১৮১৮ সালে পেশোয়া রাজ দ্বিতীয় বালাজি বাজিরাওয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষুদ্র সেনাদলটি তৈরি হয়েছিল মূলত মহারাষ্ট্রের দলিতদের নিয়ে। সে সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। বস্তুত জাতীয়তাবাদের ধারণাটিও ছিল অস্পষ্ট। দলিতরা ক্ষত্রিয় রাজাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার মাধ্যম হিসেবে ব্রিটিশদের হয়ে লড়াই করাটাকেই বেছে নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা যাখন ভীমা কোরেগাঁওএর লড়াইয়ের স্মারক স্তম্ভ তৈরি করে, তখন দেখা যায় ৪৯ জন শহিদের মধ্যে ২২ জনই নিম্নবর্ণ মাহার সম্প্রদায়ের।
আরও পড়ুন: ১০-১২টা দেশের করোনা-সংকটকে কেন গোটা দুনিয়ার সংকট হিসেবে দেখানো হচ্ছে?
বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর ছিলেন সেই মাহার সম্প্রদায়ের মানুষ। এই গ্রামীণ দলিত সম্প্রদায়ের নির্দিষ্ট কোনো পেশা ছিল না। জমিও ছিল না। এরা ছিল অসংগঠিত। মহারাষ্ট্রের শিল্পায়নের হাত ধরে এরা দলে দলে শহরে চলে আসে। সুতাকল, প্রতিরক্ষা, রেল সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রমিকের কাজে লেগে পড়ে। অর্থাৎ ব্রিটিশ পরিচালিত সাম্রাজ্যবাদী শিল্পায়নের গর্ভজাত সর্বহারা হিসেবেই সহজেই চিহ্নিত করা যায় মাহারদের। এদের একটা অংশ ডিফেন্স স্কুল, ক্রিস্চান মিশনারি স্কুলে শিক্ষিত হয়। তৈরি হয় একটি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি। বিআর আম্বেদকর ছিলেন সেই শ্রেণির অংশ। তার বাবা ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মেজর-সুবেদার পদমর্যাদার শিক্ষক। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র বাবাসাহেব ব্রিটেন ও আমেরিকায় গিয়ে অর্থনীতি ও আইনবিদ্যায় ডক্টরেট ও পোস্ট ডক্টরেট করেন।
আমেরিকা ও ইউরোপীয় সমাজের বর্ণপ্রথাহীন উদার জীবনযাত্রায় মুগ্ধ হন আম্বেদকর। পাশ্চাত্য থেকে উদারনৈতিক বুর্জোয়া মতাদর্শে প্রাণিত হয়ে তিনি দেশে ফিরে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁর নেতৃত্বে মহারাষ্ট্রে একের পর এক উল্লেখযোগ্য দলিত আন্দোলন হয়। নাসিকে সর্বজনীন পুকুর দলিতদের ব্যবহার করার লড়াই, মন্দিরে প্রবেশের অধিকারের লড়াই, ১৯২৭ সালে মনুসংহিতা পোড়ানো- সবই বাবাসাহেবর মুকুটে পালক। শ্রমিক শ্রেণির অধিকাংশই ছিলেন দলিত সম্প্রদায়ের। তাদের স্বার্থরক্ষায় ১৯৩৬ সালে আম্বেদকর ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি তৈরি করেন। পিছিয়ে থাকা শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ব্রিটিশদের আয়োজিত প্রতিটি গোলটেবিল বৈঠক ইত্যাদিতে যোগ দিয়েছিলেন। সমাজ সংস্কার থেকে দলিতদের রাজনৈতিক অধিকার অর্জন, সংরক্ষণ প্রভৃতি আন্দোলনে এই পর্যায়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যদিও উচ্চবর্ণের ক্ষমতার সঙ্গে জমির মালিকানার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কটা তিনি দু-একটা লেখায় বললেও, তার যথাযথ গুরুত্বটা ধরতে পারেননি। ভূমিহীন দলিতদের হাতে জমি না এলে যে তাদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়, সেটা আম্বেদকর দৃঢ় ভাবে উপলব্ধি করেননি। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দুধর্মের সংস্কার সাধন ও ব্রিটিশদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে কিছু আইনি অধিকার অর্জন। তবু তাঁর ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী লড়াই স্মরণীয়।
কিন্তু এর পর পরিস্থিতি পালটে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর তিনি ব্রিটিশদের অনুরোধ করেন, যাতে তারা বেশি সংখ্যায় দলিতদের তাদের সেনাবাহিনীতে নেয়। এমনকি বাবাসাহেব দেশ ঘুরে দলিতদের আবেদন করেন যাতে তারা সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। বোঝা যায়, ভীমা কোরেগাঁওতে ব্রিটিশদের হয়ে দলিতদের লড়াইয়ের ইতিহাস তাঁকে তাড়িত করেছিল। ভারতীয় সমাজের বর্ণবাদকে নির্মূল করতে তিনি ব্রিটিশদের উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর ভরসা রেখেছিলেন। কিন্তু ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেই যে ব্রিটিশরা ভারত শাসন করে চলেছে, এই সত্য বাবাসাহেবের পেটিবুর্জোয়া লিবারেল মতাদর্শ উপলব্ধি করতে পারেনি। এমনকি তিনি আরও এক কদম এগিয়ে নিজের ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি তুলে দেন। ব্রিটিশদের অনুরোধ করে তিনি ভাইসরয়ের সরকারের শ্রমমন্ত্রী হন। লক্ষ্য ছিল দলিতদের জন্য কিছু সুবিধা আদায়। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন ভেঙে যায়। তফশিলি জাতিদের সংগঠনের হয়ে তিনি ব্রিটিশদের কাছে যে দাবি সনদ পেশ করেছিলেন, ব্রিটিশরা তা মানেনি। ভারতের ক্ষমতাশালী ব্রাহ্মণ্যবাদী সামন্ত শ্রেণিকে চটাতে তারা আগ্রহী ছিল না। মজার ব্যাপার হল, ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ভারতে জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামের অস্তিত্ব ছিল না, কিন্তু এই সময় তা তীব্র ছিল। সেই লড়াইয়ের দিকে দৃষ্টিপাত না করে বাবাসাহেব ব্রি্টিশদের প্রতিই ভরসা রেখে চলছিলেন। যেটা সর্ব অর্থেই জনবিরোধী।
যাই হোক, ব্রিটিশদের মোহ কাটিয়ে এরপর আম্বেদকর ভারতীয় সামন্তপ্রভু ও মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের পার্টি কংগ্রেসের কাছে আসেন।এবং নেহরু ও প্যাটেলের পরামর্শ মতো ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসরণ করে ভারতের সংবিধান রচনা করেন।ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রীও হন। নেহরুর প্রগতিশীল ভাবমূর্তি দেখে আম্বেদকর ভেবেছিলেন, তিনি বোঝহয় হিন্দু ধর্মের সংস্কারে আম্বেদকরের পাশে দাঁড়াবেন। কিন্তু তা হয়নি। আম্বেদকরের প্রস্তাবিত ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী হিন্দু কোড বিল কংগ্রেস প্রত্যাখ্যান করে সামন্তশ্রেণির চাপে। ভগ্নহৃদয়ে আম্বেদকর মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। বর্ণবাদ বিলোপের সঙ্গে ভারতীয় সমাজের কাঠামোগত পরিবর্তন যে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে, বাবাসাহেব তা উপলব্ধি করতে পারেননি। দলিতদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে জমির লড়াইয়ের প্রশ্নটাকে তিনি গুরুত্ব দেননি। বরং তার ভাববাদী মতাদর্শ তাকে ঠেলে দেয় বৌদ্ধ ধর্মের দিকে। ১৯৫৬ সালে মৃত্যুর আগে তিনি বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন।
ভারতের মতো আধা সামন্ততান্ত্রিক দেশে নিখাদ উদার বুর্জোয়া মতাদর্শ বলে যে কিছু হতে পারে না, তার জ্বলন্ত প্রমাণ বিআর আম্বেদকর। হিন্দু ধর্মের মধ্যেকার সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হয়ে ধর্মান্তরিত হওয়াটা, আম্বেদকরের জীবন জুড়ে দলিত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া, দলিতদের নিয়ে গবেষণা করার সমৃদ্ধ ইতিহাসটিকেই খেলো করে দেয়। আসলে গোটা দলিত সমাজের হয়ে লড়লেও আম্বেদকর দলিত পেটি বুর্জোয়া শ্রেণির আশাআকাঙ্ক্ষারই প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক ভাবে। তাঁর মৃত্যুর পরেও আম্বেদকরপন্থী দলিত আন্দোলনে এই দুর্বলতা থেকে গেছে। তাঁরা সংরক্ষণ ও সামাজিক সম্মানের বিষয়টাকেই প্রধান লক্ষ্য বানিয়ে লড়ে চলেছেন(যদিও এই দুটি বিষয়ও যে অত্যন্ত জরুরি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই)। গরিব দলিতদের দুর্গতির উৎসে পৌঁছতে তাদের অনীহা রয়ে গেছে। সামগ্রিক ভাবে গরিব দলিতদের খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের সমস্যা যে কেবল সংরক্ষণের গাজর দিয়ে মিটবে না, সেটা তারা বুঝতে চান না। অন্যদিকে দলিতদের ধর্মান্তরিত হওয়ার ধারাও বহমান।
এই দিক থেকে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রে ভীমা কোরেগাঁও-এর লড়াইয়ের ২০০ বছর পূর্তি উদ্যাপন দলিত আন্দোলনে এক নতুন দিশা নির্দেশ করে। কারণ ২০০ বছর আগে যারা দলিতদের প্রধান শত্রু ছিল, সেই ব্রাহ্মণ্যবাদী সামন্তপ্রভুরা আজও রয়েছে ভারতের ক্ষমতায়। কিছু পরিমার্জন হয়তো হয়েছে। কিন্তু সেদিনের লড়াইয়ের মতো দলিতদের এই স্মৃতিচারণ কোনো বিদেশি শক্তির দ্বারা প্রভাবিত ছিল না। বরং সেই উদ্যাপনে শত্রু-মিত্র অনেক স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত ছিল। তাই শঙ্কিত হয়ে পড়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বিজেপি তথা উচ্চবর্ণ। দেশ জুড়ে সংঘর্ষ শুরু হয়। ফলাফলে সেই উদ্যাপনকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ তকমা দেওয়া হয়। সেই অভিযোগে একঝাঁক বুদ্ধিজীবী ও অধিকার আন্দোলনের কর্মীকে গ্রেফতার করে রাখা হয়েছে এখনও।
বাবাসাহেব আম্বেদকরকে মহান বানাতে ভারতের বর্তমান শাসকদের আগ্রহের শেষ নেই। কিন্তু দলিতরা নিজেদের প্রকৃত ক্ষমতায়নের জন্য সরব হলেই তাদের সমস্যা। শাসকরা চান, দলিতদের আন্দোলন মায়াবতীর মতো দুর্নীতির শিরোমণি নেতানেত্রীদের হাতেই থাকুক। এমনকি মুখে আম্বেদকরের গুণগান করলেও ব্রাহ্মণ্যবাদকে উচ্ছেদ করার জন্য বাবাসাহেব যে হিন্দু কোড বিলের প্রস্তাব করেছিলেন, তা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করে না ব্রাহ্মণ্যবাদী বিজেপি। আম্বেদকরের পথ অনুসরণ করে আজও ধারাবাহিক ভাবে বহু দলিত বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। ইসলাম থেকে ‘ঘর ওয়াপসি’ নিয়ে হরেক কথা বললেও এ নিয়ে তেমন রা কাড়তে দেখা যা না সংঘীদের। উলটে আর্থিক ভাবে দুর্বল উচ্চবর্ণের জন্য সংরক্ষণের পথে হেঁটে এরা তফশিলি জাতি-উপজাতিদের সংরক্ষণ কমাতে উদগ্রীব। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যবাদী সামন্ততন্ত্রের স্বার্থে ঘা দিয়ে হিন্দু ধর্মের সংস্কার সাধনে আগ্রহী নয় কংগ্রেস কিংবা বিজেপি। অন্যদিকে ভোট হারানোর ভয়ে সংসদে বিজেপির উচ্চবর্ণের জন্য সংরক্ষণের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেনি কোনো দল, এমনতি বহুজন সমাজ পার্টিও। একসময় কংগ্রেস আম্বেদকরকে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিল, আজ বিজেপি দলিত-আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষণের পরিমাণ যতটা সম্ভব কমিয়ে দেওয়ার ধান্দা করছে।
তাই দলিতদের সামনে এখন নিজেদের অধিকার অর্জনের সঙ্গে জমির অধিকারের যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, তা বুঝে নেওয়ার সময়। উপরিকাঠামোয় কয়েকটি সংস্কার(জরুরি হলেও) যে সমস্যার সুস্থায়ী সমাধান ঘটাবে না, তা উপলব্ধি করার সময়। সামন্ততান্ত্রিক ভূমিসম্পর্ক ও ক্ষমতাকাঠামোকে ঝাড়েমূলে উচ্ছেদ করতে না পারলে দলিত সম্প্রদায়ের প্রকৃত ক্ষমতায়ন অসম্ভব। কারণ দলিতদের অধিকাংশই ভূমিহীন কৃষক ও সর্বহারা শ্রেণির অন্তর্গত। তাই দলিতদের মুক্তির জন্য জাতপাতের সঙ্গে শ্রেণির লড়াইকে যুক্ত করতেই হবে। মনে রাখতে হবে, দলিত ভূস্বামী, দলিত কারখানা মালিক কিংবা দলিত সরকারি অফিসার, ম্যানেজমেন্ট কর্মীরা দলিত সম্প্রদায়ের শ্রমিক-কৃষককে কোনো বাড়তি সুবিধা দেয় না। তারা ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকের ভাষাতেই কথা বলে।
আশার কথা, ভারতের সংগ্রামী দলিতরা, শাসকের আক্রমণের মোকাবিলা করে ঠিক পথে হাঁটতে চাইছেন।