শুধু কোভিড নয়, সংক্রমণ ছড়িয়েছে শ্রেণি সংগ্রামেরও- ইতালির কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের বিস্তারিত রিপোর্ট
গত ১ মে এই রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে ইতালির মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি। করোনা অতিমারিতে বিপর্যন্ত সে দেশের উত্তরাংশ। তার মধ্যে শ্রমিকদের সুরক্ষার স্বার্থে শ্রেণি সংগ্রাম তীব্র আকার নিয়েছে সে দেশে। ভারতবর্ষ ইতালির মতো উন্নত পুঁজিবাদী দেশ না হলেও, সেখানকার অভিজ্ঞতা ভারতের বিপ্লবী কমিউনিস্ট রাজনৈতিক কর্মীদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত হলে তা শ্রেণি সংগ্রামের অগ্রগতির সহায়ক হবে এবং বিপর্যস্ত জনগণকে উৎসাহিত করবে বলে আমরা মনে করছি। তাই ওই রিপোর্টের ভাবানুবাদ প্রকাশ করলাম।
ইতালিতে আমরা দেড় মাসেরও বেশি সময় অতিমারির জন্য জরুরি অবস্থার মধ্যে রয়েছি। লোম্বার্ডি অঞ্চলের মিলান শহর থেকে(যেটা ইতালির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর)এই অতিমারি শুরু হয়। লোম্বার্ডিতেই রয়েছে ইতালির সবচেয়ে বড়ো দুটি শিল্প শহর। বারগেমো ও ব্রেসিয়া। বারগেমো করোনা অতিমারিতে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বিপর্যস্ত শহর।
দেশের উত্তরাংশের আরও বেশ কয়েকটি শহর অতিমারিতে ধাক্কা খেয়েছে। সেগুলির সবকটাতেই প্রচুর বড়ো মাপের শিল্প রয়েছে। এছাড়া ছোটো ও মাঝারি মাপের কলকারখানার শহরগুলিও বাদ যায়নি। পিয়াসেনজা, মোদেনা তাদের মধ্যে অন্যতম।
এই অঞ্চালগুলি বাদে দেশের মধ্যাঞ্চল এবং রাজধানী রোমে করোনার প্রভাব খুবই কম। তবে দক্ষিণাংশের নেপলস, পুগলিয়া, তারান্তো এবং সিসিলিতেও অতিমারির প্রভাব পড়েছে।
আরও পড়ুন: আমেরিকায় অতিমারির ভরকেন্দ্র নিউইয়র্কে মে দিবসে শ্রমিকদের প্রতিবাদ, ছবি, ভিডিও
আমাদের পার্টি এবং গণসংগঠনগুলি শুরু থেকেই শ্রমিক শ্রেণি ও জনগণকে শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সংগঠিত করে। যেসব সন্ত্রাস ও আতঙ্ক সৃষ্টিকারী তথ্য জনগণের মধ্যে অন্ধ ভীতি তৈরি করছিল এবং তাদের ঘরের মধ্যে আটকে দিচ্ছিল, সেগুলির বিরোধিতা করি। সে সময় মানুষ বুঝতে পারছিল না কী হচ্ছে এবং কী করতে হবে।
এই শুরুর পর্যায়েই এসে পড়ে ৮ মার্চ(আন্তর্জাতিক নারী দিবস)। ইতালির মধ্যবিত্ত ও মাঝারি বুর্জোয়া নারীবাদীদের যৌথ মঞ্চ ‘নো ওয়ান লেস’ মহিলাদের জমায়েত ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের কর্মসূচি থেকে পিছিয়ে যায়। সে সময় উত্তর ইতালির কিছু অঞ্চল বাদে বুর্জোয়ারা ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেনি। ফলে এদেশের অন্যান্য অংশে জমায়েত ও বিক্ষোভ প্রদর্শন সম্ভব ছিল। কিন্তু বুর্জোয়া ও পাতি বুর্জোয়া নারীবাদী আন্দোলনকারীরা বুনিয়াদি ইউনিয়নগুলির মতোই তাদের কর্মসূচি বাতিল করে।
এসএলএআই কোবাস ফল দ্য ক্লাস ইউনিয়ন(মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সংগ্রামী শ্রেণি সংগঠন)-এর সমর্থনে রেভলিউশনারি প্রোলেতারিয়ান ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট(এমএফপিআর)সে সময় একদিকে কিছু শ্রমিক ধর্মঘট কার্যকর করা এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করার পরিকল্পনা করে, পাশাপাশি সমস্ত কর্মসূচিকে দক্ষিণ ইতালিতে সীমিত রাখার পরামর্শ দেয়। কারণ সেখানে রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে ওই কর্মসূচি পালনের মতো অবস্থা ছিল। ৮ মার্চের আগের দিন সরকার গোটা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে এবং ধর্মঘট ও বিক্ষোভ কর্মসূচি বাতিল করার জন্য চাপ দেয়।
বিশেষত পালেরমোয় পুলিশ ও প্রশাসন সরাসরি কর্মসূচি বাতিলের জন্য চাপ দেয় কিন্তু কমরেডরা চাপের মোকাবিলা করে কর্মসূচি চালিয়ে যান।কিছু জায়গায় কোণঠাসা শ্রমিকরা ধর্মঘট করেন, প্রশাসনের সদর দফতরের সামনে বিক্ষোভও প্রদর্শন করা হয়। জনগণের অংশগ্রহণ স্বাভাবিক পরিস্থিতির তুলনায় কম হলেও খুব একটা কম ছিল না।
তারান্তোয় ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে নারী কর্মচারীদের একটি কর্মসূচি ছিল। কিন্তু রাস্তায় জমায়েতে দেখা যায় পাতি বুর্জোয়া নারীবাদীদের বেশিরভাগই অনুপস্থিত। অন্যদিকে একটি ছোটো নয়া সংশোধনবাদী পার্টির যুব সংগঠনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
উত্তর ইতালিতে, বিশেষত বারগেমোয়(সেই শহরটি তখনও অতিমারির ভরকেন্দ্রে পরিণত হয়নি)শ্রমিকরা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কারখানার বসদের, সরকারের এবং সরকারি ইউনিয়নগুলির তীব্র প্রতিক্রিয়ার সামনে পড়ে।
যাইহোক, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সর্বহারা নারীদের বিপ্লবী সংগ্রামের পতাকা ছিল উড্ডীন। পরবর্তী সপ্তাহগুলিতেও সেই পতাকা উজ্জ্বল হয়ে থেকেছে। অতিমারি ও জরুরি অবস্থায় মহিলাদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়। শুধু কর্মস্থলে নয়, বসতি অঞ্চল এবং ঘরেও। কারণ সেখানে সমস্যা অত্যন্ত জটিল। স্কুল বন্ধ, তাই বাচ্চারা ঘরে থাকছে। পারিবারিক অত্যাচারের ফলে বাড়িটা জেলখানায় এবং নারীহত্যার করার উপযোগী স্থানে পরিণত হয়েছে। পিতৃতন্ত্রের চিরকালীন উপস্থিতিই এর কারণ। এমএফপিআর এই সংগ্রামে কার্যত সরাসরি অংশ নেয় এবং মেয়েদের মধ্যে বিদ্রোহের উদ্দীপনা তৈরি করে এবং বিদ্রোহ করতে সাহায্য করে।
এর মধ্যে উত্তর ইতালির মূল শিল্পাঞ্চলে অতিমারি ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিকরা স্বতস্ফূর্ত ভাবে অথবা কোবাসের নেতৃত্বে ধর্মঘট ও অনুপস্থিতির কর্মসূচি নিতে থাকে। প্রায় ৫০হাজার শ্রমিক এই কর্মসূচিতে অংশ নেয়। অনেক জায়গাতেই পুলিশ চাপ দেয় এবং ভয় দেখায় কিন্তু তা দিয়ে ধর্মঘট ও বিশাল মাপের গণ অনুপস্থিতি ঠেকানো যায়নি।
লোম্বার্ডির সরকারি ইউনিয়নের একাংশও একটি কারখানায় ধর্মঘট ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
নানা কারণে এই ধর্মঘটগুলি গুরুত্বপূর্ণ। তারা দেখিয়ে দেন যে তারা ‘কশাইয়ের হাতের মাংস’ হতে রাজি নন। ‘সবকিছু ঠিক আছে’, ‘সবকিছু নিরাপদ’, যে কোনো মূল্যে উৎপাদন চালিয়ে যেতে হবে- বসেদের এই সমস্ত কথা শ্রমিকরা সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে। তারা দেখিয়ে দেন যে, নিজেদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলন করা থেকে কোনো জরুরি অবস্থাই শ্রমিকদের আটকাতে পারে না। কারখানার বসেরা এবং সরকার একদিকে চাইছিল দেশের সকল নাগরিক ঘরের মধ্যে আটকে থাক, অন্যদিকে কারখানায় সব শ্রমিক উপস্থিত থাকুক। বিশাল বাণিজ্যিক অঞ্চলে শ্রমিকরা পিপিই ছাড়া কাজ করে চূড়ান্ত ভাবে শোষণিত হচ্ছিল। শ্রমিকরা কারখানার কর্তাদের ও সরকারের এই ভন্ডামি উন্মোচন করে দেয়।
আমরা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি, শ্রমিকরা ধর্মঘট করার ফলেই কারখানাগুলিতে ব্যাপক ভাবে কোভিড ১৯ ছড়াতে পারেনি।
শ্রমিকদের প্রতিক্রিয়ার ফলে বসেরা ও সরকার প্রথম বার পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যেসব কারখানায় কোবাসের সংগঠন ছিল, সেসব জায়গায় শ্রমিকদের এই অবস্থানের ক্ষেত্রে নির্ধারক ভূমিকায় ছিল তারাই। নিরাপত্তা বিধি সংক্রান্ত চুক্তি সই হয়। সেটা যথেষ্ট না হলেও, এর ফলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা বাড়ে এবং সর্বোপরি নিরাপত্তা বিধি না মানা হলে যে কোনো বিপজ্জনক কাজে যোগ না দেওয়ার অধিকার পায় শ্রমিকরা।
যে সব জায়গায় বেশি শ্রমিকের প্রয়োজন, সে সব জায়গায় অতিমারি ছড়িয়ে পড়ে- ফলে শ্রমিকদের প্রতিরোধ শক্তিশালী হয় এবং সরকার আরও এক ধাপ পিছোতে বাধ্য হয়। যেসব কারখানায় অত্যাবশ্যক পণ্য তৈরি হয় না, সেগুলো সরকার বন্ধ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু সরকার ও কারখানার কর্তারা সরকারি ইউনিয়নগুলির সহায়তায় কিছু কারখানা চালু রাখতে সফল হয়। তার মধ্যে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিকদের কারখানাগুলি, যুদ্ধ শিল্প, লৌহ-আকরিক শিল্প, এমন আরও কিছু কারখানা যেগুলিতে কোনো ‘অত্যাবশ্যক পণ্য’ উৎপাদিত হয় না। ফলে সেইসব কারখানায় সংঘর্ষ এবং শ্রমিকদের প্রতিরোধ চলতে থাকে।
এই সময় কারখানা ও কাজের বাইরের জগতেও নানা ঘটনা ঘটছিল।
গত এক দশকে দেশের কারাগারগুলিতে যে সব বড়ো বড়ো বন্দি বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলির সমান মাত্রার বেশ কিছু জেল রায়টের ঘটনা এ সময় ঘটে যায়। বন্দিরা বুঝতে পারে ভাইরাস থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। ফলে তারা বিদ্রোহ করে। বন্দি বিক্ষোভ শুরু হয় মোদেনার জেল থেকে। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্র হিংস্র হয়ে ওঠে। জেলের ভেতরে ও বাইরে বন্দিদের সঙ্গে জেলরক্ষীদের সংঘর্ষ বাধে। অনেকগুলি জেলের কিছু অংশ বন্দিরা দখল করে নেয়, কারাগারের বিভিন্ন জিনিসপত্র ভেঙে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে খুনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যেই উত্তর থেকে দক্ষিণ গোটা দেশে জেল বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। ফলে বন্দি পরিবার এবং বন্দিদের সংহতিতে তৈরি সংগঠনগুলি গণ জমায়েত শুরু করে। জেলের মধ্যে গণহত্যা চালিয়ে রাষ্ট্র ১৬ জনকে খুন করে, বহু বন্দি আহত হয়, অনেকের ওপর অত্যাচার করা হয় এবং স্থানান্তরিত করা হয়। জেলের মধ্যে বিধিনিষেধের কড়াকড়ি ছিলই, সেটা আরও বাড়ে। এর ফলে অন্য অনেক বন্দির মতো রেড ব্রিগেডের রাজনৈতিক বন্দিরাও সমস্যায় পড়েন। মিলান এবং অন্য কয়েকটি শহরে পুলিশ জেলের সামনে জড়ো হওয়া বন্দি পরিবার ও সংহতি সংগঠনের সদস্যদের মারধর করে।
প্রোলেতারিয়ান রেড রিলিফ সংগঠন নাগাড়ে বন্দিদের পক্ষে প্রচার চালিয়ে যায়। রাষ্ট্র প্রচার করছিল, মৃত বন্দিরা নাকি বেশি নেশা করে মরে গেছে, এই মিথ্যা প্রচারের মুখোশ খুলে দেওয়া হয় এবং রাষ্ট্রের ভূমিকার তীব্র নিন্দা করা হয়। বন্দি এবং বন্দিদের পরিবারগুলি এই সময় যে সব বিবৃতি দেয়, সেগুলোকে গোটা দেশে প্রচার করে রেড ব্রিগেড।
বিদ্রোহের ফল মেলে। যেসব বন্দির শাস্তি কম ছিল, তাদের ছেড়ে দেওয়া হয় কিন্তু যারা বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল, তাদের ছাড়া হয়নি। ফলাফল পরিষ্কার, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগঠন এবং রাষ্ট্রের পক্ষে থাকা সংগঠনগুলির হিসেবেও জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার উপযুক্ত বন্দির সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। তার মধ্যে এখনও মাত্র ২০০০-কে ছাড়া হয়েছে। ফলে সংগ্রাম এখনও চলছে।
বিদ্রোহ করে বন্দিরা ঠিকই করেছিলেন। কারণ, তার কিছুদিন পরেই জেলে কোভিডের সংক্রমণের খবর আসে। যদিও মাত্র ১ জনের মৃত্যুর খবর প্রচারিত হয়েছে। সংক্রমণের প্রকৃত ব্যাপ্তি গোপন রাখা হয়েছে।
সংগ্রামী শ্রমিকরা কোবাসের মাধ্যমে বন্দিদের সংহতি জানান এবং তাদের শাস্তি মকুব করার দাবিও তোলেন।
কোভিড১৯-এর ব্যাপক সংক্রমণের জেরে গত কয়েক সপ্তাহ ইতালি ‘দ্বিতীয় চিন’-এ পরিণত হয়েছিল। আর এই প্রতিটা দিনই লড়াইয়ের সামনের সারিতে ছিলেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। অসুস্থকে বাঁচানোর জন্য তাঁদের নিঃস্বার্থ, আত্মোৎসর্গী, কখনও কখনও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকাকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্র তাদের খালি হাতে, সুরক্ষা ছাড়াই লড়াইয়ের ময়দানে ঠেলে দিয়েছে। এর ফলে এখনও পর্যন্ত ১২৬ জন চিকিৎসক ও বহু নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। এর বেশিরভাগই হয়েছে অতিমারির ভরকেন্দ্র লোমবার্ডিতে।
ভরকেন্দ্রর একেবারে কেন্দ্রে ছিল বারগেমো শহর। সেখানে ৫০জন অধিবাসী পিছু একটি করে কারখানা রয়েছে। শহরটা কিছুদিনের জন্য হাসপাতাল ও শ্মশানে পরিণত হয়েছিল। হয়ে গিয়েছিল ‘ইতালির উহান’।
এখানে অনেকের মতো আমাদের পার্টি ও ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মীরাও বাবা-মাকে হারিয়েছেন। সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার অপ্রতুলতা এবং বড়োলোকদের জন্য তৈরি দুর্নীতিগ্রস্ত বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার ধাক্কায় বৃদ্ধাবাসগুলিতে ব্যাপক ভাবে অতিমারি ছড়িয়ে পড়ে, হাজার হাজার মানুষ মারা যান। যার প্রকৃত তথ্য লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এমনকি বুর্জোয়া সংবাদ মাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে যে, আক্রান্তের যে সংখ্যাটা জানা যাচ্ছে, প্রকৃত সংখ্যা তার ১০ গুন এবং মৃতের যে সংখ্যাটা দেখানো হচ্ছে, প্রকৃত সংখ্যা তার তিন গুন।
এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যকর্মী ও শ্রমিক শ্রেণির প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। তারা চাকরি না ছেড়ে নিন্দার ঝড় তুলেছেন, “মহামারিকে গণহত্যায় পরিণত করার জন্য যারা দায়ী, তাদের পেটাও!”
যে সব এলাকায় অতিমারির সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে, সেখানে তরণ কর্মীরা সংক্রমিত হয়েছেন, কিন্তু তাদের কম বয়সের জন্য প্রাণহানির সংখ্যা বাড়েনি। পিওন, মালবাহক, কুখ্যাত আমাজন সংস্থার শ্রমিকরা প্রতিদিন আন্দোলন করেছেন। তারা তাদের কাজের পরিমাণ কমিয়ে শুধুমাত্র অত্যাবশ্যক পণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার এবং কার্যকর ব্যক্তিগত সুরক্ষার দাবি জানিয়েছেন।
দেশের মধ্য ও দক্ষিণাংশের পরিস্থিতি ছিল আলাদা। কয়েকটি গাড়ি কারখানা এবং তারান্তোর আর্সলরমিত্তল স্টিল প্ল্যান্টে সংগ্রাম হয়। এইসব কারখানায় শ্রমিকরা কাজে অনুপস্থিত হয়ে প্রতিবাদ করেন। কোনো কোনো দিন বড়ো আকারের ধর্মঘট ডাকেন। সেগুলি আংশিক সফল হয়, সরকারি ইউনিয়নগুলি ধর্মঘটের বিরোধিতা করে। ম্যানেজমেন্টের সুরক্ষার জন্য সরকার তাৎক্ষণিক কিছু ব্যবস্থা নেয় এবং কয়েক হাজার শ্রমিককে কারখানার মধ্যে আটকে রেখে টানা উৎপাদন চালিয়ে যাওয়া হয়। এর ফলে আর্সেলর মিত্তলের মতো কিছু কারখানায় ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়(যদিও এখনও সংক্রমণের গতি খুবই ধীর)। সম্ভবত খেলা এখনও শুরু হয়নি।
দেশের মধ্য-দক্ষিণাংশে, রোমের শহরতলি থেকে শুরু করে বিশাল সংখ্যক অনথিভুক্ত শ্রমিক, কম্পানিয়ার ফেরিওয়ালা থেকে পরিযায়ী কৃষি শ্রমিক ও সিসিলির গরিবদের কাছে ভাইরাস বয়ে আনে কর্মহীনতা। উপার্জন তলানিতে চলে যাওয়া, থাকার জায়গার অভাব, বেকারত্ব- সব মিলিয়ে শ্রমজীবীরা একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।
সেখানে বিভিন্ন সংগঠন, আবাসন সমিতি, বুনিয়াদি ইউনিয়নগুলি আইন অনুযায়ী সরকারি ভাবে যা প্রাপ্য তার থেকে অনেক বেশি সুযোগসুবিধা দাবি করেছে।
পালেরমো, নেপলস ও রোমে বিদ্রোহের প্রয়াসগুলো সরকার ও গণমাধ্যম নির্মম ভাবে দমন করেছে। সেগুলি অপরাধমূলক কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
যে ছবিটা আমরা দেখালাম, তা হল, ইতালি যে কেবল কয়েক সপ্তাহ ধরে কোভিড১৯-এর ইউরোপের ভরকেন্দ্র হয়ে ছিল তা নয়, পাশাপাশি সেখানে সর্বহারা শ্রেণি তীব্র সংগ্রামও চালিয়েছে। যা পরিমাণ ও গুণ উভয় দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। তার মধ্যে দিয়ে গোটা ইউরোপে আর একটি সংক্রমণও ছড়িয়ে পড়ে। শ্রেণি সংগ্রামের সংক্রমণ।
আমরা এখন ‘দ্বিতীয় পর্যায়’-এর সামনে দাঁড়িয়ে। এখন অতিমারি পুরো মাত্রায় সক্রিয় থাকা সত্ত্বেও বসেরা এবং সরকার শোষণের মাধ্যমে মুনাফা ঘরে তুলতে চায়। এই পরিস্থিতিতে সর্বহারা এবং জনগণ তাদের সংগঠনগুলির সাহায্যে(কিছু স্বতস্ফূর্ত ভাবে তৈরি হয়েছে, কিছু আগে থেকেই সংগঠিত ছিল) একটি সর্বাত্মক ধর্মঘটের আহ্বানের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে, তাদের মধ্যে মাওবাদীরাও রয়েছে। তারা চায় এই ধর্মঘট একটি গণচরিত্র পাক। ক্রমে বাড়তে থাকা জরুরি অবস্থার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য এটা অত্যন্ত জরুরি।
এই পরিস্থিতি থেকে আমাদের পার্টি গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। শিখেছে কীভাবে চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় নজরদারির মধ্যেও ঘরে আটকে থেকে সংগঠনকে টিকিয়ে রাখতে হয় এবং কাজ চালিয়ে যেতে হয়। এই সময় পার্টি যে সক্রিয়তা দেখিয়েছে, তা খুবই ইতিবাচক। কাজকর্ম এক মিনিটের জন্যও থেমে থাকেনি এবং ওয়েবসাইটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। কমরেডরা রাষ্ট্রের নজরদারি এড়িয়ে কারখানায় ঢুকেছেন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে মার্কসবাদী তাত্ত্বিকদের সাহায্য নিয়ে নিজেদের তত্ত্বগত ভাবে শক্তিশালী করেছেন। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক ও তত্ত্বগত দিক থেকে আরও উন্নত হয়ে উঠেছেন। এটা কোনো গতে বাঁধা ও গোঁড়ামিবাদী শিক্ষা নয়, বরং যে সাম্রাজ্যবাদের জন্য আজকের এই অতিমারি ও সংকট তৈরি হয়েছে, তাকে রণনৈতিক ও কর্মসূচিগত ভাবে মোকাবিলা করার জন্য মার্কসবাদকে আরও গভীর ভাবে আত্মস্থ করার প্রয়াস।
সমস্ত পরিস্থিতিতে দৃঢ় ভাবে লড়াই চালিয়ে যাওয়ায় সমাজের নানা ক্ষেত্রে পার্টির প্রভাব ও স্বীকৃতি বেড়েছে। তার মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের বিপ্লবীরা, শ্রেণির সংগ্রামী ইউনিয়নগুলি, নারী আন্দোলন এবং যারা বন্দিদের অধিকারের জন্য কাজ করেন, তারা সকলেই।
একথা ঠিক যে একটা কঠিন গুণগত উল্লম্ফনের মুখে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। কিন্ত সর্বহারার অগ্রণী অংশ ও জনগণের সঙ্গে গভীর যোগাযোগের জন্যই ইতালির মাওবাদীরা স্বতন্ত্র। এটাই আমাদের শক্তি, যা আমাদের আশা যোগাচ্ছে।