পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: হয়তো সেদিন সিস্টেমের গাফিলতি না থাকলে এতো বড়ো দুর্ঘটনা হতোই না, প্রাণ হারাতেন না সহকর্মী তিন জওয়ান। এমনটাই মনে করছেন প্রাক্তন কম্যান্ডো সুজয় মন্ডল।
৯ এপ্রিল ২০১৪ সাল। ভোটের ডিউটি সেরে ক্যাম্পে ফেরার সয়ম, ছত্তীসগঢ়ের সুকমা জেলায় ২০৬ নং কোবরা ব্যাটেলিয়ন জওয়ানদের, মাওবাদীদের সম্মুখীন হতে হয়। মুখোমুখি সংঘর্ষে ৩ জন জওয়ান ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছিল, আহত হয়েছিলেন বাকি পাঁচজন। আহত বাকি পাঁচ জওয়ানদের তৎক্ষনাৎ চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টার করে রাইপুরের রামকৃষ্ণ কেয়ার হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন জওয়ান ছিলেন সুজয় মন্ডল। ঘটনাস্থলেই বিস্ফোরণের ফলে, ডানপায়ে গুরুতর ভাবে আঘাত পান তিনি, নষ্ট হয়ে যায় তার পা- টি। ১১ এপ্রিল হসপিটাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় সুজয় মন্ডলকে। সেই ২০৬ নং কোবরা ব্যাটেলিয়ন জওয়ান সুজয় মণ্ডল, বাড়ি খারগ্রাম, মুর্শিদাবাদ এলাকায়।
সেদিনের সেই সংঘর্ষের পরিকল্পনায় ঠিক কী কী ভুল ছিল, আর চিকিৎসা পরিষেবায় যে গাফিলতি ছিল, সেই সত্যিটা জানাতে সুজয় মন্ডল সাংবাদিকের কাছে মুখ খুলতেই তাকে জেলে ঢুকিয়ে মারধর করা হয়। কেড়ে নেওয়া হয় তার মোবাইল ফোনও। এরপরেই তাকে ৬ মাস সাসপেন্ড করা হয়। ৬ মাস পর সে অফিসে যায়, আর জানতে পারে যে অফিস থেকে তার বাড়িতে বরখাস্ত হওয়ার চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সুজয় মন্ডল যে অভিযোগগুলি করেছিলেন সেগুলি হলো:
১. তাদের ব্যাটেলিয়ান টিম নকশাল অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রবেশ করছে, এটা জানা সত্ত্বেও কেন ভুল রণনীতি তৈরি করা হয়েছিলো সিনিয়র অফিসারদের দ্বারা।
২. উচ্চপদস্থ অফিসার কেন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সাধারণ জওয়ানদের কথাকে অগ্রাহ্য করেছিলেন সেদিন।
৩. উন্নতমানের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট কেন দেওয়া হয়নি জওয়ানদের।
৪. জওয়ানদের কাছে U.B.G.L গুলি মেয়াদ উত্তীর্ণ কেন ছিলো।
৫. অপ্রশিক্ষিত সৈন্যদের প্রশিক্ষণ ছাড়া কেন নকশাল অধ্যুষিত অঞ্চলে যুদ্ধের জন্য পাঠানো হয়েছিলো।
৬. আহত জওয়ানদের আপদকালীন চিকিৎসা কেন দেওয়া হয়নি।
৭. আধুনিক অস্ত্র কেন দেওয়া হয়নি সৈনিকদের।
৮. ঘটনাস্থলে আহত ৭-৮ জন মাওবাদীর খোঁজ কেন চালানো হয়নি।
সুজয় মণ্ডল একান্ত সাক্ষাৎকারে আমাদের জানালেন, তিনি আরও বললেন, তাদের ব্যাটেলিয়নে সিস্টেম ঠিক করা অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। যারা নতুন যোগ দিয়েছিল, তাদেরকে পুরোপুরি প্রশিক্ষণ না দিয়েই যুদ্ধের ময়দানে এগিয়ে দেওয়া হত। পিছন থেকে কোন রকম ব্যাকআপও দেওয়া হত না।
আর এই নিয়েই তিনি (ডিআইজি, আইজি, ডিজি) উচ্চপদস্থ অফিসারদের এর কাছে অভিযোগও জমা দেন। কিন্তু তাতেও তিনি কোন ন্যায়বিচার পাননি বলেই দাবি করেন। তারপরই তিনি কিছুটা বাধ্য হয়েই সংবাদ মাধ্যমের দারস্থ হন।
সরকার সুজয় মন্ডলের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি বলে অভিযোগ। তাই তাকে বাধ্য হয়ে কলকাতায় ফিরে এসে নিজের খরচে তার পায়ের অস্ত্রোপচারের জন্য আর.জি.কর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে হয়, এর ফলে তিনি ৯০ দিনের বেশি সময় ডিউটিতে যোগ দিতে পারেননি। কিন্তু তিনি ২০৬-কোবরা হেডকোয়ার্টারে চিঠির মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। সুজয় মন্ডলের বক্তব্য অনুযায়ী তিনি ৯০ দিনের বেশি ছুটিতে ছিলেন এই অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মিথ্যে এনকোয়ারি বসিয়ে তাকে বরখাস্ত করা হয়, যদিও নিয়মিত কোবরা হেডকোয়ার্টারে যোগাযোগ রাখার জন্য তাকে এই অভিযোগে বরখাস্ত করাটা ভিত্তিহীন এবং তার বিরুদ্ধে মারাত্মক একটি ষড়যন্ত্র। এছাড়াও তিনি মিডিয়ার সামনে মুখ খোলার জন্য তাকে ‘বিশৃঙ্খল’ তমকা দেওয়া হয়।
সুজন মন্ডল তার বক্তব্যে স্পষ্ট জানিয়েছেন, তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন শুধুমাত্র তার একার জন্য না, ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিচু তলায় কর্মরত সকল জওয়ানদের জন্য। তিনি সঠিক পরিকাঠামো দাবি করেছিলেন, সেই সকল জওয়ানদের জন্য যারা বেশিরভাগই কিষাণ এবং মজদুর পরিবার থেকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য হন, অর্থনৈতিক অচলাবস্থা থেকে মুক্তি পাবার আশায়। একই সাথে তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন উচ্চপদস্থ অফিসারদের গাফিলতির বিরুদ্ধে। তার ফলাফল শূন্য।
তিনি বারবার নেতা-মন্ত্রীদের দারস্থ হয়েছেন, এমনকি ছুটে গেছেন দিল্লিতেও, কিন্তু প্রতিবারই তাকে ফিরে আসতে হয়েছে চরম হতাশা নিয়ে। নরেন্দ্র মোদী যখন প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন, সেই সময়ই এই ঘটনা ঘটে। তার বক্তব্য অনুযায়ী তিনি কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিলেন যে, তিনি হয়তো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর থেকে তার দেশভক্তির জন্য কিছুটা সাহায্য পাবেন।
তিনি বারবার প্রশ্ন করেছেন, ‘আচ্ছে দিন কবে আসবে সিপাহিদের জন্য’, প্রধানমন্ত্রীর থেকে প্রাক্তন কম্যান্ডো সুজয় মন্ডল কোনো সদুত্তর পাননি। সুজয়বাবুর ইচ্ছে, সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করার। কিন্তু অভাব আর্থিক সংগতির।
চাকরি হারানোর পর ছত্তীসগঢ়েই একবছর তিনি একটি পেট্রোল পাম্পে কাজ করতেন, শারীরিক অসুস্থতার জন্য তাকে ফিরে আসতে হয় তার গ্রামে। তারপর কিছুদিন টিভি চ্যানেলে ক্যামেরাম্যানের কাজ করেছেন সুজয় মন্ডল, তবুও পরিবারের অভাব ঘোচে না।কিছুদিন আগে অবধিও তাকে বাধ্য হয়ে, শিলিগুড়িতে একটি ছোটো সংস্থায় হোম গার্ডের কাজ করতে হয়েছে। লক ডাউনের জন্য সে কাজটিও হারান সুজয় মন্ডল। বর্তমানে তাকে প্রায় বিকল হয়ে যাওয়া পা নিয়েই চাষাবাদের কাজ করতে হয় পেটের জ্বালা মেটানোর জন্য। লকডাউনের বাজারে কোনো রকমে বেঁচে আছেন সুজয় মন্ডল ও তার পরিবার। লকডাউনের পর বাজারদর আরও আগুন হবে, তখন কীভাবে সামলাবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন এই প্রাক্তন কোবরা জওয়ান।