সুরাট, বান্দ্রা, চেন্নাইয়ের জঙ্গি শ্রমিক বিক্ষোভ ছাড়া কি একজন শ্রমিকেরও বাড়ি ফেরা নিশ্চিত ছিলো?
মুস্তাফা কামাল
মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ভারতের বাইরে থাকা পড়ুয়া, ব্যবসায়ী, নামি কোম্পানির কর্মীদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা শুরু হয়। আর ২৪ মার্চ থেকে এ’দেশে শুরু হয় লকডাউন। এ’দিকে দেশের মধ্যে থাকা প্রায় কোটি দশেক পরিযায়ী শ্রমিক আটকা পড়ে যান বিভিন্ন রাজ্যে। গত পয়লা মে প্রথম ‘শ্রমিক স্পেশাল’ ট্রেন ১২০০ জন শ্রমিককে নিয়ে ছাড়ে তেলেঙ্গনা থেকে ঝাড়খণ্ডের হাতিয়া স্টেশনের উদ্দেশে। পাঁচ দিনে আরও বেশ কিছু রাজ্য থেকে ট্রেন-বাসের মাধ্যমে শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারি বক্তব্যে উঠে এসেছে ৬৪ টি ট্রেনে মোট ৭০,০০০ শ্রমিকদের ফেরানোর ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু বিভ্রান্তির অন্ত নেই। পশ্চিমবঙ্গের ‘জয়েন্ট ফোরাম এগেন্সট করোনা ক্রাইসিস’-এর তরফ থেকে জানা যাচ্ছে রাজস্থানে আটকে থাকা শ্রমিকদের উদ্ধারের জন্য যে ট্রেনের ব্যবস্থা হয়েছে, তা কোন স্টেশন থেকে ছাড়বে তার কোনো সঠিক খবর শ্রমিকদের কাছে পৌঁছানো হয়নি। ২ মে ২০২০ তারিখের ‘দ্য হিন্দু’ খবর করেছে, আরোহীদের স্লিপার ক্লাসের ভাড়ার সঙ্গে অতিরিক্ত ৫০ টাকা দিতে হচ্ছে। এইসব খবর প্রকাশ্যে আসার পর আরও একদফা ভোট রাজনীতি দেখল ভারতের মানুষ। কংগ্রেসের তরফ থেকে ঘোষণা করা হলো, শ্রমিকদের ফেরার সমস্ত খরচ কংগ্রেস বহন করবে (সে টাকা কংগ্রেসের কোন জমিদারি থেকে আসবে তা আমাদের কিন্তু জানা নেই)! এর কিছুক্ষণের মধ্যেই কেন্দ্র ঘোষণা করলো – যাত্রা হবে বিনামূল্যে। তবে খরচের ১৫% দিতে হবে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলিকে। কারণ তাদের অনুরোধ আনুযায়ী রেল এই ‘শ্রমিক স্পেশালের’ ব্যবস্থা করেছে! খুব ভালো কথা। কিন্তু এই সামগ্রিক উদ্যোগের কৃতিত্ব যদি রাজ্য সরকার ও কেন্দ্র সরকার নিজেদের ভোটের হিসেবের নিরিখে করে থাকে তাহলে কিন্তু ভুলই করছে।
আরও পড়ুন: চে গুয়েভারার রাজনীতির জন্যই তাঁকে নিশ্চিন্তে পণ্য বানাতে পারে সাম্রাজ্যবাদ
গত তিরিশ দিনের ‘জয়েন্ট ফোরাম এগেন্সট করোনা ক্রাইসিস’, পরিযায়ী শ্রমিক-কৃষি মজুর সংযোগ মঞ্চ ও আরও বেশ কিছু সংগঠন ও শ্রমিকদের নিজস্ব ভাষ্যে এটাই প্রমাণ হচ্ছে যে দেশের শ্রমিকরা শাসক পার্টি গুলোর এই ভণ্ডামি ধরে ফেলেছে। শ্রমিকদের কাছে আজ এটা পরিষ্কার যে কোন শাসক পার্টি না, এই মহামারির কালে তাদের বাড়ি ফেরার দাবি আদায় হয়েছে তাদেরই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। সুরাট, বান্দ্রা, চেন্নাইয়ের জঙ্গি শ্রমিক বিক্ষোভ ছাড়া, লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করার উদ্যোগ ছাড়া কি একজন শ্রমিকেরও বাড়ি ফেরা নিশ্চিত ছিলো! যে ভারতীয় পরিযায়ী শ্রমিকদের অধিকারগুলি শুধুই খাতায় কলমে সরকারি দলিলে আছে, যাদের জন্য এত দিন ছিলো দূরপাল্লার ভিড়ে উপচে পড়া ট্রেন, যাদের কর্মক্ষেত্রে ছিলো না কোনো নিরাপত্তা, শ্রমিকদের সেই সব চেয়ে ‘দুর্বল’ সবচেয়ে ‘অসংগঠিত’ অংশ আজ হাজারে হাজারে রাস্তাতে নেমে তাদের অধিকারের লড়াই সংগঠিত করার ক্ষমতা দেখালো।
শ্রমিকদের এই লড়াই, পথ হাঁটা দেখে একটা শ্রেণির ভয় এর ফলে করোনা ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু নীচের তলার মানুষ নিয়মিতই নানা রোগে মরেন, তা নিয়ে ওপরের তলার লোকদের আতঙ্কের কিছু থাকে না। কোভিড-আক্রান্ত শ্রমিক নিজের বাড়ি ফিরেও মহল্লায় রোগ ছাড়াতে পারেন। সেটা কথা নয়। তাহলে আটকে থাকা অবস্থায় তাদের সকলের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাই হত। ভয়টা আসলে করোনা-মহামারির নয়। ভয় হল, শ্রমিক শ্রেণি সংগঠিত হলে মালিকদের মুনাফায় টান পড়ার সম্ভাবনা। শোষণ-নির্ভর রাষ্ট্রযন্ত্রের মসৃণ চলাচল স্তব্ধ হওয়ার সম্ভাবনা। সেইজন্যই ঘরে ফেরানোর নামে আপাতত তাদের বিচ্ছিন্ন করা হল।
এই লড়াই আরও দীর্ঘ – ঠিক তাদের পায়ে হেঁটে ফেরা রাস্তাটার মতো।