Home অর্থনীতি ন্যায্য বন্টনের ধোঁকাবাজি নয়, খেটে খাওয়া মানুষের নেতৃত্বে উন্নত উৎপাদন ব্যবস্থাই মুক্তি আনবে

ন্যায্য বন্টনের ধোঁকাবাজি নয়, খেটে খাওয়া মানুষের নেতৃত্বে উন্নত উৎপাদন ব্যবস্থাই মুক্তি আনবে

ন্যায্য বন্টনের ধোঁকাবাজি নয়, খেটে খাওয়া মানুষের নেতৃত্বে উন্নত উৎপাদন ব্যবস্থাই মুক্তি আনবে
0

গুরুপ্রসাদ কর

সম্প্রতি আনন্দবাজারের সম্পাদকীয়তে (এপ্রিল ১৪, ২০২০) গভীর আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। আশঙ্কার কারণ অনেকে নাকি আবার সমাজতন্ত্রের অনিবার্যতার প্রসঙ্গ তুলতে শুরু করেছে আর এতেই শুরু হয়েছে হৃদকম্প। কিন্তু তাদের সমস্যা হল যে ধনতান্ত্রিক বাজারের পূজা না করলে তাদের ভাত হজম হয় না অথচ সেই ব্যবস্থা কি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কি ভারতে যে বিপুল বিক্রমে অসাম্য তৈরি করে চলেছে তা আজ সমস্ত তথ্যে স্বপ্রমাণিত। আর সেটাই বড় অস্বস্তি। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষের রাজ ও সমাজতন্ত্রের চিন্তা চেতনাকে তো রোধ করতেই হবে। তার জন্য মানুষের চিন্তার জগতে বিভ্রান্তিও ছড়াতে হবে। আর তাই প্রাসঙ্গিক আলোচনা ছেড়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবিনশ্বরতায় বিশ্বাসী কিছু পন্ডিতমূর্খ অর্থনীতিবিদের সম্পদ বন্টন সম্পর্কে অপ্রয়োজনীয় কিছু বিতর্কের অবতারণা করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার কৌশলী প্রয়াস।

আরও পড়ুন: দুনিয়ার প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রূপকার লেনিনের জন্ম সার্ধশতবর্ষ পূর্তিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য, ভিডিও

পুঁজিবাদ ব্যবস্থা চলে তার নিজস্ব নিয়মে। যার পুঁজি আছে সে পুঁজি বাজারে খাটায়। যার পুঁজি নেই সে শ্রমশক্তি বিক্রি করে। কার্ল মার্কস দেখিয়েছেন যে শ্রমিকশ্রেণি তাদের দেওয়া মজুরির অতিরিক্ত যে মূল্য তথা উদ্বৃত্তমূল্য তৈরি করে সেটাই সমস্ত মুনাফার উৎস। আর পুঁজির মালিকেরা নিরন্তর এই উদ্বৃত্তমূল্য করায়ত্ত করে পুঁজির সঞ্চয়ন ঘটিয়ে চলে, উৎপাদন বৃহৎ থেকে অতি বৃহৎ হয়ে চলে। কিন্তু একইসাথে ব্যবসা সঙ্কট, অতি উৎপাদন ও বেকারত্ব হয়ে ওঠে তার সাধারণ চরিত্র। এমন সময় আসে যখন একদিকে গুদামে পণ্য পচে, কারখানার বড়ো বড়ো যন্ত্র থাকে নিশ্চল আর তার বিপরীতে হাহাকার, বেকারত্বও অনাহার। অর্থাৎ সংস্থাগুলিতে উৎপাদনের সামাজিকীকরণের মধ্যে দিয়ে সমাজের উৎপাদন ক্ষমতা এতটাই বেড়ে যায় যে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার সামগ্রিক বিশৃঙ্খলা আর তার সাথে সঙ্গতি রাখতে পারে না, পুঁজিবাদ অন্তর্বস্তুতে হয়ে ওঠে ধ্বংসের প্রতিভূ। নিছক শোষণ ব্যবস্থা বলে নয়, কার্ল মার্কস দেখিয়েছিলেন যে সমাজ বিকাশের নিয়মেই পুঁজিবাদের মৃত্যুঘন্টা বেজে গেছে। ঐতিহাসিকভাবে এই ব্যবস্থা তার প্রগতিশীল গতি হারিয়ে অচল হয়ে গেছে, আর পরবর্তী ইতিহাস রচিত হবে সমাজের অগ্রণী শ্রেণি তথা শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তাকে রাজনৈতিকভাবে অপসারিত করে যাদুঘরে পাঠিয়ে দেওয়ার কর্মকাণ্ড নিয়ে।  

এরপর পুঁজিবাদ একচেটিয়া স্তরে রূপান্তরিত হবার পর শুরু হয় পরজীবী ফিনান্স কোম্পানিগুলির  বিশ্ব আধিপত্য। মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য নিয়োগ নয়, উদ্বৃত্ত পুঁজি অনুন্নত দেশগুলির সম্পদ নিংড়ে নেবার জন্য সেখানে চালান করা হয়। সমাজে আধিপত্য তৈরি হয় এই ফিনান্স পুঁজির মালিকদের, যাদের উৎপাদনের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। অর্থ পরিচালন ব্যবস্থাকে  নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে, ঘুস সহ নানা ধরনের অসৎ কাজকর্ম, আর্থিক জুয়া খেলে ও অনুন্নত দেশের মানুষের রক্তঘাম শুষে এরা উদ্বৃত্ত পুঁজিকে নিরন্তর বাড়িয়ে চলে। বর্তমানে চাহিদার অভাবে উৎপাদনে বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় পুঁজিকে আবার আর্থিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ঘটিয়ে এরা শ্রমজীবী মানুষের উপর শোষণ ও অনুন্নত দেশের সম্পদ লুন্ঠন কয়েক গুন বাড়িয়ে নিয়েছে। এদের আধিপত্যের প্রতিযোগিতায় অতীতে দুটি বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেছে আর তার পরেও এই অবাধ লুন্ঠনকে জারি রাখতে ঘটে চলেছে নিরন্তর অন্যায় যুদ্ধ যার মধ্যে দিয়ে ক্রমাগত উৎপাদিকা শক্তি ধ্বংস হয়ে চলেছে।

আর এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই সেই কবে থেকেই বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার গুণগান গেয়ে কেবল তার বন্টনের নিয়মটিকে একটু বদলানোর পক্ষে ওকালতি করে আসছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদন ও বন্টন পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত, একটি থেকে আর একটিকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। অন্য কোন বন্টনের ব্যবস্থা সম্ভব হলে পুঁজিবাদ আর পুঁজিবাদ থাকে না। মুনাফা ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে এটাই একমাত্র সঙ্গতিপূর্ণ বন্টন ব্যবস্থা। বুর্জোয়া রাষ্ট্র হচ্ছে পুঁজিপতিশ্রেণির স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত নিপীড়নকারী সংস্থা মাত্র। আর এই বিজ্ঞানকে সামনে রেখেই মার্কস দেখিয়েছিলেন যে বুর্জোয়াশ্রেণির হাত থেকে উৎপাদনের উপায়কে কেড়ে নিয়েই একমাত্র নতুন সমাজে উত্তরণের পথে যাত্রা শুরু করা যায়।  

পুঁজিবাদের বিকল্প হিসাবে কার্ল মার্কস তার মাথা থেকে উদ্ভূত কোন আদর্শ সমাজের কল্পনা করেননি। সমাজ বিকাশের নিয়মেই তিনি দেখিয়েছেন যে পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করতে হলে সমাজের সবচেয়ে অগ্রণী শ্রেণি তথা খেটে খাওয়া মানুষের রাজ তথা শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হয়, যে রাষ্ট্র উৎপাদন উপায়ের ব্যক্তি মালিকানার উচ্ছেদ ঘটিয়ে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। শ্রম অনুযায়ী ভোগ্যদ্রব্যের বন্টন চালু করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাম্য প্রতিষ্ঠা করা হয় না এবং তা করাও যায় না, কিন্তু যারা কোনো শ্রম না করে সমস্ত সম্পদ করায়ত্ত করতে অভ্যস্ত সেই বুর্জোয়াশ্রেণির এই অধিকার কেড়ে নিয়ে তার উপর একনায়কত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ সামাজিক উৎপাদনে অংশগ্রহণ না করলে তার ভোগ্যদ্রব্য পাবারও অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। এই অর্থে সমাজতন্ত্র কোন নির্দিষ্ট সমাজব্যবস্থা নয় বরং তা হল সাম্যবাদী সমাজে পৌছনোর লক্ষ্যে একটি অন্তর্বর্তী পর্যায়, যে পর্যায়ে রাষ্ট্রব্যবস্থার একমাত্র রাজনৈতিক রূপ হতে পারে প্রলেতারীয় একনায়কত্ব। এই রাষ্ট্র শ্রমে অংশগ্রহণ না করে সমস্ত সম্পদ হাতিয়ে নেবার বুর্জোয়া অধিকার তথা বুর্জোয়া গণতন্ত্র,বুর্জোয়া রাজনীতি,সংস্কৃতি ও অভ্যাসগুলিকে শ্রেণিসংগ্রাম চালিয়ে নিয়মিত দমন করে চলে। অর্থনীতিতে বুর্জোয়া শোষণের সমস্ত বস্তুগত ভিত্তিকে ধ্বংস করার মধ্যে দিয়েই একটি পর্বে গড়ে উঠবে শ্রেণিহীন সমাজ তথা বিশ্ব সাম্যবাদী ব্যবস্থা।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল রাশিয়া এবং চিনে যদিও তা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সেই ব্যবস্থায় বেকারত্ব প্রায় ছিলই না, সবার জন্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অনেকটাই অর্জিত হয়েছিল। ১৯২৯ সালে মন্দার ধাক্কায় যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ তাবড় দেশ জর্জ্জরিত তখন সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকাশে কোন ছেদ পড়েনি। চিনে সমাজতন্ত্রের পর্বে নিরন্তর শ্রেণিসংগ্রাম চালিয়ে দৈহিক শ্রম ও মানসিক শ্রমের বৈপরীত্য, ম্যানেজার ও শ্রমিকদের মধ্যেকার পার্থক্য, গ্রাম ও শহরের মধ্যেকার পার্থক্য এবং নারী ও পুরুষের মধ্যেকার বৈষম্য কমানোর প্রক্রিয়া এক বিশেষ গতি অর্জন করেছিল। কেবল অভ্যন্তরীণ বিকাশ নয়, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সাহায্য করত বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের সংগ্রামকে। দেশে দেশে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল নিপীড়িত জনগণ ও জাতিগুলির স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন কুশলতা হারায় না, বরং তা এতটাই সাফল্য অর্জন করে যে একটি পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে রূপান্তরিত সোভিয়েত শাসকরা সেই কুশলতাকে কাজে লাগিয়েই বৃহৎ শক্তি হয়ে উঠেছিল ও বিশ্ব আধিপত্যের জন্য মার্কিন শক্তির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত ছিল। আবার অধঃপতিত চিনের বর্তমান বুর্জোয়া শাসকেরা সেই কুশলতার উপর ভিত্তি করেই আজ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে বিশ্ব আধিপত্যের নোংরা খেলায় মেতে উঠেছে। 

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে গুড়িয়ে দিতে একদিকে যেমন ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির নিরন্তর প্রয়াস তেমনি ছিল অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে পরাজিত বুর্জোয়া, জমিদার ও তার তল্পিবাহকেরা এবং তার সাথে সাথে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে অনিবার্যভাবে কিছু বুর্জোয়া নিয়ম চালু থাকার জন্য সুবিধাবাদী নেতৃত্বের মধ্যে থেকে নতুনভাবে জন্ম নেওয়া বুর্জোয়াশ্রেণির নিরন্তর চক্রান্ত। সমাজতন্ত্রে যে শ্রেণি থাকে ও তার জন্য নিরন্তর শ্রেণিসংগ্রাম চালিয়েই তাকে এগোতে হয় এবং সেই সংগ্রাম নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কীভাবে চালাতে হয় এসব সম্পর্কিত বিকশিত তত্ত্ব লেনিন ও মাও সেতুঙের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে আবিষ্কার হয়েছে এবং তা শ্রমিকশ্রেণির ভান্ডারে জমা হয়েছে। তবে এসব তত্ত্বে আবার সিপিএম সহ সংসদীয় বামেদের বড় অনীহা, তারা নাকি সংসদীয় লড়াই চালিয়েই ধীরে ধীরে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে দেবে, তার জন্য খেটে খাওয়া মানুষের রাজ গড়ে তোলাটা আবশ্যিক নয়।

যুক্তির প্রয়োগ বা বৈজ্ঞানিক কোনো বিশ্লেষণ নয়, গত কয়েক দশক ধরে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাফল্য নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করতে মার্কিন ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিরাট অপপ্রচার গড়ে তুলেছে। হিটলারের পদাঙ্ক অনুসরণকারী এই শক্তি এখন প্রচার করে যে হিটলার ততখানি নয়, স্তালিনই নাকি বিপুল সংখ্যক মানুষ হত্যার জন্য দায়ী। চিনে নাকি সমাজতান্ত্রিক পর্যায়ে এমন দুর্ভিক্ষ ঘটে যাতে লক্ষ লক্ষ কৃষক মারা যায়। আর এইসব বিকৃত তথ্য নিপুনভাবে হাজির করলে নানা পুরস্কার এমনকি নোবেল পুরস্কারও জুটে যেতে পারে। এই আশায় অনেক বুদ্ধিজীবীও এই মিথ্যা প্রচারের পক্ষে কলম ধরেছেন এবং তাদের কেউ কেউ আশাতীত সাফল্যও লাভ করেছেন।    

একথা ঠিক যে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষা নিরীক্ষায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও বুর্জোয়া সংশোধনবাদী শক্তি পালটা ক্ষমতা দখল করে সমাজতন্ত্রকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু তার বদলে তারা নতুন কিছু গড়ে তোলেনি, গড়ে তুলেছে এক ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া পুঁজিবাদ যা জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়েছে এক অভাবনীয় শোষণ নিপীড়নের ব্যবস্থা। কিন্তু এটাকে যদি শেষবিচারে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার‘জয়’ বলতে হয় তাহলে ‘জয়’-এর এই সংজ্ঞা অনুযায়ী সেই ধর্ষণকারীদেরও জয়ী বলতে হয় যারা একটি মহিলার হাজার প্রতিরোধ সত্ত্বেও তাকে ধর্ষণ করে খুন করতে সক্ষম হয় এবং বিচারের প্রহসনে নির্দোষী সাব্যস্ত হয়। জয়ী বলতে হবে সেই জমিদারি ব্যবস্থাকে যেখানে জমিদারশ্রেণি ব্রাহ্মণ্যবাদী সরকার ও ব্রাহ্মণ্যবাদী বিচার ব্যবস্থার সহায়তায় ভুমি সংস্কার ব্যর্থ করে দিয়ে নিপীড়নমূলক একটি পশ্চাদপদ কৃষিব্যবস্থা বজায় রাখতে সফল হয়েছে। জয়ী বলতে হবে আদিবাসী, দলিত ও মুসলিমদের গণহত্যায় নেতৃত্বকারী সেইসব ব্যক্তিদের যারা ভারতীয় গণতন্ত্রে বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে এমনকি রাজত্বও চালাতে পারে। জয়ী বলতে হবে বিজ্ঞানের বিপরীতে সেই অপবিজ্ঞানকে, রাষ্ট্রনায়করা নিরন্তর যে অপবিজ্ঞানের প্রচার চালিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে ভীতির পরিবেশ তৈরি করে নির্বাচনে আশাতীত সাফল্য লাভ করে চলেছে। 

পুঁজিবাদের যে অসম বন্টনব্যবস্থা নিয়ে আনন্দবাজারের উদ্বেগ তা যে আনন্দবাজার কর্তৃক উচ্চপ্রসংশিত এবং বিশ্বায়নের পর্বে তা যে আরও মাত্রাছাড়া হয়ে উঠেছে সেটাই তো তার আবশ্যিক পরিণতি। বিনিয়োগকারীদের যে পশু-শক্তি(animal spirit)-র এত তারিফ করা হয় মুনাফার প্রবল ক্ষিদেইতো তার চালিকাশক্তি। রাষ্ট্র এমন কোন বন্টনের দায়িত্ব নেবে না যা পশু-শক্তির চাহিদার বিপরীতে যায় – এটাইতো বিশ্বায়নের মূলকথা। আর তার জন্যই তো গণবন্টন ব্যবস্থা বাতিল করা, কৃষিতে বিনিয়োগ কমিয়ে আনা, কৃষি ও ক্ষুদ্রশিল্পে ব্যাঙ্ক ঋণ কমিয়ে তার বদলে গাড়ি, ফ্ল্যাট ও দামি ভোগ্যপণ্য কেনার জন্য ধনীদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া, স্বাস্থ্য-শিক্ষার বেসরকারিকরণের এত উদ্যোগ। এই পশু-শক্তির চাহিদা মেটাতেই জল-জমি-জঙ্গল-খনি দখল করতে নির্বিচারে বিপুল সংখ্যক আদিবাসী ও হতদরিদ্র মানুষকে তাদের বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও পশু-শক্তির চাহিদা মেটেনি, তাই পরজীবী কর্পোরেট পুঁজির ক্ষিদে মেটাতে জনগণের ঘাড় ভেঙে তাদের বিপুল ব্যাঙ্ক ঋণও মকুব করে দেওয়া হয়েছে বা বিদেশে পালানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বায়নের দৌলতে সেই ক্ষিদে এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছে যে খোদ ভারতে একদিকে যখন ১ শতাংশ পরজীবী শ্রেণির হাতে ৭৩% সম্পদ কুক্ষিগত হয়েছে তখন ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মহাজনের দেনার দায়ে তিন লক্ষেরও বেশি কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে এবং সেই মৃত্যু মিছিল আজও অব্যাহত কেবল বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার তার পরিসংখ্যান প্রকাশ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

পুঁজিবাদের এই কঠোর বাস্তবতাকে সমাজের স্বাভাবিক নিয়ম বলে চালিয়ে দেবার পক্ষে বলাটা আনন্দবাজারের পক্ষে এখন একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়, কারণ খবরের কাগজ চালাতে হয় তো! কিন্তু সে যাই হোক যে আবশ্যিকতায় পুঁজিবাদ ক্রমাগত জনগণের উৎপাদন ক্ষমতাকে ধ্বংস করে চলবে, অসম বাণিজ্য চালিয়ে অনুন্নত দেশের জনগণের রক্তঘামে তৈরি সম্পদকে সাম্রাজ্যবাদী হায়নারা কুক্ষিগত করবে, যুদ্ধ চাপিয়ে লুন্ঠনের রাজত্ব চিরস্থায়ী করতে চাইবে সেই পরিমাণে বিশ্বজনগণও আবার প্রস্তুত হয়ে উঠবে নতুন করে জনগণের রাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, পরজীবী ফিনান্স মালিক ও পুঁজিপতিশ্রেণির হাত থেকে উৎপাদনের সমস্ত হাতিয়ার ছিনিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে এবং শেষতঃ শ্রেণিহীন সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে। সমাজতন্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষা তো মাত্র একশ বছর অতিক্রম করেছে। বলা যায় এ তো সবে শুরু। অনেক কিছুই আমাদের দেখা বাকি আছে। যেমন দেখছি পুঁজিবাদের অবাধ হিংস্রতার নতুন নতুন রূপ। ইতিমধ্যেই কোভিড-১৯ পর্বে ভারতে এই হিংস্রতা প্রকাশ পেয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি আচরণে। উপরন্তু লকডাউন পর্বে পরিযায়ী শ্রমিক ও কোটায় পাঠরত উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের প্রতি রাষ্ট্রের ভিন্ন আচরণে যে উৎকট বৈষম্য প্রকাশ পেয়েছে তার তুলনা মেলা ভার। কিন্তু এসব তো চিত্রের একটি দিক। চিত্রের অন্য একটি দিক অনিবার্যভাবেই এই লুন্ঠন ও হিংস্রতার বিরুদ্ধে সচেতন প্রতিরোধ ও শ্রেণিহীন সমাজ গড়ার সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠবে। তাই সমাজতন্ত্র নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আনন্দবাজারের স্বস্তিতে থাকাটা হয়তো খুব বেশিদিন স্থায়ী হবে না।  

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *