মোদি থেকে বিজয়ন, করোনার বাজারে জনগণের তথ্য হাতাচ্ছে সকলেই
পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: করোনার বাজারে দুনিয়া জুড়ে যে ফ্যাসিবাদী শাসকরা নিজেদের ক্ষমতা আরও কেন্দ্রীভূত করছে, তা নিয়ে বহু আলোচনা চলছে। কিন্তু এ সবের মধ্যেই চলছে আরও একটি ঘটনা। জনগণকে কোভিড১৯ থেকে সুরক্ষিত রাখতে পৃথিবীর নানা দেশেই তৈরি করা হয়েছে মোবাইল অ্যাপ।সেগুলির মাধ্যমে জনগণের শরীরস্বাস্থ্য সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করছে রাষ্ট্র।
বলা হচ্ছে নাগরিকের ‘কনট্যাক্ট ট্রেসিং’ করতে ওই অ্যাপ কাজে লাগানো হবে। লকডাউন উঠে গেলে জনগণ যখন কাজে বেরোবেন, তখন তাদের ওই অ্যাপের মাধ্যমে জানানো হবে, তারা কোনো কোভিড আক্রান্তের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছেন কিনা বা কোনো কোভিড আক্রান্তের সঙ্গে রয়েছেন কিনা ইত্যাদি। তাছাড়া বর্তমান সময়ে গ্রিন জোনে থাকা নাগরিক, অন্য কোনো জোনে পৌঁছে গেলেও তাদের নোটিফাই করা হবে। এর জন্য সম্প্রতি ভারত সরকারের তরফে আরোগ্য সেতু অ্যাপ লঞ্চ করা হয়েছে।সেই অ্যাপে যিনি ডাউনলোড করছেন, তার ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্যও দিতে বলা হচ্ছে সঙ্গে তার গতিবিধিতে নজর রাখার জন্য অ্যাপটিকে জিপিএসের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, ভারতের তথ্য সুরক্ষা আইন দুর্বল। এই ধরনের অ্যাপের মধ্যে দিয়ে জনগণের তথ্য হাতিয়ে নেওয়া এবং তা অন্য কাজে লাগানোর সম্ভাবনা যথেষ্ট রয়েছে। আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রযুক্তি টাইকুন বিল গেটস আরোগ্য সেতু অ্যাপ তৈরি ও ভারতের করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য নরেন্দ্র মোদির প্রশংসা করার পর সেই আশঙ্কা আরও দৃঢ় হয়েছে। কারণ কয়েক বছর আগে থেকেই কোরানভাইরাস ও মহামারির সম্ভাবনা নিয়ে গেটস বক্তব্য রেখে আসছেন। আজকের কোরনা-অতিমারির ভয়বাহতার সঙ্গে ধনকুবের গেটস তথা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির বাণিজ্যিক স্বার্থ কতটা জড়িয়ে তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হবে বলে মনে করছেন অনেকেই। বিশেষত ইউরোপ-আমেরিকায় অতিমারি বেশ খানিকটা ছড়িয়ে হাতের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার পর কেন লকডাউন করা হল, তা স্পষ্ট নয়। শুধু বৃদ্ধ ও অনুৎপাদক জনসংখ্যা কমিয়ে ফেলা নাকি দুনিয়া জুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করাও ছিল তার উদ্দেশ্য, সে প্রশ্নের উত্তর নেই এখনও।
অ্যাপের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসকদারে জনগণের উপর নজরদারির বিষয় তো আছেই। তার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আগামী দিনে দুনিয়া জুড়ে স্বাস্থ্য ব্যবসার নতুন জমানার প্রশ্নটিও। ভারতের বামশাসিত ছোটো রাজ্য কেরলের কোভিড মোকাবিলা গোটা দুনিয়ার নজর কেড়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যে নতুন একটি বিষয় নজরে এসেছে। কেরল সরকার তাদের যাবতীয় কোভিড মোকাবিলার তথ্য একটি মার্কিন তথ্য বিশ্লেষণ সংস্থা স্প্রিঙ্কলারকে দিয়ে দিয়েছে। সেখানে প্রায় ২ লক্ষ কেরলবাসীর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য রয়েছে। কেরল সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি দফতর বলেছে, সংস্থার মালিক রাগি থমাস বিনা পয়সায় তার সংস্থার সার্ভার কেরল সরকারকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন।কারণ কেরল সরকারের হাতে ওই বিশাল তথ্য ঠিকমতো রাখার মতো সার্ভার ছিল না। বর্তমানে তা ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অনেকের মতে ওই তথ্য আসলে বিক্রি করা হয়েছে।
সত্যি বলতে, গোটা দুনিয়ার কোভিড আক্রান্তের তথ্য এখন আমরা যে কোনো গণ মাধ্যমেই দেখতে পাচ্ছি। হু-এর পক্ষ থেকে সমস্ত করোনা-আক্রান্তের তথ্য একই জায়গায় জমা করার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহল জানে এই ধরনের আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির সঙ্গে বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এই সব তথ্য যদি আগামী দিনে তাদের স্বাস্থ্য ব্যবসার কাজে লাগে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বস্তুত, ভারতের মতো গরিব দেশগুলিতে করোনা মোকাবিলায় কোয়ারান্টাইনের চেয়েও বেশি বেশি টেস্ট করাকে গুরুত্ব দেওয়ার পেছনে কিট ব্যবসার সম্পর্ক আছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিশেষত কিছুদিন আগে চিনা-কিট নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারি স্তরে দুর্নীতির বিষয়টি সামনে আসায়, ওই অভিযোগ আরও ভিত্তি পেয়েছে। অবশ্য কোভিড১৯-এর গতিপ্রকৃতি নিয়ে যেহেতু সবকিছু এখনও স্পষ্ট নয়, তা নিয়ে এখনই কোনো সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। যদিও দুর্নীতির ঘটনাটি ইতিহাসে থেকেই যাবে। আর যারা কোভিড আক্রান্ত হচ্ছেন না, তাদের তথ্য নেওয়ার জন্য আরোগ্য সেতুর মতো অ্যাপ তো রয়েছেই।
কোভিড নিয়ে সকলে যখন ব্যস্ত, সেই সময়ে জিও ও ফেসবুকের মধ্যে অংশীদারি সংক্রান্ত চুক্তিটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কে না জানে, আমাদের ব্যক্তিগত বহু তথ্য এখন ফেসবুকের হাতে। তার সঙ্গে জিও-গ্রাহকদের তথ্য, আরোগ্য সেতু মিলিয়ে তথ্যের যে বিপুল ভাণ্ডার কেন্দ্রীভূত হয়ে গেল এই বাজারে, তাতে অতিমারি-ব্যস্ত জনগণ খুব একটা নজর রাখতে পারছেন না। ভবিষ্যতে এর সঙ্গে নেট নিউট্রালিটির বিষয়গুলিও যে জুড়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একচেটিয়া লগ্নিপুঁজি এভাবেই কাজ করে।
আগামী দিনে স্বাস্থ্যবিমার টাকা পাওয়ার জন্য কিংবা সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা বিনামূল্যে পাওয়ার জন্য যদি আরোগ্য সেতু অ্যাপ ডাউনলোড বাধ্যতামূলক করা হয়(এখন যেমন আধার করা হয়েছে), তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সাম্রাজ্যবাদীরা নানা দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা নিয়ে চলে। বস্তুত, মন্দায় আক্রান্ত সাম্রাজ্যবাদকে রক্ষা করতে আগামী দিনে স্বাস্থ্য ব্যবসায় বিশাল বিনিয়োগের পরিকল্পনা চলছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেভাবে অস্ত্রশিল্পে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছিল, করোনার পর সেরকম মাপের বিশাল বিনিয়োগ হতে চলেছে স্বাস্থ্যশিল্পে(অনেকেরই মনে আছে, কিছুদিন আগে মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে একটি বৈঠকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের বিশ্বের পরিবর্তনের সঙ্গে কোভিড-পরবর্তী দুনিয়ার পরিবর্তনের তুলনা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি)। আগামী নতুন কোনো মহামারিতে যাতে জনগণের স্বচ্ছল অংশের শারীরিক সুস্থতা নিয়ে কোনো আশঙ্কা তৈরি না হয়, যাতে আর্থিক কর্মকাণ্ড স্তব্ধ না করে দিতে হয়(লকডাউনের মতো), সেই ভয় দেখিয়ে গড়ে তোলা হবে সেই ব্যবসা। রেস্তোরাঁয় খেতে যাও বা বাড়ির কাজের লোক রাখার সময়ও যাতে ‘স্বাস্থ্য সূচক’ দেখে নেওয়ার অ্ভ্যাস করেন মধ্যবিত্ত, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই সাজানো হচ্ছে ছক। এ জন্য সরকারি ও বেসরকারি পুঁজিকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে বিপুল মাত্রায়। গরিব মানুষকে স্বাস্থ্য রেটিং দেওয়ার কাজ রাষ্ট্রকেই করতে হবে, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে বিমা সংস্থাগুলির ব্যবসা। অন্যদিকে যে কোনো সংস্থা শ্রমিককে কাজে নেওয়ার জন্যও তার স্বাস্থ্য(মূলত ছোঁয়াচে রোগ) দেখে নেবে। সরকারের থেকে রেটিং না নিলে গরিব মানুষ কাজ পাবে না এবং সরকারি পরিষেবা পাবে না। এই ভাবেই তাদের নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা হবে। জনস্বাস্থ্যকে বিমার আওতায় আরও বেশি করে নিয়ে যাওয়া হবে। এছাড়া স্বাস্থ্যবিমায় ছোঁয়াচে রোগ প্রতিরোধের বিষয়গুলিও ধীরে ধীরে যুক্ত হবে। সব মিলিয়ে সামরিক বাহিনীতে স্বাস্থ্যের বিষয়টি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, জনগণের মধ্যেও সেই স্তরের স্বাস্থ্যচেতনা আনার প্রয়াস নেওয়া হবে সাম্রাজ্যবাদীদের তরফে। এক কথায় একে বলা যেতে পারে মিলিটারি-মেডিকেল ইন্ডাস্ট্রি।
অনেকের মনে হতে পারে ভারতের মতে পিছিয়ে থাকা দেশে জনগণের বিপুল অংশের মধ্যে এই ধরনের স্বাস্থ্য-ব্যবসা চালানো অসম্ভব। সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতের ১৫ কোটি জনসংখ্যার বাজার নিয়েই ভাবিত। তাতেই তাদের কাজ চলে যাবে। আরোগ্য সেতু অ্যাপ ইতিমধ্যেই ৫ কোটি মানুষ মোবাইলে ইনস্টল করেছেন। সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের নামে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যবিমার জন্য সরকারি কোশাগার থেকে তহবিল বের করে নেওয়ার গল্প তো আছেই।
তবে শুধু বিমা সংস্থাই নয় এই সব তথ্যের সাহায্য নিচ্ছে/নেবে বৃহৎ ওষুধ সংস্থাগুলিও। তাদের আগামী দিনের ওষুধ গবেষণা-পরিকল্পনা তৈরি হবে এইসব তথ্যের ওপর দাঁড়িয়েই। সব মিলিয়ে জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলি আগেকার সমস্ত সময়ের তুলনায় আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে চলেছে। বিমা ও ওষুধ সংস্থার মুনাফা নয়, জনগণের শারীরিক সুস্থতার জায়গা থেকেই যাতে রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যনীতি ও বাজেট বরাদ্দ প্রস্তুত হয়, তা নিশ্চিত করতে মেহনতি মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে।
(এই বিষয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের পরিকল্পনা সম্পর্কে আরও নির্দিষ্ট তথ্য ও নিবন্ধ আগামী দিনে আমরা প্রকাশ করার চেষ্টা করব)