‘করোনার বিরুদ্ধে ধর্ম ঘুমাচ্ছে, বিজ্ঞান লড়ছে’-একটি বুর্জোয়া ভাঁওতাবাজি
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা কথা খুব চালু হয়েছে। করোনার বিরুদ্ধে ধর্ম ঘুমাচ্ছে, বিজ্ঞান লড়ছে। কথাটার মধ্যে ভুল নেই কিন্তু রয়েছে বিশাল একটা ফাঁক। এই ফাঁক বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের সচেতন ভাবে তৈরি করা। করোনার বিরুদ্ধে ‘ধর্ম ঘুমাচ্ছে, বিজ্ঞান লড়ছে’ কথাটার মধ্যে ফাঁক কেন বলছি? বলছি বিষয়টা শুধু ধর্ম আর বিজ্ঞানের নয়, বিষয়টার সাথে দর্শনের প্রশ্নও ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। আর এটাই চাপাঢাকা দেওয়ার চেষ্টা বুর্জোয়াদের। এর পিছনে লুকিয়ে আছে বুর্জোয়া শ্রেণি স্বার্থ।
আরও পড়ুন: কোভিড ১৯: ভাইরাসটি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, এর সামাজিক উৎসও ততটাই
এখন দেখা যাক ভাববাদ না বস্তুবাদ কোন ধারার দর্শনকে ভিত্তি করে বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে, আবার বিজ্ঞানের অগ্রগতি সেই ধারার দর্শন কে সমৃদ্ধ করেছে। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে মার্কস-এঙ্গেলসই প্রথম প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সমাজ বিজ্ঞানের সঙ্গে দর্শনের সজীব ও দ্বান্দ্বিক সম্পর্ককে সামনে নিয়ে আসেন।
ভাববাদী দর্শন কি বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটাতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে? এই প্রসঙ্গে ঢুকতে গেলে খুব সংক্ষিপ্ত আকারে ভাববাদী দর্শনের মূল বক্তব্যকে সামনে নিয়ে এসেই এর বিচার করতে হবে। ভাববাদী দর্শনের মূল কথাই হল বস্তু নয়, চেতনা হচ্ছে প্রাথমিক। আত্মা, মন, ধারণা, সংবেদন পুঞ্জ, উপাদান প্রভৃতি ভাববাদীদের মতে পরম সত্য। চেতনা নিরপেক্ষ প্রকৃতি ও বস্তু জগতের অস্তিত্ব ভাববাদীরা মানে না। বিষয়ীগত বা আত্মগত, ভাববাদী দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ এই দুই ধারার মোটের উপর বক্তব্য একই। তাই ভাববাদী দর্শন ঈশ্বর, আত্মা, কর্মফল, পরলোক, জন্মান্তর প্রভৃতি ধর্মীয় বিস্বাসকেই উৎসাহিত করে। এখুন ভাবুন করোনার টিকা আবিষ্কার না করতে বসে বিজ্ঞান যদি এটা ভাবতে শুরু করে সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা, এত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে কর্মফল, তাহলে ক্যান্সার থেকে করোনাতে মৃত্যুর জন্য দিনগোনা ছাড়া আর কিছু করার উপায় থাকে না। ভাববাদ অতিপ্রাকৃতিক শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো কিছু দিতে পারেনি, দিতে পারবেও না। এই কারণেই বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায় ভারতে চিকিৎসা শাস্ত্র থমকে যাওয়ার জন্য ভাববাদী দর্শন নির্ভর বর্ণবাদী ব্যবস্থা এবং ব্রাহ্মণ্যবাদকেই দায়ী করেছিলেন।
বস্তুই প্রাথমিক, চিন্তা চেতনা, সংবেদন আসলে অনেক উন্নত পর্যায়ের পরিণাম মাত্র- এই হল বস্তুবাদী দর্শনের মূল কথা। বস্তু ছাড়া চেতনা বলে কিছু থাকে না, দেহ ছাড়া আত্মার অস্তিত্ব নেই ,বস্তুবাদী এই জ্ঞানতত্বের সাথে আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সামঞ্জস্যপূর্ন। মহাবিশ্বে বস্তুর বিবর্তন, বিস্ফোরণ, এবং বস্তুকনার বিশেষ সমাহার থেকেই প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে, চেতনা তার অনেক পরের বিষয়। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান সূক্ষাতিসূক্ষ এবং অদৃশ্য অনেক তরঙ্গ আবিস্কার করতে পারলেও দেহহীন চৈতন্যর ধারণাকে অনেক আগেই নাকচ করে দিয়েছে। আর বস্তুবাদী দর্শনকে পাথেয় করেই আসে প্রকৃতির নিয়মগুলোকে জানার মধ্যে দিয়ে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করার হিম্মত, প্রকৃতিকে জয় করার প্রেরণা।
বুর্জোয়ারা মুনাফার কথা হিসেবে রেখে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বস্তুবাদী দর্শন (অধিবিদ্যক) কে অনুসরণ করলেও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তারা ভাববাদী দর্শনকেই তোল্লাই দিয়ে এসেছে। কারণ ভাববাদী দর্শন বৈষম্যমূলক সামাজিক কাঠামোকে চিরস্থায়ী করার নিদান দেয় কর্মফল, ঈশ্বর প্রভৃতি ধর্মীয় আবরণের মধ্যে দিয়ে।যা বুর্জোয়াদের শোষণ- সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার জিয়নকাঠি। আর যেটুকু বিজ্ঞানকে বুর্জোয়ারা কাজে লাগায় সেটাও যান্ত্রিক বস্তুবাদ যার সীমাবদ্ধতা হল প্রকৃতি অপরিবর্তনশীল এবং গতিহীন। আর বুর্জোয়াদের কাছে তো ধনতন্ত্রই হল ইতিহাসের সমাপ্তি। আর এই শ্রেণি স্বার্থের জায়গা থেকেই বুর্জোয়ারা করোনার বিরুদ্ধে ‘ধর্ম ঘুমাচ্ছে বিজ্ঞান লড়ছে’ এই ধরনের অর্ধ সত্য (যা মিথ্যের থেকেও ভয়ঙ্কর) বক্তব্য হাজির করেছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে ধর্মীয় মতাদর্শকে তোল্লাই দেওয়ার পর আজ অতিমারি ঠেকাতে ধর্মীয় সমাবেশ বন্ধ করতে গিয়ে এই সব কথা বলতে হচ্ছে বুর্জোয়াদের।জনগণকে বিপর্যস্ত করে, শোষণের জন্য ভাববাদে আকণ্ঠ ডুবিয়ে রেখে, বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার এই জ্ঞান দেওয়াটা তাদের অসহায়তা নিয়ে বিদ্রূপ করারই সামিল।
এই অর্ধসত্য বক্তব্য হাজির করার মধ্যে দিয়ে বুর্জোয়ারা মুনাফার জন্য উৎপাদন করতে গিয়ে পরিবেশের যে বারোটা বেজে তেরোটা বাজিয়ে ছেড়েছে, তাকে ঢাকা দিতে চাইছে। চিন না আমেরিকা কার গবেষণাগার থেকে করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে সেটা বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হল সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো বাজার দখলের স্বার্থে জীবানু যুদ্ধ করার জন্য তাদের গবেষণাগারে এই ধরনের মারণ ভাইরাসের পরীক্ষা চালাচ্ছিল, আম জনতার উন্নতিসাধনের জন্য নয়। এই প্রসঙ্গে বলে রাখাই যায় আগামীদিনে করোনার ভ্যাকসিন আবিস্কার হলেও প্রয়োগের ক্ষেত্রে অসাম্যই থাকবে, উপরতলার মানুষগুলোই তা আগে পাবে, অনেক পরে তা নীচে নামবে। এমনকি বর্তমানে দুনিয়া জুড়ে করোনার যে চিকিৎসা চলছে, সেখানেও ব্যাপক মানুষের মৃত্যুর জন্য মূলত দায়ী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে দুর্বল করে স্বাস্থ্য পরিষেবার বেসরকারিকরণ।আর সাধারণ ভাবে আমরা তো জানিই, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে যার কাছে বেশি টাকা, সেই উন্নত চিকিৎসার সুযোগ পায়। চিকিৎসা বিজ্ঞান যতই এগোক, তা গরিব মানুষের কোনো কাজে লাগে না। যতদিন ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য উৎপাদন থাকবে ততদিন পরিবেশ ধ্বংস থেকে যুদ্ধ সবই থাকবে এবং তা বাড়বে বই কমবে না। আর ততদিন বুর্জোয়ারা অপরিবর্তনশীল, গতিহীন যান্ত্রিক বস্তুবাদকে আঁকড়ে ধরে ‘ধর্ম ঘুমাচ্ছে, বিজ্ঞান লড়ছে’ এই ধরনের ভাঁওতাবাজি বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে তাদের অপরাধকে চাপাঢাকা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবে।
মার্কস-এঙ্গেলস এর কৃতিত্ব এখানেই তাঁরা বস্তুবাদকে যান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত করে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে উন্নীত করেন, যা প্রকৃতি ও সমাজবিজ্ঞানের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ, লেনিন-মাও একে আরো সমৃদ্ধ করেন। প্রকৃতি ও সমাজবিজ্ঞানে দান্দ্বিকতার খুব সহজ উদাহরণ হচ্ছে ‘গণিতে +ও –, বলবিদ্যায় ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া, পদার্থবিদ্যায় ধন বিদ্যুৎ ও ঋণ বিদ্যুৎ, রসায়নে পরমাণুগুলোর সংযোজন ও বিয়োজন, সমাজবিজ্ঞান‘শ্রেণী সংগ্রাম’ (দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে- মাও)। এই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনের উপর ভিত্তি করেই প্রকৃতি এবং সমাজ বিজ্ঞানের সমস্ত ঘটনাকে ব্যাখ্যা এবং সঠিক অবস্থান নেওয়া সম্ভব। আর মাও তো কবেই বলে গেছেন, মানুষের সঠিক চিন্তা আসে উৎপাদনের সংগ্রাম, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং শ্রেণি সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে।
শ্রেণি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মেহনতি জনতার মধ্যে সঠিক চিন্তা যত প্রতিষ্ঠিত হবে, ততই বিজ্ঞান সম্পর্কে বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গির ভাঁওতা ফাঁস হবে।
এই লেখার শিরোনাম দেখে যে আগ্রহ জাগল, লেখা পড়ে সেটা পূর্ণ হলো না। কে কবে কী বলে গেছেন, সে সব বহুশ্রুত বাণী স্তুতির মতো শোনালো। কিন্তু ধর্ম ঘুমাচ্ছে আর বিজ্ঞান লড়ছে বললে ভাঁওতা হলো কোনটা, সে সব বিশ্লেষণ এল না।