ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরাজি দৈনিকে মঙ্গলবার সকালে নীতি আয়োগের সিইও অমিতাভ কান্ত ভারতের অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর নিদান হেঁকে দিয়েছিলেন। তার বক্তব্য জুড়ে ছিল ব্যাপক বেসরকারিকরণ, শ্রম আইন প্রায় তুলে দেওয়া, কৃষিতে চুক্তি চাষ, কর্পোরেটদের হাতে জমি তুলে দেওয়ার উদাত্ত আহ্বান।
দিন পেরিয়ে সন্ধ্যা হতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নানা আলাদা শব্দের পর্দা রেখে সেই একই কর্মসূচি ঘোষণা করে দিলেন। বারবার ‘স্থানীয় অর্থনীতি’র কথা বলে শ্রোতাদের সাধ্যমতো বিভ্রান্তও করলেন।
মোদি এদিন ভারতীয় অর্থনীতিতে ‘কোয়ান্টাম জাম্প’ দেওয়ার কথা বলেছেন। অর্থাত কিনা যাকে মার্কসবাদী সাহিত্যে গুণগত পরিবর্তন বলা হয়। তা, ভারতের অর্থনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের আশু ক্ষেত্র কোনটি? সকলেই জানেন, সেটা হল কৃষি ক্ষেত্র। কমিউনিস্টরা বলে থাকেন ভারতীয় কৃষিতে আধা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা জারি রয়েছে। অর্থাত আমূল ভূমি সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। তা না হলে বিশাল সংখ্যক ছোটো চাষি ও ভূমিহীন খেতমজুরের পক্ষে সুস্থ জীবন পাওয়া অসম্ভব। শাসক শ্রেণি বিষয়টাকে সেভাবে না দেখলেও কৃষিক্ষেত্র থেকে কৃষকদের আয় প্রতিনিয়ত কমে যাওয়া, গত ২৫ বছরে প্রায় ৩ কোটি কৃষকের আত্মহত্যার মতো সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে তাদের মতো করে। বস্তুত দেশের বৃহৎ সামন্ত প্রভুরা যেহেতু শাসক শ্রেণির অঙ্গ, তাই তাদের না চটিয়ে সাম্রাজ্যবাদের পলিসি অনুযায়ী কৃষিতে এক ধরনের পুঁজিবাদের বিকাশের চেষ্টা চলছে সেই ১৯৪৭ থেকেই। যেটা কোথাও কোথাও কিছু ফল দিলেও নির্দিষ্ট পকেটের বাইরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়নি। কৃষিতে ওপর থেকে সংস্কারের মাধ্যমে পুঁজিবাদের বিকাশের এই পদ্ধতিতে বলা হয় য়ুঙ্কার পথ। জাপানের মতো ছোটো দেশে তা সম্ভব হলেও ভারতের মতো বিশাল দেশে তা অসম্ভব। যদিও সিপিআই, সিপিএমের মতো দলগুলি কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ং সেই কাজটিই করতে চেয়েছে বরাবর। বস্তুত কংগ্রেসের শুরু করার সেই প্রক্রিয়াকেই পরিমাণগত থেকে গুণগত স্তরে নিয়ে যেতে চাইছে সাম্রাজ্যবাদ, বিজেপির হাত ধরে।
এর জন্য তাদের মূল অস্ত্র হতে চলেছে চুক্তি চাষ। মোদি এর সঙ্গে এদিন সরবরাহ-ব্যবস্থা উন্নত করার কথা বেশ কয়েকবার বলেছেন। যেটা জরুরিও। সাম্রাজ্যবাদের সব পরিকল্পনা শুরুতে খুঁটিনাটি বোঝা না গেলেও দেশে বেশ কয়েকটি সাপ্লাই-হাব আগামী দিনে তৈরি করা হবে বলেই মনে হয়। সেখানে পৌঁছনের জন্য রাজপথে আলাদা লেনও থাকবে সম্ভবত। শুনে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক, যে এর পর থেকে উৎপাদিত ফসল ও খাদ্যশস্য পরিবহণের জন্য কোনো ‘স্বাস্থ্যসম্মত’ যানবাহন ভারতের বাজারে অচিরেই আসতে চলেছে। সেগুলো অবশ্যই কোনো বহুজাতিক সংস্থা বানাবে। সে ব্যবস্থা কিছুতেই ছোটো চাষিদের নাগালে থাকবে না। আধা সামন্ততন্ত্রের নিয়ম অনুসারে গ্রামীণ সামন্ত ও মহাজনরাই সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে। আমরা জানি, পুঁজি ও পণ্য রফতানি করেই পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়। আর এই পণ্যের মধ্যে প্রথম স্থানেই থাকে প্রযুক্তি। উন্নত প্রযুক্তির জন্য সব তৃতীয় বিশ্বের দেশই সাম্রাজ্যবাদীদের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে চু্ক্তিচাষ, বহুজাতিক মালিকানায় জমি লিজ নিয়ে চাষ ইত্যাদির জন্য দেশের নানা প্রান্তে হেলিপ্যাড তৈরি হবে। যাতে উৎপাদিত ফসল ও অন্যান্য নানা জিনিস চট করে সীমান্ত পার করে দেওয়া যায়। তবে শুধু সীমান্ত পার করা নয়, আগামী দিনে নতুন কোনো মহামারি বা শ্রমিক-কৃষকের বিক্ষোভের জেরে যাতে পণ্যের চলাচল স্তব্ধ না হয়(লকডাউন না করতে হয়), তা নিশ্চিত করাই সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য। ডিজিটাল অর্থনীতির সাহায্যে পুঁজির চলাচল বাধাহীন করা গেছে, এবার পণ্যের পালা।
এছাড়া মোদি কৃষকদের জন্য আর্থিক প্যাকেজের কথা বলেছেন, প্যান্ডোরার বাক্স খুললে দেখা যাবে, সেই ঋণের শর্তাবলীর ছত্রে ছত্রে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থরক্ষা করা হয়েছে। বীজ, সার, সাপ্লাই চেন ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়েই সেখানে কৃষককে বহুজাতিকদের বাণিজ্যিক স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত করে নেওয়া হবে। নইলে অনুদান বা ঋণ কিছুই মিলবে না। এমনকি কোভিডের মতো রোগের জুজু দেখিয়ে কৃষককে বহুকিছুই মানতে বাধ্য করা হবে। শুধু কৃষকরাই নন, ঋণের ক্ষেত্রে এই জালে বেঁধে নেওয়া হবে ছোটো ও মাঝারি ব্যবসায়ীদেরও। স্বাস্থ্য সাম্রাজ্যবাদীদের আগামী মৃগয়া ক্ষেত্র। করোনা সংক্রমণকে অতিমারিতে পরিণত করে তার জমি তৈরি করা হয়েছে।
এদিন মোদি ‘সিস্টেম’ বদলের কথা বলেছেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না, তার মধ্যে রয়েছে শ্রম আইন তুলে দেওয়া, কৃষি ক্ষেত্রে চুক্তি চাষ, বহুজাতিক হাঙরদের হাতে জমি লিজ দেওয়া, যাতে তারা নিজেদের শর্তে চাষ করতে পারেন। জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে জটিলতা দূর করা ইত্যাদি।সব মিলিয়ে ভারতের জল, জঙ্গল, জমি লুঠের প্র্রক্রিয়াকে সরল করা। এছাড়া সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আইনি লালফিতের ফাঁস যেটুকু আছে, তাও দূর করা। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই মূল ভারসাম্য থাকবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির দিকে। করোনা-লকডাউন পর্যায়ে বারবার দেখা গেছে ভারতের শাসকদের ওপর আমেরিকার প্রভাব কতটা। সত্যি বলতে কি, করোনার তথাকথিত দাপট শুরু হওয়ার এক মাস আগে ট্রাম্প কেন ভারতে তাজমহল দেখতে এলেন, সে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।
জনসংখ্যার কথাটা তো অনেকেই বুঝতে পেরেছেন। এনআরসি, ওয়ান নেশন ওয়ান রেশন কার্ডের ধান্দা এখানে স্পষ্ট। দেশের সব মানুষকে নজরদারির আওতায় আনাটাই এখানে মূল। মুখে বলা হবে, জনগণকে সরকারি পরিষেবা দেওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা দরকার।
সরবরাহের বিষয়টা অর্থাত সাম্রাজ্যবাদীদের তৈরি পণ্য বাজারে পাঠাতে এবং লুঠ করা পণ্য নিয়ে যাতে পালাতে অসুবিধা না হয়, তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছুদিন ধরেই দেশের পরিকাঠামো ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে। এতে শ্রমজীবী মানুষের হাতে কিছু পয়সা আসছে। অর্থাত চাহিদা তৈরি হচ্ছে। এটা বহু পুরনো ব্যাপার। ব্যবসায়ীদের পণ্য চলাচল ও বিদ্রোহে সামরিক বাহিনী পাঠানোর স্বার্থে রাস্তাঘাট বানায় শাসকরা আর মুখে বলে জনগণের জন্য বানাচ্ছে। যে শ্রমিকরা রাস্তা বানায়, তারা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করলে তাদের বানানো রাস্তা দিয়েই পুলিশের জিপ গিয়ে তাদের পেটায় আর গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রী এদিন বারবার আত্মনির্ভরতার কথা বলেছেন। যার ভেতরে ঢুকলে বোঝা যাবে, আসলে সব জায়গা থেকে রাষ্ট্র হাত তুলে নিতে চলেছে। জনগণ যাতে চাকরির চেষ্টা না করে স্বনির্ভর হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, তা বলা। সরকার কেবল ঋণ দেবে। শোধ করতে না পারলে সাধারণ মানুষ জেলে যাবে আর নীরব মোদিরা বিলেতে। অমিতাভ কান্ত তার প্রবন্ধে বিদ্যুতের বেসরকারিকরণের কথা বলেই রেখেছেন। আরও নানাকিছু পাইপলাইনে রয়েছে। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র কথা মোদি প্রায়ই বলেন, এদিনও বলেছেন। এর মানে হল বৃহৎ বহুজাতিকদের সস্তায় জমি দিয়ে, শ্রমিকদের সবচেয়ে বেশি শোষণ করার সুযোগ দিয়ে ভারতে ডেকে আনার চেষ্টা করা। যদিও এদিন মোদি আত্মনির্ভর হয়ে আমেরিকা, রাশিয়া, ইজরায়েল থেকে অস্ত্র কেনা বন্ধ করবেন বলে কোনো কথা দেননি।
কোভিডে তলানিতে চলে যাওয়া চাহিদা বাড়াতে সরকার ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজের ঘোষণা করেছেন। বড়ো বড়ো পুঁজিবাদী দেশ, সকলেই এই পথে হাঁটছে। সাম্রাজ্যবাদ তার সংকট থেকে বেরোতে, বাজারে চাহিদা তৈরি করতে নিজেদের শ্রেণি দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রগুলিকে দিয়ে বিনিয়োগ করাচ্ছে। যেগুলো সবই জনগণের করের টাকা। এই পলিসি কার্যকর করার জন্য করোনাকে সে ঢাল হিলেবে ব্যবহার করছে। দু-তিন মাস কলকারখানা বন্ধের ক্ষতি পোষাতে তো পুঁজিবাদের চালু নিয়মে দু-তিন মাস সময় ও সরকারি সাহায্যই যথেষ্ট ছিল। সঙ্গে জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নীতিকে জনমুখী করে তাতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেসবের কথা উচ্চারণ না করে অর্থনীতিতে ‘কোয়ান্টাম জাম্পে’র গল্প শোনানো হল। আসলে শ্রমিক ছাঁটাই করার জন্, শ্রম আইন শিথিল করার জন্য সাম্রাজ্যবাদ ‘শারীরিক দূরত্বে’র স্বাস্থ্যনীতিকে কাজ লাগাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার(আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই) প্রযুক্তিকে বিপুল ভাবে ব্যবহারই তার লক্ষ্য।
কিন্তু এসব কিছুর পরেও সমস্যা একটাই। ২০ লক্ষ কোটি সরকারি টাকা দিয়ে চাহিদার স্থায়ী সমস্যা মেটে না (বলা যায় না, পরে দেখা যেতে পারে, বাজেটে বরাদ্দ অর্থ গোলতাল করে নতুন মোড়কে পেশ করেছে)। কিছুদিন সুরাহা হতে পারে। মানুষ পণ্য কেনে নিজের প্রয়োজন এবং রুচি অনুসারে। একই দামে আরও ভালো এবং পছন্দসই পণ্য পেলে সে সেটাই কিনবে। প্রধানমন্ত্রীর বাণী শুনে সে স্থানীয় পণ্য কিনবে না। অথচ মোদিরা জানেন, স্থানীয় পণ্যের বাজার না তৈরি হলে হাজার ঋণেও কোনো কাজ হবে না। ব্যাপক বেকারত্বের জন্ম হবে। জনগণকে রফতানিযোগ্য পণ্য উৎপাদনের খুড়োর কল দেখিয়ে আমদানি বন্ধ করা যায় না। সাম্রাজ্যবাদীদের পণ্য দেশে ঢোকা বন্ধ করার দম তার নেই। কারণ দেশের নীতি তাদেরই অঙ্গুলিহেলনে তৈরি হয়। তাই জনগণকে অনুরোধ-উপরোধ। জনগণকে অনুরোধ করে পুঁজিবাদী বাজারের বিকাশ ঘটানোর তত্ত্ব আবিষ্কারের জন্য অর্থনীতির ইতিহাসে নরেন্দ্র মোদির নাম থেকে যাবে। আসলে কোনো দেশের বাজার বৃদ্ধি বা চাহিদা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন স্বাধীন পুঁজিবাদের বিকাশ। সাম্রাজ্যবাদী বা দালাল বৃহৎ পুঁজির চালিত অর্থনীতিতে তা সম্ভব নয়। আমূল ভূমি সংস্কার বা কৃষি বিপ্লবের মধ্যে দিয়েই সেই স্বাধীন পুঁজির বিকাশ সম্ভব। যা সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থের বিরোধী। মোদিরা যেটা করতে চাইছেন, তাতে ভারত রাষ্ট্রের আধা সামন্ততান্ত্রিক চরিত্রও পালটাবে না। কৃষিক্ষেত্রে পুঁজিবাদের আপেক্ষিক বিকাশ যদি হয়ও, সেটা হবে গ্রামীণ আধা সামন্ততান্ত্রিক ক্ষমতার হাত ধরে। এতদিন যা হয়ে এসেছে। সাম্রাজ্যবাদ তার ব্যবসার সুরক্ষার জন্য কৃষিক্ষেত্রের প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণির সঙ্গেই হাত মেলাবে। বস্তুত মিলিয়েই আছে।
সব মিলিয়ে সাম্রাজ্যবাদের এই নয়া্-আগ্রাসী নীতির ফলে ভারতবর্ষের মেহনতি মানুষের ওপর অচিরেই তীব্রতর আক্রমণ নামতে চলেছে। শ্রম আইন শিথিল, চুক্তি চাষ, কর্পোরেটদের দ্বারা জমি, বনাঞ্চল, খনি দখলের কর্মসূচিকে তীব্র করাই সাম্রাজ্যবাদী কর্মসূচি। এই কর্মসূচি প্রয়োগ করতে গেলে দেশের শ্রেণিশক্তির ভারসাম্য মেহনতি জনতার পক্ষে আসার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ বৃহৎ পুঁজির এই আক্রমণের হাত থেকে করোনায় অনন্তকাল ঘরে বসে থাকতে চাওয়া মধ্যবিত্তও ছাড় পাবে না।
শুধু ভারতে নয়, গোটা দুনিয়াতেই কোভিড-অতিমারির ধোঁয়াশা কেটে সাম্রাজ্যবাদের নথদাঁত স্পষ্ট হচ্ছে। মোদির বাষণের প্রেক্ষিতে ভারতে তার রূপ কেমন হতে চলেছে, তার একটি প্রাথমিক বিশ্লেষণ এই নিবন্ধে করা হল। তবে এ নিয়ে আরও বিস্তৃত চর্চা ও আলোচনা প্রয়োজন।