অসহায়, নির্বাক দর্শক হয়ে করোনার তাণ্ডব দেখছেন দেবতারা
এই পোর্টালে প্রকাশিত As Coronavirus Rages, Gods remain helpless, mute Spectators নিবন্ধের বাংলা অনুবাদ।
স্বপন রায়
করোনার থাবা চওড়া হয়ে চলেছে আর দেবতারা অসহায়, নির্বাক দর্শক হয়ে বসে আছেন। গোটা দুনিয়ায় তাণ্ডব চালানোর পথে করোনা দেবতাদের ঘরবাড়ি, অর্থাত দুনিয়ার পবিত্র শহরগুলোকেও ছাড় দেয়নি। কোটি কোটি হিন্দু, মুসলিম, ক্রিশ্চানের প্রার্থনা তাদের ক্ষমতাহীন ঈশ্বরদের বধির কানে ঢুকছে না। পৃথিবীতে প্রায় ৪,২০০ ধর্ম পালিত হয়। কিন্তু সেই সব ধর্মের বিশ্বাসীরা এখন ধর্মের বদলে চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর নির্ভর করেই দিন কাটাচ্ছেন- যে চিকিৎসা শাস্ত্র আধুনিক বিজ্ঞানের দান।
জেরুজালেমে, যেখানে নাকি যিশুখ্রিস্ট ধর্মপ্রচার করেছিলেন, কুষ্ঠরোগীকে সারিয়ে তুলেছিলেন এবং অন্ধকে দৃষ্টি দিয়েছিলেন, সেখানে করোনাভাইরাস ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ১৬৩০ জনকে সংক্রমিত করেছে। প্রার্থনা করে তারা সুস্থ হননি আর এখন তারা প্রাণে বাঁচার জন্য যিশুর বদলে ডাক্তার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে প্রার্থনা করছেন।
ভ্যাটিকান সিটি, যেটা কিনা পোপ ফ্রান্সিস শাসন করেন এবং রাষ্ট্র পরিচালকরা সকলেই পাদরি, সেখানে এই মানব-সৃষ্ট ভাইরাস ৮ জনকে সংক্রমিত করেছে।
করোনাভাইরাসের জেরে পোপ ইস্টারের সমবেত প্রার্থনা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন- পোপের শাসনের দীর্ঘ ইতিহাসে যা অভূতপূর্ব। পোপকে অনলাইনে ধর্মের বাণী শোনাতে হয়েছে। ভ্যাটিকানের বন্ধ দরজার বাইরে, গোটা দুনিয়ায় করোনা যখন প্রায় ১ লক্ষ ৯ হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠেছে, সে সময় হাতে গোনা কয়েকজন ধর্মপ্রচারককে সাক্ষী রেখে ফাঁকা, ভূতুড়ে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল থেকে পোপ দুনিয়ার ১৩০ কোটি ক্যাথলিকদের কাছে নিজের ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করেছেন। নিজের বিশ্বাসের পরিবর্তে প্রযুক্তির কাছে প্রণত হতে পোপকে বাধ্য করেছে করোনা।
গালফ নিউজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত নবী মহম্মদের জন্মস্থান মক্কায় ১০৫০ জন করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। পবিত্র শহর মক্কার তিনগুন বড়ো শহর রিয়াধে করোনা আক্রান্ত ৪২২ জন। ধর্মবিশ্বাস মক্কার অধিবাসীদের করোনার থাবা থেকে রক্ষা করতে পারেনি, মুসলিমদের পবিত্রতম শহর এই মারণ ব্যাধিকে একটুও প্রতিরোধ করতে পারেনি। সৌদি আরবে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৪৯৩৪, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন মক্কায়।
সৌদি সরকার মক্কা ও মদিনায় ২৪ ঘণ্টা কার্ফু জারি করতে বাধ্য হয়েছে। এখন তারা জুলাই-আগস্টের হজ যাত্রা পিছিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। হাজারো প্রার্থনাও সেখানকার জনগণকে করোনার আক্রমণ থেকে বাঁচাতে পারেনি। হজ মন্ত্রী মহম্মদ বানতেন বলেছেন, হজ পিছোতেই হবে কারণ সৌদি রাজারা তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। করোনার সংক্রমণ কম রাখার জন্য হজের তুলনায় ছোটো মাপের তীর্থযাত্রা ‘উমরাহ’ ইতিমধ্যেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
তাদের মুসলিম ও ক্রিশ্চান ভাইদের মতো হিন্দুরাও তাদের ধর্ম থেকে কোনো নিরাপত্তা জোটাতে পারেনি। এক মহান ভক্ত হিন্দুর নেতৃত্বে হিন্দু রাজনৈতিক দল দ্বারা শাসিত হওয়া সত্ত্বেও করোনাভাইরাস ভারতে হিন্দুদের মশামাছির মতো মেরে ফেলছে।
পবিত্র শহর বেনারসে ৯ জন সংক্রমিত হয়েছেন এবং অন্তত ১ জন মারা গেছেন। স্বেচ্ছায় গেরুয়া ধারণ করা যোগীর শাসনে উত্তর প্রদেশে ৮ জন মারা গেছেন ও ৬৫৭ জন সংক্রমিত হয়েছেন। সম্প্রতি তিরুপতিতে ভগবান বিষ্ণুর অবতার ভগবান ভেঙ্কটেশ্বরায়ার পুজো করতে হাজারো মানুষ জড়ো হয়েছিলেন- সেখানে এ পর্যন্ত ৩ জন মারা গেছেন ও ৯ জন সংক্রমিত হয়েছেন। সারা ভারত হিন্দু মহাসভার ‘গৌমূত্র’ পার্টি দিল্লির জনগণকে কোনো প্রতিষেধক দিতে পারেনি।
শিখ ধর্মের কেন্দ্র অমৃতসরে এ পর্যন্ত ৯ জন সংক্রমিত হয়েছেন এবং ২ জন মারা গেছেন। বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্র গয়ায় এ পর্যন্ত ১ জন করোনা আক্রান্তের কথা সরকারি ভাবে জানা গেছে।
এটা সত্য যে, যথাযথ চিকিৎসা পরিষেবা ও বিজ্ঞান শিক্ষার অভাবেই দুনিয়া জুড়ে গরিব মানুষ ধর্মবিশ্বাসের খপ্পরে পড়ে। ধর্মকে্ ‘আফিম’ বলার পাশাপাশি কার্ল মার্কস এও বলেছিলেন, “ধর্ম হল নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, অসহায়ের সহায়”।
ধর্ম প্রসঙ্গে লেনিনের পর্যবেক্ষণ এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা জরুরি। সমাজতন্ত্র ও ধর্ম প্রবন্ধে লেনিন বলেছেন, “পুঁজিবাদের অন্ধকার শক্তির বিরুদ্ধে নিজস্ব সংগ্রাম ছাড়া কোনো পু্স্তিকা ও প্রচার(ধর্ম সম্পর্কে)দিয়ে সর্বহারাকে আলোকপ্রাপ্ত করা অসম্ভব। পরলোকে স্বর্গ সৃষ্টি সম্পর্কে সর্বহারার মতৈক্যের চেয়ে পৃথিবীতে স্বর্গ সৃষ্টির জন্য নিপীড়িত শ্রেণির এই সত্যিকারের বিপ্লবী সংগ্রামের ঐক্য আমাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ”।
প্রচারিত হ-ও-য়া উ-চি’ৎ।