করোনা সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র পালটে দেয়নি, এখনও তৃতীয় বিশ্বই দুনিয়া বদলের লড়াইয়ের ভরকেন্দ্র
২ থেকে ৯ এপ্রিল, যখন গোটা দুনিয়ায় মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মরছিল এবং অর্থনীতি নাকি ধসে পড়েছিল, সে সময় দুনিয়ার প্রথম সারির ১০ জন বিলিওনেয়ার মোট ৫১ বিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছেন। দেখে নেওয়া যাক এই সময়কালে কার কত টাকা পকেটে ঢুকলো।
ওয়ারেন বাফেট- ৫ বিলিয়ন ডলার
ল্যারি এলিসন- ৪ বিলিয়ন ডলার
বিল গেটস- ৩.৬ বিলিয়ন ডলার
জেফ বেজোস- ৬.৮ বিলিয়ন ডলার
মুকেশ অম্বানি- ৪.৪ বিলিয়ন ডলার
বার্নার্ড আরনল্ট- ৬.৩ বিলিয়ন
আমানশিও ওর্তেগা- ৭.২ বিলিয়ন
এলন মাস্ক- ৪.২ বিলিয়ন
মার্ক জুকেরবার্গ- ৬.২ বিলিয়ন
ল্যারি পেজ- ৩.৬ বিলিয়ন
অর্থাত একথা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে করোনায় বহুজাতিক হাঙরদের মুনাফা তেমন কমেনি। কারণ দুনিয়া জুড়ে যত মৃত্যুমিছিল, যত লকডাউনই থাক, আধুনিক সভ্যতার মূল ক্ষেত্রগুলো চলেছে নিয়মিত ভাবেই। শক্তি, টেলিকম, আইটি, খনি, ইস্পাতের মতো মূল মূল শিল্পগুলো সেভাবে ব্যাহত হয়নি কোনো দেশের লকডাউনেই। উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন চলেছে নিয়ম মেনেই। একটাই গুরুতর সমস্যা হয়েছে, তা হল পরিবহণ।
আরও পড়ুন: শুধু ত্রাণ দেবেন, অধিকারগুলো জানাবেন না কমরেড?
পরিবহণের সমস্যার জন্য বহু উৎপাদিত পণ্য জায়গামতো নিয়ে আসা যায়নি আর জমে থাকা পণ্য বিক্রি হয়নি। এর বাইরে যেটা বড়ো সমস্যা, তা হল পরিষেবা ক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রটিতে এই মুহূর্তে দুনিয়ার অসংগঠিত শিল্প শ্রমিকদের সিংহভাগ কাজ করেন। করোনার ধাক্কায় তাদের অনেকেই কাজ হারাবেন। পরিষেবা ক্ষেত্রে ধাক্কা লাগায় তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে বড়ো রকমের টালমাটাল তৈরি হবে কিছুদিনের জন্য হলেও।
স্বাভাবিক ভাবেই এই সমস্যাগুলো সারা পৃথিবীতে হলেও ভারতে বেশিরভাগ মানুষের রুটিরুজি কৃষির ওপর নির্ভরশীল। করোনা ভারতের কৃষিক্ষেত্রে এখনও চোখে পড়ার মতো প্রভাব ফেলতে পারেনি। যেমন মরশুমি বৃষ্টির ওপর তা নির্ভরশীল ছিল, তেমনই থাকবে। কৃষকরা যে গতিতে আত্মহত্যা করত, তেমনই থাকবে, করোনার জন্য আত্মহত্যার হার তেমন বাড়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে আমূল ভূমি সংস্কারের জন্য সংগ্রামের প্রয়োজন যেমন ছিল তেমনই থাকবে।
প্রথম বিশ্বে আর্থিক মন্দা ছিলই, তার মধ্যে করোনা-মহামারিতে বহু মানুষ কাজ হারাবেন এবং সকলের জন্য সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার দাবি উঠবে। এই দুটি সম্ভাবনা অনেকেই দেখছেন। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, বামপন্থী এবং গণতান্ত্রিক মহল থেকে করোনার হাত ধরে দুনিয়া জুড়ে ফ্যাসিবাদের থাবা বড়ো হয়ে ওঠার আশঙ্কা প্রকাশ করে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে তেমনই সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ঢেউ ওঠার সম্ভাবনার কথাও বহু বুদ্ধিজীবী বলছেন। এমনকি ফ্যাসিবাদের পক্ষে থাকা বুদ্ধিজীবীরাও এই ধরনের আতঙ্ক প্রকাশ করে লেখালিখি করছেন। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে একাংশের বামপন্থী, প্রগতিশীলরা মনে করছেন- প্রথম বিশ্বে বিপ্লবী আন্দোলন তীব্র হবে এমনকি কোনো কোনো দেশ পুঁজিবাদের শৃঙ্খল থেকে মুক্তও হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু তেমনটা ভেবে নেওয়া ঠিক হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হওয়ার পর থেকেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে পুঁজি ও পণ্য রফতানির পশ্চাদভূমি হিসেবে ব্যবহার করে। এই সব দেশগুলি থেকে কাঁচামাল লুঠ করে। এবং এখান থেকে লুঠ করা মুনাফা কাজে লাগিয়ে নিজেদের দেশের শ্রমিক শ্রেণির একাংশকে অনুগত অভিজাত শ্রমিক বানিয়ে নেয়। এই সত্যকে মাথায় রাখলে আমরা দেখতে পাবো, এবারও তেমনই হতে চলেছে। করোনা-পরবর্তী সময়ে উন্নত দুনিয়ার যেসব শ্রমিক কাজ হারাবেন, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ভাতার অর্থ সাম্রাজ্যবাদ তৃতীয় বিশ্বকে শোষণ করেই জোগাড় করবে। ইউরোপ-আমেরিকায় যদি তারা স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পুঁজি বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করতে বাধ্যও হয়, সেই টাকাও আসবে তৃতীয় বিশ্ব থেকেই।
সেই মুনাফা করার জন্য, তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকদের ওপর শোষণ যে তীব্রতর হতে চলেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই শোষণের একটা নয়া রূপ হবে কর্মস্থলে ‘শারীরিক দূরত্ব’ রক্ষা করার জন্য কম শ্রমিকে কাজ। তার জন্য কাজের সময় বাড়ানোর চেষ্টা এবং আরও বেশি প্রযুক্তির ব্যবহার। কাজের চরিত্রের আরও বেশি অস্থায়ীকরণ ও আমরা এখন কল্পনাও করতে পারছি না, এমন নানাকিছু। সকলের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে গণ আন্দোলন এদেশেও তীব্র হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে নিশ্চিত থাকুন, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও তা হবে নামমাত্র, বরং স্বাস্থ্যবিমা সংস্থাগুলিকে আরও সৃজনশীল ভাবে সরকারি কোষাগারের অর্থ পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
আর ৪৫ দিনের মধ্যে দেশজুড়ে ২০ লক্ষ ‘সুরক্ষা স্টোর’ তৈরির পরিকল্পনা তো ঘোষণা করা হয়েই গেছে। অর্থাৎ দাবনাকার ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সঙ্গে লড়েও যেসব পাড়ার দোকান এতদিন টিকে ছিল। এবার তাদের অবস্থা আরও করুণ হবে। কারণ বৃহৎ দেশিবিদেশি পুঁজির তৈরি ওই দোকানগুলোয় প্রবল ভাবে মানা হবে ‘করোনা-স্বাস্থ্য বিধি’। যা মধ্যবিত্তের একাংশকে ওদিকে ঠেলে দেবে। পাশাপাশি তারা সন্তানদের আরও বেশি ঘরোয়া বিনোদনে উৎসাহিত করবে। সেইরকম কনটেন্টও বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি বেশি বেশি করে তৈরি করবে। বলাই বাহুল্য, মধ্যবিত্ত শ্রেণির এই অংশটাই ফ্যাসিবাদের সামাজিক ভিত্তি হিসেবে বরাবর কাজ করেছে, এবারও করবে। করোনা ও নানা রোগের অজুহাতে এরপর যখন দিনের পর দিন গণ জমায়েত বন্ধ রাখার নির্দেশ আসবে, তখন এই অংশটাই তাকে দু’হাত তুলে সমর্থন করবে। অর্থাৎ মধ্যবিত্তর সঙ্গে মেহনতি মানুষের ‘সামাজিক দূরত্ব’ আরও বাড়বে।
বলাবাহুল্য সবার সে সৌভাগ্য হবে না। অর্থনৈতিক মন্দা, করোনা ইত্যাদি নানা কারণে যারা নিজেদের শ্রেণি অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না। তারা শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে পথে নামবেই। তারজন্য যদি মুখোশ পরতে হয় পরবে। নিজেদের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হয় রাখবে। আগামী কিছুদিন যদি বড়ো জমায়েত না করা যায় তাহলে গেরিলা কায়দাতেই সংগ্রামের নিত্যনতুন পথ তৈরি হবে। কোনোটা স্বতস্ফূর্ত ভাবে, কোনোটা সংগঠিত ভাবে। সংগ্রামের রূপ যেমনই হোক, সব মিলিয়ে সাম্রাজ্যবাদের পশ্চাদভূমি তৃতীয় বিশ্বে গণ আন্দোলন আরও অনেকগুন তীব্র হতে চলেছে। শ্রমিকদের ওপর শোষণ বৃদ্ধি এবং বাজারে চাহিদা রক্ষার মীমাংসাহীন দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হতে চলেছে। অতএব এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকাই ‘বিশ্ব বিপ্লবের ঝটিকাকেন্দ্র’ হয়ে থাকবে।
করোনা সাম্রাজ্যবাদের মূল চরিত্র পালটাতে পারেনি। তবে তৃতীয় বিশ্বের কোনো একটি দেশ মুক্ত হলেই প্রথম বিশ্বে বড়ো রকমের রাজনৈতিক পালাবদলের সম্ভাবনা তৈরি হবে। কারণ ঐতিহাসিক ভাবে সাম্রাজ্যবাদ আজ অনেক বেশি পরিমাণে তৃতীয় বিশ্বের ওপর নির্ভরশীল।
এই পরিস্থিতিতে আরও আরও মুনাফার প্রয়োজনে সাম্রাজ্যবাদ যেমন লুঠপাট বাড়াবে, তেমনই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মধ্যে দ্ব্ন্দ্ব তীব্র হবে। যে দ্বন্দ্বের জায়গা থেকেই তারা জীবাণু অস্ত্র তৈরির প্রস্তুতি চালাচ্ছিল(যা করোনা-মাহামারির জন্ম দিয়েছে), সেই দ্বন্দ্ব আরও বড়ো আকারে ফেটে না পড়াটাই অস্বাভাবিক। তারা যতই যুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা করুক, যুদ্ধ ছাড়া সাম্রাজ্যবাদ বাঁচতে পারে না।
শেষ অবধি ফিরে যেতে চেয়ারম্যান মাওয়ের সেই ঐতিহাসিক মন্তব্যের কাছেই। ‘হয় বিপ্লব বিশ্বযুদ্ধকে ঠেকাবে কিংবা বিশ্বযুদ্ধ বিপ্লব ডেকে আনবে’। কোনটা হবে, সেই ভবিষ্যদ্বাণীতে গিয়ে কাজ নেই। কিন্তু এটুকু বলাই যায়, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে, তা দুনিয়া জুড়ে সমাজতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত করবে।