিয়েছিল। বর্তমান শ্রমিক বিরোধী পদক্ষেপগুলো তার দ্বিতীয় পর্যায়।

এই দানবীয় পদক্ষেপগুলো শুধুই শ্রমিকদের যৌথ ভাবে দড়াদড়ি করার অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের ওপর আরও নিষ্ঠুর শোষণ নামিয়ে আনা, যথাযথ মজুরির দাবিতে সংগ্রাম করা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা কেড়ে নেওয়ার জন্য নয় পাশাপাশি তাদের দাসে পরিণত করার জন্যও বটে। যাতে তাদের শোষণ করে ক্রমবর্ধ্বমান আর্থিক মন্দার মধ্যেও মুনাফা বাড়াতে পারে মালিকপক্ষ। এর ফলে মহিলা ও অন্যান্য দুর্বল অংশের শ্রমিকদের ওপর বলপ্রয়োগ করে অনেক বেশি শোষণ করা যাবে।

এ সব কিছুর অর্থ হল, শ্রমিকদের সব অধিকার কেড়ে নিয়ে, তাদের মজুরির নিশ্চয়তা, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা সবচেয়ে বড়ো কথা মানুষের মর্যাদাটুকুও না দিয়ে পুঁজির স্বার্থে তাদের অঙ্গীকারবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগানোর জন্য শোষণ করা হবে, তাদের ঘামরক্তকে ব্যবহার করে মুনাফা বাড়াবে পুঁজিপতিরা। এটা মানবাধিকারের বুনিয়াদি শর্তের বিরোধী।    

ভারতের শ্রমিক শ্রেণিকে ব্রিটিশ আমলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এইসব শয়তানি নকশাকে মেনে নেবে না, শ্রমিকবিরোধী জনবিরোধী কর্মসূচিকে পরাজিত করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে যৌথ ভাবে এর মোকাবিলা করবে। শ্রমি আইনের বর্তমান পরিবর্তনগুলো সেই কর্মসূচিরই অঙ্গ। শ্রমিকদের দাসে পরিণত করার এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আগামী দিনে আমাদের দেশজুড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

আমরা খুশি যে ইতিমধ্যেই বহু শ্রমিক এবং ট্রেড ইউনিয়ন বিভিন্ন রাজ্যে ও শিল্পে যৌথ ভাবে এই নিষ্ঠুর ও দানবীয় জনবিরোধী, শ্রমিকবিরোধী পক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করেছেন। এর থেকে শ্রমজীবীদের লড়াকু মেজাজ টের পাওয়া যাচ্ছে।        
এই অবস্থায়, শুরুতে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির যৌথ মঞ্চ আগামী ২২ মে দিনটিকে #দেশব্যাপী #প্রতিবাদ #দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ট্রেড ইউনিয়নগুলির জাতীয় স্তরের নেতৃত্ব ওই দিন দিল্লির রাজঘাটের গান্ধী সমাধিতে সারাদিন অনশন ধর্মঘট করবেন। একই ভাবে বিভিন্ন রাজ্যেও প্রতিবাদ কর্মসূচি চলবে। বিভিন্ন ইউনিয়ন ও সদস্যদের তরফ থেকে লক্ষ লক্ষ দাবিসনদ সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে।

আমাদের দাবিগুলির মধ্যে রয়েছে- আটকে পড়া শ্রমিকদের এখনই ফেরার ব্যবস্থা করা, সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে, সর্বজনীন রেশন ব্যবস্থা, লকডাউনের সময়কালের জন্য সকলের মজুরি নিশ্চিত করা, সকল অসংগঠিত শ্রমিকদের কাছে নগদ পৌঁছে দেওয়া(নথিভুক্ত বা অনথিভুক্ত বা স্বনির্ভর), কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘভাতা ফ্রিড করে রাখা চলবে না, পেনশনারদের ডিয়ারনেস রিলিফ ফ্রিজ করে রাখা চলবে না, অনুমোদিত পদ তুলে দেওয়া বন্ধ কর।

এর মধ্যে বিভিন্ন রাজ্য ও বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে চলমান আন্দোলনকে তীব্র করতে হবে। শ্রমিকদের কষ্টার্জিত অধিকার কেড়ে নিয়ে পেছন দিকে হাঁটার যে প্রয়াস সরকারের তরফে শুরু হয়েছে, তাকে থামানোর জন্য দৃঢ়চিত্তে যৌথ সংগ্রামকে আরও উচ্চতায় তুলে নিয়ে যেতে হবে। এর জন্য আগামী দিনে দেশজোড়া ধর্মঘটও করতে হবে।      

ভারত সরকার আন্তর্জাতিক পরিসরে শ্রমিকদের সুযোগসুবিধা ও মানবাধিকার রক্ষায় যেসব অঙ্গীকার করে রেখেছে, সেগুলির তারা উল্লঙ্ঘন করছে। এই কারণে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনে(আইএলও) যৌথ প্রতিনিধিদল পাঠাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির যৌথ মঞ্চ ও ফেডারেশন দেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবসের কর্মসূচিকে গোটা দেশে ব্যাপক ভাবে সফল করার আহ্বান জানাচ্ছে। পাশাপাশি শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ও সামাজিক সংহতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরারও ডাক দিচ্ছে।

আইএনটিইউসি, এআইটিইউসি, এইচএমএস, সিআইটিইউ, টিইউসিসি, এআইসিসিটিইউ,এলপিএফ, ইউটিইউসি, এসইডব্লিউএ,  এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনগুলি।

শনিবার, ১৬ মে, ২০২০

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *