যারা সরকারি হাসপাতালের বাথরুমের ভিডিও ভাইরাল করছে, তারাই ফ্যাসিবাদের সামাজিক ভিত্তি
‘আমাদের পারতেই হবে’। সোশাল মিডিয়ার জনপ্রিয় সেলেব্রিটিদের নিয়ে তৈরি একটি মিউজিক ভিডিও কিছুক্ষণ আগেই দেখলাম। ভাইরাল যে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কথা, সুর, প্রোডাকশন সবটাই জমজমাট। সবাইকে ঘরে থাকার আবেদন। গানে, শিল্পে এসব শুনলে একটু অন্যরকম লাগে বটে। কিন্তু এসব তৈরি হতে লকডাউন মাস পেরিয়ে গেছে। ‘আবেদনে’র অন্য রূপগুলো ইতিমধ্যেই আমাদের দেখা হয়ে গেছে।
‘বস্তি অঞ্চলের লোকেরা অশিক্ষিত, মুসলমানরা অশিক্ষিত, ছোটোলোক। পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে বাড়ি ঢোকানো উচিত’। কোনো কোনো ঘোষিত বামপন্থী বলেছেন, ‘দু-একটা গুলিতে না মরলে’ পরিস্থিতি ঠিক হবে না। কিছু আমোদগেঁড়ে লোক চা খেতে রোজ বেরোলেও, তারা যে সংখ্যাগুরু নয়- সেটা বোঝার মতো বুদ্ধিশুদ্ধি যাদের থাকার কথা, তাদের মুখেই ওইসব বাণী শুনে ভেবলে যেতে হয়।পুলিশের মার খাওয়ার সম্ভাবনা মাথায় নিয়েও যে মুচি দোকান খুলছেন, বা যে বাগান সাফাই কর্মী ঘরে ঘরে গিয়ে কাজ খুঁজছেন- তারা যে নিতান্ত পেটের দায়েই সেটা করছেন, সেটা বোঝা কি খুব কঠিন!
ভারতবর্ষের কটা মানুষের ঘরে দূরত্ব রেখে বাস করার সুযোগ আছে? কাজের খোঁজে না বেরিয়ে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে ঘরে থাকতে বলাটা কি তাদেরকে বিদ্রূপ করা নয়? এই বাস্তববিচ্ছিন্নতাটাই এই সময়ের নতুন মধ্যবিত্তের চিহ্ন। যাদের শ্রমের উপর দাঁড়িয়ে তাদের প্রতিদিনকার জীবন চলে, সেই শ্রমজীবীদের জীবন সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। তারা মনে করেন একা একা বাঁচা যায়। ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’। বলাই বাহুল্য, এক ধরনের আর্থিক নিরাপত্তাই তাদের এই ভাবে ভাবতে সাহায্য করে। নিয়ম না মানা গরিব মানুষকে তারা করোনার চেয়েও বড়ো ভাইরাস মনে করেন। এই মধ্যবিত্তের কথায়, কবিতায়, গানে কোথাও রাষ্ট্রের কাছে কোনো দাবি নেই। কেউ বলছেন না, দেশের একটি মানুষকেও যেন কাজের প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে বেরোতে না হয়, তার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। বরং তারা সরকারি হাসপাতালের ভিডিও করছেন।
ভারতবর্ষের কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন চিকিৎসার জন্য দুর্বল পরিকাঠামোর সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে যান। সেই অব্যবস্থার মধ্যে চিকিৎসা করে সুস্থ হন বা প্রাণে মারা যান। তা নিয়ে বিক্ষোভ হয়, ভাঙচুরও হয়। কিন্তু কখনও দেখা যায়নি কেউ বাথরুমের ভিডিও করে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করছেন। কেন? কারণ ওই পরিবেশের সঙ্গে তারা অভ্যস্থ। আজ যারা করোনাক্রান্ত হয়ে সরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, তাদের মনে হচ্ছে ‘এলেম নতুন দেশে’। যদি ভবিষ্যতে আবার কোনো কারণে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, তাই তারা ভিডিও তুলে সচেতনতার প্রসার ঘটাচ্ছেন। কারণ, তাদের সাধের বেসরকারি হাসপাতালের ৯০ শতাংশয় করোনা চিকিৎসা হচ্ছে না(অন্য রোগের ব্যবসা রক্ষা করতে)। অথচ ৭০ বছরের পুরনো প্রজাতন্ত্রে কেন স্বাস্থ্যখাতে সরকারি বিনিয়োগ বাজেটের ১ শতাংশেরও কম, তা নিয়ে তারা এতদিন কোনো প্রশ্ন তোলেননি। এরপরও তাদের বেশিরভাগ তুলবেন বলে মনে হয় না। বরং আরও বেশি করে জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করবেন। সুরক্ষা স্টোর থেকে পণ্য কিনবেন। হাইজিন রেটিং দেখে রেস্তোরাঁয় খাবেন। যতটা সম্ভব বাড়ি থেকে কাজ করবেন। অনলাইনে পড়াশোনার সুযোগ আছে, এমন স্কুলে সন্তানদের পড়াবেন। মুখোশ, স্যানিটাইজারের বিষয়ে আনকম্প্রোমাইজিং হয়ে উঠবেন, স্বাস্থ্যবিমায় মহামারি-কভার খুঁজবেন এবং অবশ্যই মানুষের সঙ্গে দূরত্ব রেখে মিশবেন। আর চাইবেন শক্ত প্রশাসক। যিনি কোভিডের অজুহাতে জনগণের ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রামের ওপর দমন নামিয়ে আনলেও এই শ্রেণির সমর্থন পাবেন।
শক্ত প্রশাসক চাইবেন তারাও, করোনা যাদের পেশার নিরাপত্তা কেড়ে নিচ্ছে। শ্রেণিগত অবস্থান নেমে যাওয়ার আশঙ্কায় তারা চাইবেন সকলে নিয়ম মেনে চলুক। কারণ শ্রমজীবীদের সঙ্গে একসঙ্গে মিছিলে হাঁটার কথা তারা ভাবতেও পারেন না। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক এরিক হবসবম বলেছিলেন, মধ্যেবিত্তের ভয় তাকে ফ্যাসিবাদের দিকে চালিত করে। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা নিয়ে অনিশ্চয়তার ভয়।বর্তমানে সেই ভয়কে তীব্র করেছে করোনা। অসহায় হয়ে তারা সকলকে ঘরে থাকতে বলছে। যদিও জানে, করোনা লকডাউন উঠে গেলে চাঁদে চলে যাবে না। অনিশ্চয়তা বাড়বে। কিন্তু সেটা মেটানোর দায়িত্ব যে রাষ্ট্রের, সেটা না ভেবে তারা গরিব মানুষকে ভিলেন বানাচ্ছেন।
মধ্যবিত্ত শ্রেণি যে ফ্যাসিবাদের মতাদর্শগত ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, সে কথা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা জর্জি ডিমিট্রভ ১৯৩৪ সালে বলে গিয়েছেন। কারণ মধ্যবিত্ত মনে করে, পুঁজিপতিরা ঐক্যবদ্ধ। মেহনতি জনগণের নিজস্ব মতাদর্শ ও পার্টি আছে। কিন্তু তাদের কিছু নেই। আর্থিক অনিশ্চয়তায় তারা নিজেদের প্রতিনিধি খোঁজে। সংবিধান বর্ণিত ‘সমান অধিকার’, ‘সমান সুযোগে’-র হাত ধরে তারা বুর্জোয়াদের কাছাকাছি থাকতে চায়। শ্রমজীবীদের আন্দোলনের অংশ হতে তারা চায় না। এর জন্য তারা ভিলেন খোঁজে। তা কখনও(এদেশে) মুসলমান, কখনও সংরক্ষণের ‘সুযোগ’ পাওয়া দলিত, কখনও ট্রেড ইউনিয়ন তো কখনও কমিউনিস্ট পার্টি। বিশ্বায়ন-উদারিকরণের গত ত্রিশ বছরে ভারতের ইএমআই নির্ভর মধ্যবিত্তের সঙ্গে মেহনতি মানুষের দূরত্ব অনেক বেড়ে গেছে। সেই ফাঁক ভরাট করেছে ৫৬ ইঞ্চির ছাতি। তার কথা শুনে, মনে মনে অর্থহীন জেনেও তারা থালা বাজায়, মোমবাতি জ্বালায়। আসলে তারা ‘সেভিওর’ চায়। অপার্থিব শক্তির উপর বিশ্বাস তাদের মজ্জাগত। অনিশ্চয়তা তা আরও বাড়িয়ে দেয়। এ রাজ্যে ৩৪ বছরের বাম শাসনের প্রোডাক্ট যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, তারাও এর বাইরে নয়। বরং আজকের ফ্যাসিবাদের ভিত্তি তারাই।
এই পরিস্থিতিতে তাদের একাংশ চক্ষুলজ্জায় শ্রমজীবী বা পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য আর্থিক সাহায্য করলেও, রাষ্ট্রের কাছে সকলের জন্য খাদ্য-স্বাস্থ্যের দাবি করতে ভুলে যায়। তাদের শ্রেণিচরিত্রে ঢুকে থাকা স্বার্থপরতাই এর কারণ। অতিধনীদের ওপর করোনা কর চাপানোর কথা বলে না। ভাবে যদি, আগামীকাল নিজেদের উপার্জন থেকেও কর দিতে হয়। বা ওই করের দাবি চাইলে সামাজিক সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার পথ কঠিন হয়ে যায়! অথচ ইতিহাস থেকেও বোঝে না, ফ্যাসিবাদ তার জনপ্রিয়তাবাদী বুলির আড়ালে একচেটিয়া লগ্নিপুঁজির হয়েই কাজ করে।
এই পরিস্থিতি পালটানোর একটাই উপায়। মেহনতি মানুষের তীব্র গণ আন্দোলন। যে আন্দোলন অনিশ্চয়তায় ভোগা মধ্যবিত্তকে সঠিক দিশা দেখাবে, ভরসা যোগাবে। ফ্যাসিবাদের দিকে না ঝুঁকে তারা বাম দিকে ঝুঁকবেন। সেই আন্দোলনে যোগ দিয়ে, নেতৃত্ব দিয়ে বহুদিন ধরেই বুনিয়াদি জনগণের সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আসা ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা নতুন সমাজের পথ তৈরি করছেন। আজকের অতিমারির সংকটের মধ্যে দাঁড়িয়ে সচেতন মধ্যবিত্তের একাংশের ত্রাণবিলি, কমিউনিটি কিচেন, জনগণকে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার উদ্যোগগুলি ভরসা দেয়, সেই নতুন দিন এই পৃথিবার গর্ভেই রয়েছে।
‘যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিল, আমি কোনো কথা বলিনি,
কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।
তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল, আমি নীরব ছিলাম,
কারণ আমি শ্রমিক নই।
তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে,আমি তখনও চুপ করে ছিলাম,
কারণ আমি ইহুদি নই।
আবারও আসল ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে,আমি টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করিনি,
কারণ আমি ক্যাথলিক নই।
শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,
আমার পক্ষে কেউ কোন কথা বলল না, কারণ, কথা বলার মত তখন আর কেউ বেঁচে ছিল না’।
মার্টিন নিমোল্যারের লেখা এই বহুপঠিত কবিতার উত্তম পুরুষটি কে? একজন মধ্যবিত্তই তো!!