Home রাজনীতি শুধু ত্রাণ দেবেন, অধিকারগুলো জানাবেন না কমরেড?

শুধু ত্রাণ দেবেন, অধিকারগুলো জানাবেন না কমরেড?

শুধু ত্রাণ দেবেন, অধিকারগুলো জানাবেন না কমরেড?
0
শুভেন্দু ঘোষ

“When I give food to the poor, they call me a saint. When I ask why they are poor, they call me a communist.”

Camara Helder.

ইতিহাসে মাঝে মাঝে কোনো উক্তি ঐশ্বরিক হয়ে ওঠে, আজ ক্যামারা হেল্ডারের এই কথাটি সেই পর্যায়ে চলে গেছে। কেন তারা গরিব?

উত্তর প্রদেশে মঞ্জু যাদব নিজের হাতে তার পাঁচ সন্তানকে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়েছেন।  লকডাউনের বাজারে বাড়ন্ত ভাতের হাঁড়ি আর অনাহারে মরতে বসা সন্তানদের দিকে তাকানো অসহায় এক মা, মা গঙ্গার কাছেই সন্তানদের আশ্রয় দিয়েছেন। করোনার আতঙ্কে খিদে। 

আরও পড়ুন: সাহায্যের পাশাপাশি বিপ্লবের জন্য জনগণকে সংগঠিত করতে হবে, বলছে মার্কিন কমিউনিস্টরা

ভারতে ক্ষুধা ছিল না এরকম বোধহয় অতি বড় ‘দেশভক্ত’ও করবে না। বরং গত বছর দেখা গেল ক্ষুধাসূচকে ১১৭ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০২-এ। ভারতের থেকে পাকিস্তানের অবস্থা ভালো, যে পাকিস্তানকে দুবেলা খিস্তি না করলে ‘ দেশপ্রেমের’ পাঠ সম্পূর্ণ হয় না। বাংলাদেশ, নেপালের মত প্রতিবেশী দেশগুলিও এগিয়ে। যুদ্ধ দুর্ভিক্ষে জর্জরিত ইয়েমেনের সাথে ভারতের অবস্থা তুলনীয়,মাত্র ৯.৬% শিশু সুষম খাদ্য পায়।

ফলে দুম করে করোনা এসে ভারতের খিদে বাড়িয়ে দিয়েছে এমনটা না, বরং কঙ্কালের উপর যে চামড়াটা ছিল সেটাকে উম্মুক্ত করে পাকস্থলীর দৈনদশাটা সামনে এনেছে মাত্র।

একই সময়ে জানা যাচ্ছে ঝাড়খণ্ডের গঢ়বা জেলার চন্দ্রাবতী দেবীর আটজনের পরিবার তিনদিন ধরে অনাহারে আছেন এবং রেশন কার্ড থাকা সত্ত্বেও কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না। ওই জেলাতেই ভান্ডারিয়া গ্রামের সোমারিয়া নামের এক প্রৌঢ়া অনাহারে মারা গেছেন বলে অভিযোগ। এপ্রিল মাসে প্রথম সপ্তাহে রাজ্যের পঞ্চাশটি ব্লকে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায় রেশন কার্ড থাকা সত্ত্বেও কুড়িটি ব্লকে কোনো চাল-ডাল-গম পৌঁছায়নি। অনেক জায়গাতে রেশন ডিলারদের দুর্নীতির অভিযোগও আসছে। প্রসঙ্গত এই সমীক্ষায় শামিল ছিলেন অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ।

আবার বাংলাতে ঝালদা থানার সারজুমাতু, ইচাগ সহ বেশ কিছু গ্রামে এক বিচিত্র সামন্ততান্ত্রিক প্রথার কথা সামনে এসেছে। মহাজনের কাছে দরিদ্র গ্রামবাসীরা রেশন কার্ড জমা রেখে টাকা ধার নেন, সেই কার্ড দিয়ে রেশন আত্মসাত করে মহাজনের দল এবং সুদ সহ ঋণের টাকা ফেরত না দিলে সেই কার্ড ফেরত পাওয়া যায় না। রাধানাথ কালিন্দি, ইন্দ্রা কালিন্দির রেশন কার্ড ৬-৭ বছর ধরে মহাজনের কাছে জমা। আজ লকডাউনে কাজ না থাকায় অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটছে তাদের। জলপাইগুড়ি জেলার পূর্ব ডোবাবাড়ি, চামটিমুখী ও ফটকটারি গ্রামে সরকারি সহায়তা না পৌঁছানোয় চরম কষ্টে রয়েছেন গ্রামের মানুষেরা। জানা যাচ্ছে বেঙ্গালুরু থেকে গঙ্গাম্মা নামক এক পরিযায়ী শ্রমিক বাড়ি ফেরার সময় খিদের চোটে প্রাণ হারান।

আবার এই সময় রেশন দুর্নীতির খবরটিও সামনে আসছে। কলকাতার চিৎপুর এলাকায় সুদীপ সাহা ওরফে টিংকু নামে এক ব্যবসায়ী তাঁর গুদামে বিপুল পরিমাণ চাল, গম মজুত করেছিলেন বেআইনিভাবেই। ওই ব্যবসায়ী রেশন ডিলারও ছিলেন না। কালোবাজারি করতেই ওই চাল, গম গুদামে মজুত করেছিলেন তিনি।

রবিবারও মালদার এক রেশন ডিলারের বিরুদ্ধে উঠছিল প্রভূত অভিযোগ। দুঃস্থ পরিবারগুলিকে ঠকিয়ে দুর্নীতি করছিলেন ওই ডিলার। বিনপুরে রেশন দুর্নীতির বিরুদ্ধে গ্রামবাসীরা সমবেত বিক্ষোভে শামিল হন।

এদিকে ফুড কর্পোরেশান অফ ইন্ডিয়ার গুদামে রয়েছে ৭.৭ কোটি মেট্রিক টন খাদ্যশস্য, যা স্বাভাবিক মজুত ২.১ কোটি মেট্রিক টনের সাড়ে তিনগুন। এবং প্রত্যেক বছরই একটা বড় অংশের খাদ্য শস্য নষ্ট হয়।

উপরের পরিসংখ্যান থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট, ইতিহাসের পাতার প্রত্যেক ক্ষুধার মতই এই আজকের ক্ষুধাও সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। ‘দেশভক্ত’রা যতই মুখে কুলুপ এঁটে এই সময়ে ‘রাজনীতি’  করার বিরোধিতা করুন না কেন, ভারতের মানুষ যে বিপুল দুর্দশার শিকার তা সম্পূর্ণ কায়েমি স্বার্থপুষ্ট  সামন্ততান্ত্রিক ও ঔপনিবেশিক কাঠামোর মধ্যে লুকিয়ে।

এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে অনেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, বামপন্থী, কমিউনিস্ট রাস্তায় নেমেছেন ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেবার জন্য। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক মানুষের পেট ভরানো ভারতের সমস্ত ‘শুভবুদ্ধিসম্পন্ন’ মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়, সেটা বুঝতে রকেট সায়েন্স পড়তে হয় না। তারজন্য দরকার সরকারের কর্মযজ্ঞ। সেখানে নানাভাবে সরকারের উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে মানুষের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টাটাই একমাত্র পথ হতে পারে। যদি একটা কিন্তুতে এই প্রসঙ্গ শেষ করা যেত তাহলে খুশিই হতাম, কিন্তু এখানেই হেল্ডারের উক্তিটি ভাস্বর হয়ে ওঠে…ওরা কেন ক্ষুধার্ত।

‘বাবার কারখানা বন্ধ। খাওয়া জুটছে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় বাবার ছবি দেখলাম। বাবা মাথা নিচু করে চাল, ডাল নিচ্ছে। জীবনে প্রথমবার…’

একটি মেয়ে সোসাল মিডিয়াতে লিখেছিল।

আমরা ফিরে যাব শ্রেণি সমাজের শুরুতে, যেখানে উদ্বৃত্ত তৈরি হওয়া শুরু হল এবং মুষ্টিমেয় একদল সেই উদ্বৃত্ত ছিনিয়ে নিয়ে পরগাছার বিলাসবহুল জীবন যাপন শুরু করল।  শোষণের ভিত্তি কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার জন্য উপরিকাঠামোর দর্শন, সংস্কৃতি সেইভাবেই রচিত হল। কায়িক শ্রম আর মানসিক শ্রমের দুস্তর ব্যবধান দেখা দিল। আর শোষকেরা এই ব্যবস্থাকে ন্যায্যপ্রমাণের জন্য কায়িক শ্রমকে একটি অধঃপতিত শ্রম হিসেবে দেখাতে শুরু করল, যাতে উদ্বৃত্ত সৃষ্টিকারী ব্যাপক শ্রমজীবীর দল হীনমন্যতায়  ভোগে। সে যেন একটি ভুল বাস্তবে বেঁচে থাকতে বাধ্য হয় যে তার জীবন, তার শ্রম আসলে খুঁটে খাওয়া মানুষের জীবন, ব্যর্থ একটা জন্ম।

প্রধানমন্ত্রী আবেদন জানিয়েছে, যারা পারবেন তারা যেন একটি গরীব পরিবারের দায়িত্ব নেন। ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ নিজের এলাকায় কমিউনিটি কিচেন খুলে চল্লিশ হাজার মানুষকে খাইয়ে প্রভূত পুণ্য অর্জন করছে। এছাড়া  মধ্যবিত্ত,  এনজিও-রা লাইনে গরিব মানুষদের দাঁড় করিয়ে সেল্ফি সহযোগে যে পরিমাণ আত্মশ্লাঘা জোটাচ্ছেন তা এক জায়গায় করলে আইফেল টাওয়ার হয়ে যাবে।

মজার ব্যাপার হল যাদের হাত পাততে বাধ্য করা হচ্ছে তারাই আসলে উদয়াস্ত কায়িক শ্রম করে সভ্যতাকে টিকিয়ে রেখেছে। অপরপক্ষে  যাদের সামনে তারা নতজানু হতে বাধ্য হচ্ছেন তাদের বেশিরভাগটাই সুবিধাভোগী শ্রেণির অংশ মাত্র। ফলে লাইনের কোনদিকে কে দাঁড়িয়ে, তা আসলে ঐতিহাসিক একটা প্রশ্নকেই তুলে আনছে আবার। হকের দাবি যখন নেহাতই ভিক্ষায় পরিণত হয়, তখন সেই শ্রেণি সমাজের শুরুতে যে বলপূর্বক হীনমন্যতার যাত্রা শুরু, তার হাতই শক্ত হয়। কিছুদিন আগে সোশাল মিডিয়ায় বহুপোস্টিত ‘ছিনিয়ে খায়নি কেন’ গল্পে যোগী ডাকাত বুঝেছিল এভাবে পাইয়ে দিয়ে মানুষকে  অধঃপতিত করা হয়, আসল প্রশ্ন লুকিয়ে থাকে ছিনিয়ে নিতে শেখার মধ্যে। একজন ডাকাত বা বিশপ যে অনেক পথ চলে যে উপলব্ধিতে পৌঁছান, সেই উপলব্ধি কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির যাত্রাশুরুর সূচনাবিন্দু। তাই এই অতিমারির সময়ে শুধু ত্রাণ দিয়ে কমিউনিস্টের কাজ শেষ হতে পারে না। জনগণণকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করাটাই প্রকৃত ‘জনগণের সেবা করা’। তার জন্য রাষ্ট্রের কাছে সমবেত হয়ে দাবি করার জন্য তাদের সংগঠিত করাটা জরুরি। আর তাতে যদি কাজ না হয়, তাহলে ‘ছিনিয়ে খাওয়া’র পথ দেখানোই কমিউনিস্টের একমাত্র কাজ হওয়া দরকার। যে পথে মানবতাবাদী, উদারনীতিবাদী, সংশোধনবাদী, ‘গণতন্ত্র’প্রেমীরা হাঁটার কথা ভাবতেও পারে না, সেই পথে হাঁটাই তো কমিউনিস্টদের কাজ।

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে পদার্থবিদ্যায় গবেষণারত)

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *