অয়ন ব্যানার্জি ও প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী
২০১৯-২০ সালে ভারতে ২৯১.৯৫ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে। যা রেকর্ড।২০০০ সালে দেশে বার্ষিক খাদ্যশস্যের চাহিদা ছিল ২০১ মিলিয়ন টন। ২০২৫-এ তা হবে সম্ভবত ২৯১ মিলিয়ন টন, ২০৫০-এ ৩৭৭…এ সব সরকারি তথ্য। ইউনিসেফের নথি অনুযায়ীও ভারত খাদ্যে স্বয়ম্ভর। সকলে পরিমাণ ও গুণগত ভাবে পর্যাপ্ত খাদ্য পান না, সেসবের কারণ অবশ্য আলাদা। আমরা কমবেশি জানি, বুঝি।
আরও নানারকম তথ্য দেওয়া যায়। যেমন পশ্চিমবঙ্গে খাদ্যশস্য উৎপাদন কেমন হয়, কতটা সঞ্চয় আছে। আরও পিছিয়ে দেখা যায়, ১৯৫৯ ও ১৯৬৫ সালে খাদ্য আন্দোলনের সময় রাজ্য ও দেশের খাদ্যশস্য উৎপাদন কেমন ছিল। গণবণ্টন ব্যবস্থা কেমন ছিল। আর সে সময়কার মজুতদারির তথ্য তো ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে, আন্দোলনের বিবরণের মতোই।
কিন্তু সে সব লেখার জন্য এই নিবন্ধ নয়। গুগুল করলেই চলে আজকের দিনে। কিন্তু গুগুলে তথ্যের ঝুলি ভরে, চিন্তার ধোঁয়াশা কাটে না। আর সে চিন্তা যদি অর্থনীতিবাদ ও বাম অ্যাডভেঞ্চারিজমের অ্স্বাস্থ্যকর ককটেল হয়, তাহলে তো আরওই নয়।
বস্তুত, লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই বহু বামপন্থী তরুণ কর্মীই আস্তিন গোটাচ্ছিলেন আসন্ন ‘খাদ্য আন্দোলন’-এ অংশগ্রহণ করার জন্য। কারণ তারা এতদিন শুধু গত শতকের ছয়ের দশকের খাদ্য আন্দোলনের গল্প শুনেছেন কিংবা পড়েছেন। যাদের বয়স একটু বেশি, ২০০৭ সালে রাজ্য জুড়ে ‘রেশন রায়ট’ দেখেছেন। সত্য বলতে কি, জনগণের ভালোমন্দ নিয়ে মাথা ঘামানোয় ভারত রাষ্ট্রের যা ট্র্যাক রেকর্ড, তাতে করোনা-অতিমারির মধ্যে গরিব মানুষকে যে রেশন দোকান কিংবা ফুড কর্পোরেশনের গুদাম লুঠ করতে হবে, এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়াটা স্বাভাবিকই ছিল।
কিন্তু ইতিউতি কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া তেমন কিছু হয়নি। আর সেটা না হওয়ায় অনেকেরই মন খারাপ। কেউ কেউ একটু রেগে গিয়ে ভাবছেন বিপ্লবী বা সামগ্রিক ভাবে বামপন্থী সংগঠনগুলির দুর্বলতার জন্য এরকম কিছু হয়ে উঠল না। লকডাউন উঠে যাওয়ার পথে। অতএব বড়ো একটা রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনের সুযোগ হাতছাড়া হল।
আসলে গলদটা বিসমিল্লায়। কোনো বস্তু বা ঘটনার বিকাশের মূল কারণটা নিহিত থাকে, তার ভেতরে। বাইরের শর্তটা সেখানে গৌণ। গত শতকের খাদ্য আন্দোলনের সময় খাদ্যশস্য উৎপাদনে গোটা দেশের মতো পশ্চিমবঙ্গও ছিল চাহিদার তুলনায় অনেক পেছনে। এ রাজ্যের সমস্যাটা কিছু বেশি ছিল, কারণ দেশভাগের কারণে এখানে জনসংখ্যার চাপও ব্যাপক বেড়ে গেছিল। এই সুযোগটা নিয়েছিল মজুতদার ও কালোবাজারিরা। তাদের সঙ্গে সরকারি রাজনৈতিক নেতাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। ফলে জনগণ পেটের দায়ে পথে নেমে পড়েছিলেন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন। বামপন্থীরা স্বাভাবিক ভাবেই আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন।
বর্তমান লকডাউনে যদি তেমন পরিস্থিতি থাকত তাহলে কি বিপ্লবী বামপন্থীরা তৃণমূলের পাড়ার নেতাদের সঙ্গে দ্ব্ন্দ্বে জড়াতে ভয় পাচ্ছে বলে ক্ষুধার্ত জনগণ চুপ করে বসে থাকত? মার্কসবাদের যারা অআকখ-টুকুও পড়েছেন, তাদের পক্ষে কি এমন সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব? যদি ধরেও নেওয়া যায়, পশ্চিমবঙ্গের বিপ্লবী শক্তি সংস্কারবাদের গাড্ডায় ডুবে গেছে, অন্য বামপন্থীদের অবস্থা কহতব্য নয়, তৃণমূলের সন্ত্রাসে বিজেপি-ও লুকিয়ে পড়েছে, জনগণ রোগের ভয়ে নীরব অথবা সরকারি অপদার্থতার ত্রুটি পুঁজিপতি ও মধ্যবিত্তরা ত্রাণ দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। তাহলে গোটা ভারতের দিকে তাকানো যাক। গত দুমাসে গোটা দেশের কোথাওই কিন্তু বড়ো খাদ্য বিক্ষোভের(পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা বাদ দিয়ে) খবর হয়নি। কেন? প্রাথমিক তথ্যটা লেখার শুরুতে দেওয়া হয়েছে। অন্য যেটা বোঝা যাচ্ছে, তা হল রাষ্ট্র তার সরবরাহ ব্যবস্থাকে মোটামুটি সেজে নিয়েছে গত ষাট বছরে। ঘোষণা মতো এপ্রিল থেকে না হলেও কিছুদিনের মধ্যেই রাজ্যে রাজ্যে প্রতিশ্রুত চাল পৌঁছতে শুরু করেছে। মজুতদাররাও কোথাও তেমন ভাবে সক্রিয় হতে পারেনি। ব্যাতিক্রমী ঘটনা নিশ্চয় আছে। সে সব জায়গায় বিক্ষোভ, ডেপুটেশন, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ- সবই হয়েছে, হওয়াই উচিত। কিন্তু সেটা রাজ্যের বা দেশের বিশালতার তুলনায় নগণ্য। লকডাউন পর্যায়ে সরকারি গণবণ্টন ব্যবস্থার বাইরেও যে মজুতদারির সমস্যা সেভাবে হয়নি, তার বড়ো চিহ্ন হল, বিপুল ত্রাণের উদ্যোগ। দেশজুড়ে রাজনৈতিক দল, অসরকারি সংগঠন এবং অন্যান্য জনদরদী শক্তির উদ্যোগে যে সব ত্রাণশিবির এখনও চালানো হচ্ছে, তার কোনোটাই বাজারে খাদ্যশস্য না মেলায় থমকে গেছে, এমন কোনো খবর নেই।
অবশ্যই এর কারণ লুকিয়ে আছে গত শতকের খাদ্য আন্দোলন ও ২০০৭-এর রেশন-বিক্ষোভের মধ্যে। সঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে নকশালবাড়ির আন্দোলনের কথা। যার পর ভারতে ‘কিছুই আর আগের মতো থাকেনি’। নকশালবাড়ির পরই আধা সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোকে বজায় রেখেই রাষ্ট্র ‘খাদ্য-স্বনির্ভর’ হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। যার পিছনে আছে সাম্রাজ্যবাদী সবুজ বিপ্লব, ভূমিসংস্কারের কর্মসূচি। একদিকে খাদ্য স্বনির্ভরতার নামে উচ্চ ফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক সহ আনুষঙ্গিক কৃষি প্রযুক্তির বাজার তৈরির উদ্দেশ্যে এদেশে সবুজ বিপ্লব রফতানি করে রকফেলার, ফোর্ড, কেলগ প্রভৃতি আমেরিকার বড়ো বড়ো অধিজাতিক সংস্থা। আর অন্যদিকে সীমিত ভূমি সংস্কারের কিছু আইন পাশ করা শুধু নয়, সেই আইনের বাস্তবায়ন। আর রাষ্ট্র তার আধা সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণি চরিত্রের পরিবর্তন না ঘটিয়েই এই সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করে লাল বিপ্লব থেকে বাঁচতে(যার সাথে কৃষি বিপ্লব বা আমূল ভূমি সংস্কারের সম্পর্ক নেই)। সিপিএমের মতো অর্থনীতিবাদী-সংশোধনবাদী দল এ রাজ্যে ভূমি সংস্কার করেছে। অন্যত্র ভূমি সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করেছে। এই আন্দোলনের জন্য তাদের কোনো নেতাকে রাষ্ট্রবিরোধিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়নি। কারণ সরকারের ঠিক করে দেওয়া প্রাপ্যর জন্য আন্দোলনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হোক, শাসক শ্রেণি এমনটা চায় না। এটা তাদের কাছে বাড়তি ঝামেলা। রেশনে নিখরচায় সকলকে ৫ কিলো চাল দেওয়া হবে, এটা রাজ্য সরকারি ঘোষণা। এটা যদি ব্যাপক মানুষ না পেত, তাহলে পরিস্থিতি শান্ত থাকতো না।
প্রশ্ন, তাহলে ত্রাণ দিতে হচ্ছে কেন? কারণ একাধিক। প্রথমত সব মানুষের রেশন কার্ড নেই। দ্বিতীয়ত, শহুরে সর্বহারাদের একাংশের রেশন কার্ড গ্রামের বাড়িতে থাকে। তৃতীয়ত, চাল, গম মানুষ চিবিয়ে খায়না। রান্না করতে হয়। উপার্জন না থাকায় রান্নার বন্দোবস্ত করতে বহু মানুষ পারছে না। সরকারি খাদ্যের অধিকারের মধ্যে খাদ্যশস্য পাওয়ার অধিকারটুকুই মূলত স্বীকৃত। বাকিটা নয়। সেটা কিন্তু আইনি দৃষ্টিভঙ্গির বাইরের বিষয়। অধিকারের নতুন সংজ্ঞা নির্মাণের প্রশ্ন। গরিব মানুষের হাতে পয়সা না থাকায় তারা খুবই সমস্যায় পড়েছেন নিশ্চয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটা একটা নতুন পরিস্থিতি। এখানে অতিমারির ভয় মানুষকে কিছুটা নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে। রাষ্ট্রের যেখানে উচিত ছিল বড়োলোকদের ওপর কর চাপিয়ে জনগণের হাতে টাকা দেওয়া, সেখানে তাদের শ্রেণিচরিত্র অনুযায়ী রোগের ভয় দেখিয়ে কাজ সেরেছে। সেটা কাজে দিয়েছে স্বল্পমেয়াদে। সবচেয়ে বড়ো কথা ভারতের মতো আধা সামন্ততান্ত্রিক দেশে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ স্বাভাবিক অবস্থাতেই অত্যন্ত দুর্দশার মধ্যে জীবন কাটান। লকডাউন তাদের দুর্দশায় পরিমাণগত পরিবর্তন আনলেও কোনো গুণগত পরিবর্তন এনেছে কিনা, সেটা ভাবা দরকার। শুধু তাদের নয়, লকডাউন পর্যায়ে খাদ্য সুরক্ষার প্রশ্নে কোনো শ্রেণির অবস্থাতেই কি গুণগত পরিবর্তন হয়েছে? তা যাতে না হয়, সে জন্য রাষ্ট্র প্রথম থেকেই সক্রিয় ছিল। শুরু থেকেই দেশের কৃষিনির্ভর ২০০টি জেলাকে গ্রিন জোন বানিয়ে রেখে কৃষিকাজ স্বাভাবিক ভাবে চালিয়ে যাওয়া হয়েছে। সামগ্রিক ভাবেই কৃষক বিদ্রোহের ভয়ে কৃষিকাজ থামানো হয়নি। লকডাউনের ২৮দিন পর থেকেই অর্থনৈতিক কাজকর্ম অল্প করে শুরু করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাত এই অবস্থা অস্থায়ী- এটা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কলকাতার মতো রেড জোনে রিক্সার মতো গণ পরিবহণ একদিনও বন্ধ হয়নি। অর্থাত এই দরিদ্র মানুষগুলোকে খাওয়ানোর চাপ রাষ্ট্র নেয়নি।
ত্রাণ অনেকেই দেন। যারা সমাজ পরিবর্তন করতে চান, তাদের কাজ মানুষকে ত্রাণ দিয়ে সাহায্য করার প্রক্রিয়ায় নতুন মেহনতি জনতার কাছে পৌঁছনো। নিত্যনতুন যোগাযোগ তৈরি এবং রাজনীতি পৌঁছে দেওয়া ও সংগঠিত করা। সেই সংগঠিত করার প্রক্রিয়ায় ডেপুটেশন, বিক্ষোভ, ধরনা থাকবে নিশ্চয়। প্রয়োজনে তা জঙ্গি রূপও নিতে পারে। কিন্তু সে্সব তো সংশোধনবাদীরাও করে। বিপ্লবীরা তৈরি করবেন এমন গুণগত মানের সম্পর্ক, যা দীর্ঘস্থায়ী হবে। কমিউনিস্ট বিপ্লবী রাজনীতির আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সাংগঠনিক নীতি এবং অভিজ্ঞতায়, সেটা একের সঙ্গে একের কথার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে। তার জন্য, লেনিনের কথায় ‘মার্কিনিদের মতো সেলসম্যান’ হওয়া প্রয়োজন। সঙ্গে থাকা দরকার ‘বলশেভিক জিল’।
বস্তুত, গত শতকের খাদ্য আন্দোলনের সময় রাজ্য তথা দেশের মাটিতে কোনো বিপ্লবী পার্টি তার বিপ্লবী লাইন নিয়ে হাজির ছিল না। বহু স্বতস্ফূর্ত লড়াই, জনগণের বহু আত্মত্যাগের অভিজ্ঞতাকে সংশ্লেষ করেই ১৯৬৯ সালে তৈরি হয়েছিল সিপিআইএমএল। তারপর সে পার্টি অনেক ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে এগিয়েছে। সেটা অন্য কথা। কিন্তু যেটা মাথায় রাখা দরকার, তা হল, কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা অবশ্যই যে কোনো পরিস্থিতিকে সমাজ বদলের লড়াইয়ের লক্ষ্যে কাজে লাগাবেন। তারা বাস্তব পরিস্থিতির বাস্তব বিশ্লেষণ করবেন।পুরনো ধরনের আন্দোলনকে তারা বীরত্ব দেখানোর জন্য রিপিট করবেন না। খাদ্যের অধিকারের জন্য তারা জনগণকে অবশ্যই সচেতন করবেন কিন্তু অর্থনীতিবাদী আন্দোলনের বদ্ধজলায় তারা জনগণকে পড়তে দেবেন না। তাতে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের ক্যারিশ্মা বাড়লেও সমাজ বদলের লড়াইয়ে কোনো অগ্রগতি হয় না। তারা জনগণের অগ্রণী অংশকে বৃহত্তর সত্যের দিকে এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। সেই সমাজের স্বপ্ন দেখাবেন, যেখানে কোভিডের মতো মহামারি হলে চিকিৎসকের দল প্রথমেই যাবেন সব মেহনতি মানুষের মহল্লায়। তাদের জীবনযাপনে যাতে ন্যূনতম সমস্যা না হয়, তার দেখভাল করবে রাষ্ট্র। সেই সত্যের পথে নতুন মানুষকে যুক্ত করার সাংগঠনিক কাজ তারা সাফল্যের সঙ্গে করতে পারছেন কিনা, তা বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মীরা বলতে পারবেন। আর আমরা আগামী দিনে দেখতে পাব।
অতএব রেশন দোকান ভাঙচুর বা এফসিআই-এর গুদাম লুঠের মনোগত বাসনা যাদের ছিল, তারা শান্ত হন। নস্ট্যালজিয়া ও জঙ্গি অর্থনীতিবাদী আন্দোলনের হিরোইজম কাটিয়ে উঠুন। ওসব পুরনো হয়ে গেছে।