Home রাজনীতি দুনিয়া জোড়া প্রতিবাদী আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিয়েছে করোনাভাইরাস

দুনিয়া জোড়া প্রতিবাদী আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিয়েছে করোনাভাইরাস

দুনিয়া জোড়া প্রতিবাদী আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিয়েছে করোনাভাইরাস
1

(কিউজেড ডট কম পোর্টালে গত ১ এপ্রিল এই নিবন্ধটি লিখেছেন ম্যাক্স ডে হ্যালদেভ্যাং। নিবন্ধটি এখনও প্রাসঙ্গিক মনে করে আমরা তার ভাবানুবাদ প্রকাশ করলাম।)

দুনিয়া জুড়ে অর্থনৈতিক অস্থিরতা, যা নিয়ে শাসকরা ভেবে আকুল

মনে হচ্ছিল আলজেরিয়ার প্রতিবাদী আন্দোলনকে থামানো যাবে না।

দেশের ২০ বছরের রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ও বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে জেলে পোড়ার পরেও সেই আন্দোলন থামেনি। চলতি বছরেও আন্দোলন চলছিল দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন দাবি করে।

আরও পড়ুন: মোদি থেকে বিজয়ন, করোনার বাজারে জনগণের তথ্য হাতাচ্ছে সকলেই

তারপরই বাজারে এল নোভেল করোনাভাইরাস এবং ৫৬ সপ্তাহ ধরে চলতে থাকা গণ আন্দোলন থেমে গেল। ১৭ মার্চ দেশের নতুন রাষ্ট্রপতি করোনাভাইরাসসের সংক্রমণ রোধের অছিলায় ১ বছরের জন্য সমস্ত প্রতিবাদী আন্দোলনে নিষেধাজ্ঞা জারি করল। এখনও পর্যন্ত প্রতিবাদীরা রাষ্ট্রপতির কথা নীরবে মেনে নিয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে, কারণ আলজিয়ার্সের রাস্তা আপাতত ফাঁকা।

গোটা দুনিয়াতেই বিরোধীদের আন্দোলনের ওপর কোভিড-১৯-এর এই ধরনের প্রভাব পড়েছে। যে ২০১৯ সালকে ‘পথে নেমে প্রতিবাদের বছর’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছিল, দুনিয়া এখন সেই বছরটি থেকে বহু দূরে সরে গিয়েছে।  

“ব্যারিকেডে ভাইরাস থাকতে পারে ভেবে কেউই এখন ব্যারিকেডে ঝাঁপ দিচ্ছে না”- বলছিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ডিরেক্টর রিচার্ড গোয়ান। তাঁর মতে, “করোনাভাইরাস প্রতিবাদী আন্দোলনের প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে এবং তার ফলে বিশ্বের বিভিন্ন কর্তৃত্ববাদী শাসকরা শ্বাস নেওয়ার সময় পেয়ে গেছে”।

হংকং, যেখানে গত বছর কয়েকমাস ধরে আন্দোলন হয়েছে, সেখানে মার্চের শেষ সপ্তাহে ছোটো একটি প্রতিবাদের আয়োজন হয়েছিল কিন্তু ‘চার জনের বেশি জড়ো হওয়া যাবে না’ বলে পুলিশ সেটা ছত্রভঙ্গ করে দেয়। রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট পুতিন ২০৩৬ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকার জন্য জাতীয় ভোটের পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু বিরোধীরা মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করলেও করোনাভাইরাসের জন্য তা বাতিল করে। পরে অবশ্য পুতিনও ভাইরাসের জন্য আপাতত ভোট বাতিল করেছে।     

সব মিলিয়ে মার্চের শেষ সপ্তাহে দুনিয়া জুড়ে ৪৫২টি প্রতিবাদ হয়েছে- যার অনেকগুলিই হয়েছে ব্যালকনি থেকে। যেখানে মার্চের প্রথম সপ্তাহে ১৫১৯টি গণ জমায়েত হয়েছিল। আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডাটা প্রোজেক্টের হিসেব অনুযায়ী গত বছরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ২০০০টি প্রতিবাদ হয়েছিল পৃথিবী জুড়ে।

গত বছরের গণ বিক্ষোভগুলি এক নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাচ্ছিল বলে মনে করেন অনেকেই। অনেকেই তাকিয়ে ছিলেন ২০২০-র দিকে। কিন্তু প্রতিবাদীরা আপাতত ঘরে ফিরেছেন। তারা মনে করছেন এখন ঘরে থাকাই ঠিক। কিন্তু ব্যাপারটা সর্বত্র এত সহজ নয়। কোথাও কোথাও প্রতিবাদ না করতে পারাটা জনগণের জীবনে বিপদ ডেকে আনতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকায় লিঙ্গভিত্তিক হিংসার বিরুদ্ধে গত বছর বহু আন্দোলন হয়েছে। এখন সে দেশে কড়া লকডাউন জারি হওয়ার ফলে বহু মহিলা থাকার জায়গা পাচ্ছেন না। এই জটিল পরিস্থিতিতে দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে প্রতিবাদ চলছে কিন্তু পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হলে সমস্যা সমাধানের পথ পাওয়াও মুশকিল।   

ঘরে থাকার বিলাসিতা

ধনী দেশগুলোয় মানুষ কাজে বেরোতে না পারলে সে দেশগুলির সরকার তাদের দায়িত্ব নেয়। সেখানে প্রতিবাদীরা পথে নেমে নিজেদের এবং অন্যদের ক্ষতি করবেন না। মজার ব্যাপার হল, সংকটের মুহূর্তে ভূমিকা পালনের জন্য দুনিয়ার দশটি বৃহত্তম গণতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধানের জনপ্রিয়তা গড়ে ৯ পয়েন্ট বেডেছে(পোলস্টার মর্নিং কনসাল্ট)। যদিও করোনা সামলাতে তারা যে ভূমিকা নিয়েছেন, তার সমালোচনা করেছেন অনেকেই। তবু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের জনপ্রিয়তা বেড়েছে ২৫ পয়েন্ট, ট্রাম্পের ৫ পয়েন্ট।

কিন্তু উন্নয়নশীল দুনিয়ায় স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার বিভাজন তত স্পষ্ট নয়। ভারতে লকডাউন ঘোষণার পরেও বারবার পরিযায়ী শ্রমিকরা পথে নামছেন নিজেদের দুরবস্থার কথা সরকারকে জানাতে। সাব সাহারান আফ্রিকায় বহু মানুষ দিন মজুরের কাজ করেন। সেখানে কাজকর্ম বন্ধ হলে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সুরক্ষার যাবতীয় নীতি মাটিতে মিশে যাবে বলে মনে করছেন অনেকেই। ভেনেজুয়েলাতেও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অপ্রতুলতা নিয়ে জনগণ বহুদিন ধরেই প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু তেলের ব্যবসা সে দেশের সরকারকে বড়ো সমস্যায় ফেলেনি। এখন তেলের দাম কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি খারাপ দিকে যেতেই পারে।

মার্চের শেষ সপ্তাহে দুনিয়ায় যে প্রতিবাদগুলি হয়েছে, সেগুলি সবই করোনাভাইরাস সংক্রান্ত। কোথাও মানুষ বাঁচার জন্য কাজ করার সুযোগ দাবি করেছেন, কোথাও বা সরকার যাতে আরও ভালো ভাবে ভাইরাসকে সামাল দেয়, তার দাবি উঠেছে।   

অনলাইনে নাকি ব্যালকনিতে

পথে নেমে প্রতিবাদ জানানো কঠিন হয়ে পড়ায় জনগণ অন্য পথ খুঁজে নিচ্ছেন।

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেয়ার বলসোনারো ভাইরাসকে গুরুত্ব না দেওয়ায় মার্চের মাঝামাঝি লক্ষ লক্ষ ব্রাজিলিয়ান ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থালাবাসন বাজিয়ে প্রতিবাদ জানান। ইজরায়েলে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সংসদ বন্ধ করে বিরোধী নেতা বেনি গ্যানটজের জোটের সরকার গঠন বানচাল করে দেন। তার প্রতিবাদে ৬ লক্ষ ইজরায়েলি ফেসবুকে লাইভ প্রতিবাদে অংশ নেন। টিনএজ জলবায়ু অ্যাক্টিভিস্ট গ্রেটা থুনবার্গ তার সাপ্তাহিক প্রতিবাদ অনলাইনে নিয়ে আসেন। হ্যাশট্যাগ ডিজিটালস্ট্রাইক নামে।

কিন্তু পথের প্রতিবাদের তুলনায় অনলাইন প্রতিবাদের ফল সামান্যই। পথের আন্দোলনে প্রতিদিনকার জীবনে যে প্রভাব ফেলা সম্ভব এবং সরকারের ওপর যে চাপ তৈরি্ করা সম্ভব, তা অনলাইনে কোনোমতেই সম্ভব নয়, বলছেন গোথেনবার্গ বিশ্বাবিদ্যালয়ের বিভিন্ন গণতন্ত্র বিষয়ক গবেষক সেবাস্তিয়ান হেলমেয়ার।

সামান্য কিছু প্রভাব যে পড়েনি তা নয়। বলসোনারোর দুটি বিতর্কিত টুইট, টুইটার মুছে দেয়। অন্যদিকে গ্যানটজের সঙ্গে জোট সরকার গঠনে রাজি হন নেতানিয়াহু। যদিও সেই অনৈতিক জোটের বিরুদ্ধে সম্প্রতি পথে নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন ইজরায়েলবাসী। তাদের মুখে ছিল মুখোশ। পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব ছিল ২ মিটার।

ইজরায়েলে প্রতিবাদ

অনলাইনে সবচেয়ে বড়ো মাপের যে আন্দোলনটা করা যায়, তা হল সরকারি ওয়েবসাইট জ্যাম করে দেওয়া। কিন্তু সংকটের সময়ে সরকারি ওয়েবসাইট আটকে দিলে প্রতিবাদীদের জনপ্রিয়তা কমতে বাধ্য। তাছাড়া অনলাইনে প্রতিবাদ সবসময়ই জনগণের একাংশের প্রতিবাদের অধিকার কেড়ে নেয়। কারণ সবার ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ থাকে না। অনেকের ব্যানডউইথ কম থাকে। আবার কাশ্মীরের মতো বহু জায়গায় সরকার নেট ব্যবহারের সুযোগ কেড়ে নেয়।

আগামী দিন

জনগণের ক্ষোভ আরও বেড়ে উঠলেও নয়া ফ্যাসিবাদী আইন কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্র জনগণকে পথে নামতে দেবে না, এমনকি ভাইরাসের বিপদ কমে যাওয়ার পরেও। পশ্চিম আফ্রিকায় এবোলা-সংকট তা দেখিয়ে দিয়েছে। অতিমারি শেষ হয়ে গেলেও অগণতান্ত্রিক দেশগুলি সভা-সমাবেশ বন্ধ রাখার আইনগুলি ফিরিয়ে নেয়নি।

এই সময় রাষ্ট্র পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে নিরাপত্তা সংক্রান্ত পরিষবা দিচ্ছে। তারা জনগণকে স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতেও সাহায্য করছে। ফলে এই সময় পরিস্থিতি সামাল দিতে রাষ্ট্র নিরাপত্তা আধিকারিকদের ওপর নির্ভর করে, আর তারা সবসময়ই বলবে, “না। আমরা এখনও প্রতিবাদের অনুমতি দেওয়ার মতো সুরক্ষিত অবস্থায় পৌঁছয়নি”। এই অবস্থায় সংঘর্ষ ও রক্তপাত অনিবার্য। কারণ জনগণ ক্ষুব্ধ আর রাষ্ট্র তার জারি করা জরুরি অবস্থা-মার্কা আইন অনির্দিষ্টকাল জারি রাখতে চাইছে।

নতুন আইনি ক্ষমতার পাশাপাশি বহু নেতা নতুন বিতর্কিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে জনগণকে ভাইরাস ছড়ানো থেকে আটকে রাখতে চাইছে। ইজরায়েল সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রযুক্তি ব্যবহার করে জনগণের ফোনে নজর রাখছে(যাদের নাকি সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে)। ইরান বহু মানুষকে বোকা বানিয়ে একটি অ্যাপ নামাতে বাধ্য করেছে, যেটা নাকি করোনাভাইরাস সংক্রমণ চিহ্নিত করবে। আসলে সেই অ্যাপটি নজরদারির কাজ করছে। রাশিয়া তাদের নতুন ‘মুখ চেনা’র প্রযুক্তিটা ভাইরাসের বাজারে পরী৭আমূলক ভাবে ব্যবহার করছে। চিনও জনগণের ওপর ব্যাপক নজরদারির কর্মকাণ্ড বাড়িয়ে তুলেছে। সে দেশের ‘মুখ চেনা’র প্রযুক্তি বর্তমানে মুখোশ পরা লোককেও চিনে নিচ্ছে বলে খবর।    করোনাসংকট চলে গেলেও ওই সরকারগুলি এই প্রযুক্তির ব্যবহার বন্ধ করে দেবে না। ফলে যারা প্রতিবাদ-আন্দোলন করবেন, তাদের এখন থেকে এই বিষয়গুলিও মাথায় রাখতে হবে।

Share Now:

Comment(1)

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *