Home জনস্বাস্থ্য করোনাভাইরাস, অর্থনীতি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

করোনাভাইরাস, অর্থনীতি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

করোনাভাইরাস, অর্থনীতি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
1
কোবাড ঘ্যান্ডি

(সিপিআই(মাওবাদী)-র প্রাক্তন পলিটব্যুরো সদস্য কোবাড ঘ্যান্ডি আট বছরেরও বেশি কারাবাসের পর সম্প্রতি জামিন পেয়েছেন। তাঁর বয়স প্রায় ৭০। ক্যানসার সহ বেশ কিছু রোগে তিনি ভুগছেন। বর্তমান নিবন্ধটি মেইনস্ট্রিম উইকলি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আমরা নিবন্ধটিকে জরুরি মনে করে ভাবানুবাদ প্রকাশ করলাম।)

আজকের এই প্রযুক্তির যুগে গণ উন্মত্ততা পৃথিবী জুড়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষত তাকে যদি শাসকরা এবং/অথবা ধর্ম তোল্লাই দেয়, তাহলে তো কথাই নেই। গণেশের দুধ খাওয়া তার একটি উদাহরণ, স্কাইল্যাবের পৃথিবীতে পতনের ঘটনা আর একটি উদাহরণ। এরকম আতঙ্কের উদাহরণ আরও বহু রয়েছে। ওয়াইটুকে নিয়ে পাগলামোও তেমনই একটি ঘটনা। ঝাড়খণ্ডের জেলে থাকাকালীন একজন আদিবাসী আমায় বলেছিলেন, ২০০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে মনে করে, এমনকি তাদের পিছিয়ে থাকা গ্রামেও মানুষরাও রোজ একটা করে ছাগল কেটে চড়ুইভাতি করা শুরু করেছিলেন।

এইভাবে জনগণের ভয় ও পাপবোধ নিয়ে খেলা করাটা শাসক ও ধর্মগুরুদের পুরনো কৌশল। সেটা চরম পর্যায় পৌঁছলে জনগণের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ হয়। সব ধরনের রাজনীতির লোকেরাই এটা করে। অন্যের ভয় ও পাপবোধ নিয়ে খেলে নিজেদের কাজে লাগানোর চেষ্টা করি আমরা সকলেই।  

যদি আমরা নিজেদের ভয়গুলির দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো অজস্র রকমের ভয়ের মধ্যে আমরা বাস করি। প্রত্যাখ্যাত, ব্যর্থ, অসুস্থ হওয়ার ভয় ইত্যাদি তো আছেই, আর এগুলির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হল মৃত্যুভয়- যা করোনাভাইরাসের সারকথা। একথা সত্যি যে এটি অত্যন্ত সংক্রামক, মানবশরীরের বাইরে কোনো কিছুর ওপর ভাইরাসটি তিন ঘণ্টা অবধি বেঁচে থাকতে পারে। অর্থাত এটি দাবানলের মতো ছাড়ায়। কিন্তু এর মৃত্যুহার সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার থেকে বেশি নয়-সেটাও মূলত বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যাদের ইতিমধ্যেই নানা রোগ শরীরে বাসা বেঁধে আছে-করোনাভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুহার মোট আক্রান্তের ৩% থেকে ০.৫%-শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু সরকার ও গণমাধ্যম সারাক্ষণ এটিকে ‘মারণ’ ভাইরাস বলে চিহ্নিত করছে- তাতেই একটা ত্রাস তৈরি হচ্ছে। তাই চারদিকে একটা ভয়ের পরিবেশ- মৃত্যুভয়, প্রিয়জনকে হারানোর ভয় এবং অজানাকিছুর জন্য ভয়??? এবং এই ভয়ে অন্য সমস্ত ক্ষতিগুলো- চাকরি, ব্যবসা, সঞ্চয়, বিভিন্ন রকমের অসুবিধা, এমনকি হয়তো বাড়তে থাকা অনাহারে মৃত্যু- যেগুলি ভবিষ্যতে সত্যি সত্যিই বেঁচে থাকার ক্ষমতায় প্রভাব ফেলবে, সেই সবগুলিকেই গুরুত্বহীন করে দেওয়া হচ্ছে।

সত্যি বলতে কি, বিশ্বের অর্থনীতি এই মুহূর্তে খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছে। মানস চক্রবর্তী সম্প্রতি বলছিলেন, “গত সপ্তাহে শুধু যে সব শেয়ার বিকিয়ে গেছে তাই নয়- টাকা ঘরে রাখার ত্রাসে বন্ড, পণ্য, এমনকি সোনার দামও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। নগদ টাকাই এখন একমাত্র নিশ্চিন্ত আশ্রয়। সেটা যে কোনো টাকা নয়, মার্কিন ডলার। ডলারের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পয়েছে। আমেরিকা, ইউরোজোন এবং অন্যান্য উন্নত অর্থনীতি সুদের হার শূন্যে নামিয়ে দিয়েছে, মানুষ যাতে যত পারে কেনে, তার জন্য সে দেশের সরকারগুলির সর্বত ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে, বস্তুত সরকারগুলো নিজেরাই খদ্দেরে পরিণত হয়েছে। ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের রক্ষা করার জন্য সরকারগুলো লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা এবং কার্যত যা পারছে তাই দিচ্ছে।(ভারতে অবশ্য তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না)

কিন্তু ঘটনা হল, ভাইরাসের সংক্রমণ আটকানোর একমাত্র উপায় হল অর্থনীতির বেশিরভাগটা থামিয়ে সামাজিক মেলামেশা কমিয়ে দেওয়া। আর যদি সেটাই হয়, স্পেন ও ইতালির মতো দুটি গোটা দেশ যদি লকডাউন হয়ে থাকে, বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি ক্যালিফোর্নিয়া যদি স্তব্ধ হয়ে যায়, তাহলে বিশ্বের অর্থনীতিতে বিশাল মাপের ধাক্কা লাগতে বাধ্য”।   

ফরচুন বলেছে- দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে বেশিরভাগ জি্ডিপি-র পূর্বাভাস ব্যাপ্ত থাকবে ভয়ঙ্কর(-৮%) থেকে সর্বনাশা(-১৫%)-র মধ্যে। গোল্ডম্যান স্যাকস ওই হিসেব স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছে। ওই ব্যাঙ্ক একটি গবেষণা নোট প্রকাশ করেছে, যাতে তারা বলেছে ‘মার্কিন অর্থনীতি হঠাৎ করে থমকে যাওয়ার’ ফলে ২০২০-র দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে জিডিপি ২৪শতাংশ কমে যাবে।

সারা দুনিয়া জুড়ে সরকারগুলো যে ব্যাপক মাত্রায় লকডাউন করেছে, তাতে অর্থনীতি পুনর্জীবিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। উল্টোদিকে, গত ছমাস ধরে যে আর্থিক মন্দা তৈরি হয়েছে (যেটা করোনা থাক বা না থাক, হতই), সেটার কারণ হিসেবে এখন লকডাউনকেই দেখানো হচ্ছে। ১৯২৯ সালের আর্থিক মন্দার জন্য পুঁজিবাদকেই সরাসরি দায়ী করা হয়েছিল। এবার আসন্ন সংকটকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সমস্যার বদলে ভাইরাসের সমস্যা বলে চালানো হবে।  

যাইহোক, বর্তমানে পৃথিবী দুটো বড়ো সমস্যার মোকাবিলা করছে। কেউ জানে না, দুটোর মধ্যে কোনটা বেশি মারাত্মক আকার ধারণ করবে। করোনা ভাইরাসের সমস্যা ও অর্থনীতির সমস্যা। প্রথমটি ছড়িয়ে পড়ে গোটা দুনিয়াকে গ্রাস করে বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে এবং অনেককে অসুস্থ করে দিতে পারে। দ্বিতীয়টি দুনিয়াজুড়ে ব্যাপক অনাহার ও অসুস্থতার পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। প্রথমটির ক্ষেত্রে আমরা অন্তত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে লড়াই করার কথা ভাবতে পারি, দ্বিতীয়টিতে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মনস্তত্ত্ব    

বিজ্ঞান প্ল্যাসেবো এফেক্ট-কে(রোগীর মন রাখার জন্য দেওয়া ওষুধের ফলাফল)মেনে নিয়েছে। এর অর্থ হল, মানুষের মন যদি বিশ্বাস করে কোনো একটা ওষুধ বা চিকিৎসায় সে সুস্থ হবে, তাহলে মনের জোরেই শরীরের রোগের উপশম হতে পারে। কোনো ওষধিগুণহীন চিনির ডেলাতেও সেক্ষেত্রে  কাজ হতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পড়ুয়ারা শেখে, সব রোগের এক তৃতীয়াংশই প্ল্যাসেবো এফেক্টের জাদুতে সেরে যায়। কোনো রোগের সঙ্গে লড়াই বা রোগের বাড়বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মনোশারীরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার বিষয়গুলি এখন সকলেই মেনে নিয়েছে। করোনার মতো ভাইরাসকে (ব্যাকটেরিয়া নয়), যার কোনো ওষুধ নেই, আমাদের শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে হাতিয়ার করেই মোকাবিলা করতে হবে।               

সাইকোনিউরোইমিউনোলজি বিজ্ঞানের একটি নতুন বিভাগ। সহজ ভাষায়, মন কীভাবে মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে, যেটা কিনা ঘুর পথে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে- তার বিজ্ঞান। এটা এখন সকলেই মেনে নিয়েছে যে মানসিক চাপের হরমোন(করটিসোল)আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয় এবং সকল ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়া ইত্যাদি দ্বারা আমাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে ইতিবাচক মনোভাব এবং খুশির হরমোন(এনডরফিন, ডোপামিন এবং সেরোটোনিন)ঠিক উলটো কাজ করে। অতএব, ত্রস্ত হয়ে থাকা এবং ভাইরাসের ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকা, আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ভাইরাসের মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে অনেকটাই দুর্বল করে দেয়। কঠিন রোগের ক্ষেত্রে আতঙ্কিত হয়ে থাকলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম, সেই তুলনায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে রোগের মুখোমুখি হলে সুস্থতার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। করোনার মতো ভাইরাস, যার সঙ্গে ওষুধ নয় বরং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়েই লড়তে হবে, সেখানে দুর্বল হয়ে না পড়াকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। যে পদ্ধতিই গ্রহণ করা হোক না কেন, তাকে যুক্তিসম্মত ও কার্যকর হবে হবে। যারা ত্রস্ত বা আতঙ্কিত হয়ে আছেন, তাদের কাছে রোগটি সম্পর্কে যুক্তিসম্মত বিশ্লেষণ এবং লড়াই করার পদ্ধতিগুলি তুলে ধরতে হবে। দারিদ্র্যের জন্য ভারতবাসীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই কম, তারা যদি ভাইরাসের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, তাহলে তাদের সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। তাই তাদের আত্মবিশ্বাস যোগাতে হবে।

Share Now:

Comment(1)

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *