“আমি শক্তের কাছে জোর হাত
“আমি শক্তের কাছে জোর হাত
অনেক বছর আগে বিপ্লবী কবি সরোজ দত্ত আমাদের এই আধা সামন্ততান্ত্রিক দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সুবিধাবাদী অবস্থানকে এই ভাবেই কবিতায় তুলে ধরেছিলেন। আজ এই লক ডাউনের মধ্যে মাথায় সরোজ দত্তের কবিতার এই লাইনগুলো বার বার করেই সামনে চলে আসছে। সামনে চলে আসছে মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদী অবস্থান। যে সুবিধাবাদী অবস্থানকে ভর করেই রাষ্ট্র জোরেসোরে এখানে বেসরকারিকরণ- উদারিকরণ লাগু করতে পেরেছে। লাগু করতে পেরেছে বিশ্বব্যাংক নির্দেশিত ‘কেবল ক্রেতার জন্য স্বাস্থ্য’ পলিসি। করোনা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই কঙ্কালসার অবস্থাকে সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সব বুঝেও কিন্তু শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একটা বড়ো অংশ চুপ। কারণ এখানে মুখ খুলতে গেলে মুখ খুলতে হবে ‘শক্তিশালী’ রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।
লকডাউনের পরিস্থিতিতে দিনমজুর বা পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা নিয়ে নানা জায়গায় আলোচনা হচ্ছে। আলোচনা হচ্ছে ছোটো ব্যবসায়ী, দোকান মালিকদের সমস্যা নিয়েও। এ সবের মধ্যেই চাপা পড়ে যাচ্ছে গৃহ পরিচারিকা ও রাঁধুনিদের কথা। করোনার প্রকোপের কথা ছড়িয়ে পড়তেই বহু পরিবারে গৃহ পরিচারিকাদের কাজে আসতে বারণ করে দেওয়া হয়। সেই সংখ্যাটা বিপুল বেড়ে যায় সরকারি ভাবে লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর। যারা তাঁদের কাজে আসতে বারণ করেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আগেভাগেই কিংবা এপ্রিলের শুরুতে তাঁদের বেতন দিয়ে দিয়েছেন।কিন্তু একটা বেশ বড়ো অংশ কাজ না করার দিনগুলোর বেতন দেননি। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই, যারা কাজের মেয়েদের এই সময় বেতন দিচ্ছে না, নিজেদের কর্মক্ষেত্রে তারা সকলে পুরো বেতন পাচ্ছেন বা তাদের কাজের নিশ্চয়তা রয়েছে। এদের সম্পর্কে যেটা বলার তা হল-
“সেথা বিনি চুনে আমি সাঁচি পান খাই
বিনি নুনে খাই আন্ডা
আর কানমলা খেয়ে রাগে জ্বলে উঠি
লাথি খেয়ে হই ঠান্ডা”।
এরা নিজেদের কর্মস্থলে কোনো আন্দোলন-প্রতিবাদে থাকেন না। এই কঠিন সময়ে যে তার নিয়োগকর্তারও উচিত যতদূর সম্ভব কর্মীদের পাশে থাকা, এই দাবিটা করতে তারা ভুলে গেছেন। ঠেলায় না পড়লে তারা কখনওই লড়াইয়ের পথে হাঁটবেন না। তবু তাদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা বোঝা যায়। কিন্তু আমার-আপনার পরিচিত এমন অনেকেই রয়েছেন, যাদের যথেষ্ট ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তারা পরিচারিকা ও রাঁধুনিদের বঞ্চিত করছেন। প্রথম অংশের কাছে যেটা নিজেদের জীবনের বাস্তবতা, দ্বিতীয় অংশের কাছে সেটা মতাদর্শগত অবস্থান। নো ওয়ার্ক নো পে। পরিচারিকার মাস মাইনে লোপাট করার মধ্যে রয়েছে এক পার্থিব সুখ। যে সুখ থালা-বাটি বাজানো বা ঘর অন্ধকার করে প্রদীপ জ্বালানোর মধ্যে রয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তার টেলিভাইসড ভাষণে মালিকশ্রেণিকে ‘অনুরোধ’ করেছেন কর্মীদের ছাঁটাই না করতে। কিন্তু এই কঠিন সময়ে পুরো বেতন বা বেতনের কিছু অংশ দেওয়ার অনুরোধটুকুও করেননি। যদিও তিনি সকলকে অন্তত একটি গরিব পরিবার যাতে অভুক্ত না থাকে, তা দেখতে বলেছেন। অর্থাত রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই সরল সত্যটি দেখতে চান না। তারা শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করতে পারছেন না। যতদিন না সরাসরি নিজেদের ওপর আক্রমণ নামে, তা তারা দেখতে পাবেনও না।
গৃহ পরিচারিকা ও রাঁধুনিরা এখন অত্যন্ত উদ্বিগ্ন, কারণ মার্চ মাসের কিছু টাকা তারা হয়তো পেয়েছেন কিন্তু এপ্রিলের কিছুই পাবেন না। এই পরিস্থিতিতে একমাত্র উপায় কাজলের লোকদের সংঘবদ্ধ আন্দোলন। কিন্তু সেখানেই রয়েছে সমস্যা। আমাদের দেশের আধা সামন্ততান্ত্রিক চরিত্রের কারণে ঠিকা কাজ করতে আসা অসংগঠিত মানুষগুলো একদিকে যেমন ঐক্যবদ্ধ নয়। তেমনি তাদের মধ্যে এই শঙ্কা কাজ করে যে, আজ যদি তারা আন্দোলন করেন, তাহলে কাল পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলে, তার কাজ থাকবে না।সঙ্গে রয়েছে ‘অন্নদাতা’র বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে না চাওয়ার সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতি। ফলে শুধু এ সময় নয়, বিভিন্ন সময়েই নানা বঞ্চনার শিকার হন তারা।
এই চূড়ান্ত অসংগঠিত অংশকে সংগঠিত করা কঠিন। তাই এদের সংগঠিত করার চেষ্টার পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, এদের অধিকাংশের শিকড় রয়েছে গ্রামীণ অঞ্চলে। অনেকেই গ্রামাঞ্চল থেকে সরাসরি কাজে আসেন, অনেকে শহরে থাকলেও পরিবারের অনেকেই গ্রামে থাকেন। তাই গ্রামীণ কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে এরা একাত্ম বোধ করেন, তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। এরা প্রায় সকলেই ভূমিহীন বা ক্ষুদ্র কৃষক পরিবার থেকে আসা। ওই শ্রেণিগুলির আন্দোলন জোরদার হলে এরাও শহরে বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। যা তাদের নিয়োগকর্তা মধ্যবিত্তদের বাধ্য করবে কর্মস্থলে আন্দোলনের পথে হাঁটতে বা প্রতিবাদের ভয়ে কাজের লোকদের প্রতি ন্যায্য ব্যবহার করতে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির ‘বিবেকহীনতা বা উদাসীনতা’ দেখে হতাশ না হয়ে, তাদের মধ্যে মানবিকতা জাগানোর কাজে শক্তিক্ষয় না করে কৃষক আন্দোলনের বুনিয়াদি কাজেই প্রগতিশীল শক্তিগলির মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা উচিত। যা হয়তো প্রধানমন্ত্রীকে বাধ্য করবে অনুরোধকে নির্দেশে পরিণত করতে। জনগণের উপকার করার জন্য নয়, নিজের গদি সামলাতে।