বিপ্লবী পরিস্থিতিকে বাগে আনতে অতিমারিকে কাজে লাগাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ: পেরুর কমিউনিস্টদের বিবৃতি
‘অতিমারি এবং সাম্রাজ্যবাদের সংকট’ শিরোনামে পেরু পিপলস মুভমেন্টের এই বিবৃতিটি গত মার্চে প্রকাশিত হয়েছে। এর গুরুত্ব বুঝে আমরা এটি বাংলায় প্রকাশ করলাম। অনুবাদ করেছেন অর্পণ কুন্ডু।
“কলেরা, টাইফাস, টাইফয়েড জ্বর, গুটিবসন্ত এবং অন্যান্য ধ্বংসাত্মক রোগগুলি শ্রমিক শ্রেণির বাসস্থানগুলির ক্ষতিকর বাতাসে এবং বিষাক্ত জলে তাদের জীবানু ছড়িয়ে দেয়| এইসব জায়গায় খুব কম জীবানুই পুরোপুরি মারা যায় এবং পরিস্থিতি অনুকূল হবার সাথে সাথে এগুলি মহামারিতে পরিণত হয় এবং তারপরে তাদের প্রজননস্থানগুলি ছাড়িয়ে পুঁজিপতিদের যেসব জায়গায় থাকে, শহরের সেইসব আরও বায়ু বহুল এবং স্বাস্থ্যকর অংশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, নিজেকে দায়হীন ভাবে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে মহামারিজনিত রোগ সৃষ্টির আনন্দকে অনুমতি দিতে পারে না| পরিণতিগুলি তার ওপর এসে পড়ে এবং মৃত্যুর দেবদূত তার নিজের মহলে শ্রমিকদের মতোই নির্মমভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করে|
এই বাস্তবতা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে পরোপকারী বুর্জোয়ারা তাদের কর্মীদের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য মহৎ চেতনার প্রতিযোগিতায় উতরোতে উঠেপড়ে লাগে। কিছু সংগঠন তৈরি হয়, বই লেখা হয়, বিভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, আইন নিয়ে বিতর্ক হয় এবং সেগুলি পাস হয়, যাতে বারংবার হওয়া মহামারির উৎসমুখগুলি বন্ধ করে দেওয়া যায় |”
– ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, দ্য হাউজিং কোয়েশ্চেন।
“রাষ্ট্রের প্রশ্নটি এখন তত্ত্ব এবং ব্যবহারিক রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করছে |
সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, একচেটিয়া পুঁজিবাদকে রাষ্ট্রীয়-একচেটিয়া পুঁজিবাদে রূপান্তর করার প্রক্রিয়াটিকে প্রবলভাবে ত্বরান্বিত ও তীব্র করেছে। রাষ্ট্র দ্বারা শ্রমজীবী জনগণের উপর এমনিতেই
ভয়ঙ্কর অত্যাচার চালানো হয়, রাষ্ট্র এখন সর্বশক্তিমান পুঁজিবাদী সংগঠনগুলির সঙ্গে যুক্ত
হয়ে যাওয়ার ফলে সেই অত্যাচার আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। উন্নত দেশগুলিতে
শ্রমিকরা সামরিক কারাগারের মতো জীবনযাপন করছে(অবশ্যই তা করা হচ্ছে লোকচক্ষুর
অন্তরালে)|
দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা যুদ্ধের অভূতপূর্ব ভয়াবহতা ও দুর্দশা জনসাধারণের অবস্থাকে অসহনীয় করে তুলছে এবং তাদের ক্রোধ বাড়িয়ে তুলছে | আন্তর্জাতিক সর্বহারা বিপ্লব স্পষ্টভাবে আরও পরিণত হয়ে উঠছে | রাষ্ট্রের সাথে এর সম্পর্কের প্রশ্নটি ব্যবহারিক গুরুত্ব অর্জন করছে।”
–ভি . আই . লেনিন , রাষ্ট্র ও বিপ্লব
বর্তমান করোনা ভাইরাস (COVID-19) অতিমারি জনগণের কাছে সাম্রাজ্যবাদের সাধারণ ও অন্তিম সংকট এবং বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ভূমিকাকে স্পষ্ট করে দিয়েছে| অন্যান্য সমস্ত মহামারি, পুঁজিবাদ কর্তৃক পরিবেশের ধ্বংস সাধন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতোই, করোনা ভাইরাস জনিত রোগটিও সর্বাপেক্ষা বেশি নিপীড়িত দেশগুলিতে এবং সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতেও শোষিত জনতা, প্রধানত দরিদ্রতম মানুষ, শ্রমজীবী মানুষের আশেপাশের এলাকায় ক্ষতিসাধন করছে| ঠিক যেভাবে এঙ্গেলস চিহ্নিত করেছেন, যখন মহামারিটি সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া শ্রেণিকে ব্যক্তিগত ভাবে এবং তার ব্যবস্থাকে ভীতিপ্রদর্শন করে, তখনই একটি ‘বিশ্বব্যাপী সঙ্কট’ ঘোষিত হয় এবং বিভিন্ন নাটকীয় পদক্ষেপ কার্যকর করা হয়| অথচ বিশ্বে প্রতিদিন ২৫,০০০ মানুষ খিদেয় মারা যান, ৩০০০ শিশু প্রতিরোধযোগ্য ম্যালেরিয়াতে মারা যায়, এমনকি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতেও প্রতিদিন হাজারে হাজারে মানুষ মারা যান, কারণ তাদের কাছে চিকিৎসা করার জন্য অর্থ নেই বা চিকিৎসা করার জন্য অপেক্ষা করতে করতে মারা যান কারণ ‘কোনও ব্যবস্থা নেই’। সেগুলিকে সংকট বলে ঘোষণা করা হয় না।
আরও পড়ুন: ‘করোনার বিরুদ্ধে ধর্ম ঘুমাচ্ছে, বিজ্ঞান লড়ছে’-একটি বুর্জোয়া ভাঁওতাবাজি
সমস্ত দেশের শাসকশ্রেণি এবং এর রাষ্ট্র ও সরকার কর্তৃক গৃহীত বর্তমান পদক্ষেপগুলি আমাদের দুটি বিষয় দেখায়: প্রথমত, তাদের মূল লক্ষ্যটি সাধারণভাবে মানুষের জীবন বাঁচানো নয়, বরং বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণির লোকদের এবং তাদের মুনাফা, মূলধন এবং প্রয়োজনীয় শ্রমশক্তিতে তাদের কর্তৃত্ব রক্ষা করা; এবং দ্বিতীয়ত, তারা অতিমারির অজুহাত দেখিয়ে শোষণ-নিপীড়নের বুর্জোয়া রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যবাদকে রক্ষা করার জন্য কিছু মরিয়া চেষ্টা চালায়, যেগুলি করবে বলে তারা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল। এগুলি হল, দুনিয়ার পুনর্বিভাজনের জন্য যুদ্ধ, তীব্রতর নিপীড়ন, খোলামেলা একনায়কতন্ত্র, বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা। যদিও ভাইরাসের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা যথাযথ এবং প্রয়োজনীয়, পাশাপাশি মনে রাখা প্রয়োজন শ্রমিকদের শোষণ করার উপযুক্ত রাখার জন্য তাদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে যত্ন নেওয়াটাও শোষণকারীদের দিক থেকে জরুরি (তবে যতটা লাভজনক ঠিক ততটুকুই)। তবে সবটাই করা হয় শাসক শ্রেণির স্বার্থরক্ষা ও সংকটকালে সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজন অনুসারে।
এই মহামারি ব্যয় সংকোচন এবং ‘নয়া উদারনৈতিক’ নীতি দ্বারা স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিচালনার ফলে সৃষ্ট মারাত্মক পরিস্থিতি সামনে এনেছে, এমনকি সবচেয়ে ‘নয়া উদারনৈতিক’ রাজনীতিবিদরাও জাতীয়করণ ও রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীকরণ দাবি করছেন| সংশোধনবাদীরা সাম্রাজ্যবাদকে তোল্লাই দেওয়ার ভূমিকা পালন করে এ জাতীয় দাবিকে উৎসাহের সাথে প্রশংসা করছে এবং ‘সামাজিক সংস্কার’ এবং ‘নয়া উদারনীতির পরাজয়’(নাকি!)-এর বাণী শোনাচ্ছে। বাস্তবে, যা ঘটছে তা হ’ল বুর্জোয়া রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যটি স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ হয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। “আধুনিক রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা বুর্জোয়াদের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি দেখভাল করার একটি কমিটি ছাড়া কিছু নয়” (কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার) | বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ভূমিকা হ’ল সঙ্কটের প্রভাব থেকে বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজিদের রক্ষার জন্য কেন্দ্রীভূত শক্তি এবং রাষ্ট্রীয় কোশাগার ব্যবহার করে পুরো শাসক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করা এবং জনগণের আন্দোলন দমন করা। জনগণের কাছে এখন আরও স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে যে রাষ্ট্রগুলি, যারা বলেছিল যে তাদের নাকি জনগণের মৌলিক প্রয়োজন সুনিশ্চিত করার জন্য ‘সংস্থান নেই’, বৃহৎ উদ্যোগপতিদের ‘সুরক্ষা’ দেবার জন্য তাদের সীমাহীন সম্পদ রয়েছে, তা সে বর্তমান সরকার নিজেকে ‘বাম’ বা ‘ডান’ যাই বলুক না কেন।
বর্তমান মহামারিটি সম্পূর্ণ ভাবে এই শোষণযন্ত্র এবং সমগ্র বুর্জোয়া শ্রেণির সামগ্রিক একনায়কত্বকে শক্তিশালী ও সামরিকীকরণের অজুহাত হিসাবে কাজ করছে, ঠিক যেমন ২০০১ সালের ৯/১১-এর ক্ষেত্রে হয়েছিল| বর্তমানে কারফিউ দিয়ে জনসাধারণের জমায়েত ও চলাচল ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, তার মধ্যে দিয়ে বিশ্বজুড়ে তৈরি হওয়া বিপ্লবী পরিস্থিতি(অসম বিকাশ সহ) এবং তীব্র গণ আন্দোলনগুলিকে দমন করার জন্য তৈরি করা পরিকল্পনাগুলিকে দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর করা হচ্ছে। এখন তারা সেই সব পদক্ষেপকে বৈধতা দিতে পারছে যা মহামারি না হলে বৈধতা দেওয়া অসম্ভব ছিল| মাত্রাতিরিক্ত শোষণ, বিশ্বের নতুন পুনর্বিভাজন এবং গণহত্যাময় যুদ্ধের দ্বারা সাম্রাজ্যবাদকে তার সাধারণ ও চূড়ান্ত সংকট থেকে বাঁচানোর যে ব্যর্থ চেষ্টা করা হচ্ছে, তার জন্য তাদের আরও প্রকাশ্য স্বৈরতন্ত্র, আরও প্রতিবিপ্লবী হিংসা ও দমননীতির প্রয়োজন| মহামারি তাদেরকে এই সবকিছু করার অনুমোদন দিচ্ছে এবং তথাকথিত ‘সংকট কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজনীয় জাতীয় ঐক্য’-র আড়ালে জনগণের মতামতকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। যা কিনা, প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যবাদী বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণির একনায়কতন্ত্রের অধীনে ‘ঐক্য’ ছাড়া কিছু নয়| জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে দু’জনের বেশি সমবেত হওয়া নিষিদ্ধ করেছে। বিভিন্ন দেশ সরকারিভাবে বিভিন্ন ধরনের বৈদ্যুতিন নজরদারি করার অনুমতি পেতে নতুন আইন এনেছে, জরুরি অবস্থার দ্রুত বাস্তবায়নের সুবিধার্থে আইন ইত্যাদি আনছে| মহামারির মধ্যে, ইয়াঙ্কি সাম্রাজ্যবাদ মাদুরোর বিরুদ্ধে ‘ফৌজদারি অভিযোগ’ এনে ভেনেজুয়েলা আক্রমণ করার প্রস্তুতি ত্বরান্বিত করছে এবং ইউরোপে ন্যাটো সামরিক অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছে।
সর্বহারা শ্রেণি ও জনগণের শত্রু কেবল ‘নয়া উদারনীতি’ নয়, পুরো পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, সাম্রাজ্যবাদ। সাম্রাজ্যবাদীদের দরকার হলে, তারা তারা রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ, জাতীয়করণ, কেন্দ্রীকরণ এবং কর্পোরেটিজম ব্যবহার করবে; জনগণকে তাদের শয়তানি প্রতিক্রিয়াশীল পরিকল্পনার অঙ্গ করে তুলতে তারা সংশোধনবাদী এবং ফ্যাসিবাদীদের সাহায্য পাবে এবং প্রয়োজনে তাদের ‘লাল’ রঙে রাঙিয়ে নেবে| কিন্তু জনগণ এতো সহজে বোকা বনবে না, প্রতিটি প্রতিবিপ্লবী পদক্ষেপ ও গণহত্যাকারী যুদ্ধ আরও বেশি করে প্রতিরোধ, আরও বেশি করে বিপ্লবের জন্ম দেবে। আমরা যে সংকটটি উপলব্ধি করছি তা হ’ল শোষণ ও নিপীড়নের একটি ব্যবস্থার মরণ সংকট, সাম্রাজ্যবাদের মৃত্যুযন্ত্রণা। আন্তর্জাতিক সর্বহারা শ্রেণি এবং নিপীড়িত জনগণের জাগরণ ঘটছে এবং তারা বিপ্লবের ডাক দিচ্ছে। কমিউনিস্ট পার্টির কর্তব্য হল অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে বিকশিত করে সংগ্রামরত জনগণকে পরিচালনা ও নেতৃত্বদান করা- স্বাস্থ্য পরিষেবার অধিকার দাবি করা- ক্ষমতা দখলের জন্য সংগ্রামকে পরিচর্যা করা, সবসময় সংশোধনবাদকে প্রধান বিপদ হিসাবে উন্মোচিত করে লড়াই চালিয়ে যাওয়া ; সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনযুদ্ধের লক্ষ্যে প্রতিটি দেশে জনযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া, শুরু করা এবং বিকাশ ঘটানোর জন্য জনগণকে সমাবেশিত করা এবং সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত জনযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া|
পেরু পিপলস মুভমেন্ট
মার্চ, ২০২০