Home অর্থনীতি করোনা: কিটের রাজনীতি, রাজনীতির কীট

করোনা: কিটের রাজনীতি, রাজনীতির কীট

করোনা: কিটের রাজনীতি, রাজনীতির কীট
0
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়

ট্রু ন্যাট প্রযুক্তির কিট নির্ভর পরীক্ষা পদ্ধতিকে ছাড়পত্র দিলো আইসিএমআর। এখন থেকে কোভিড ১৯-এর পরীক্ষার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হবে । এই পদ্ধতি ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ প্রযুক্তির যন্ত্র এবং বিপুল পরিমাণ কিট  তৈরির বরাত পেয়েছে এ বিষয়ে টাটা ট্রাস্টের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা কোম্পানি মোলবায়ো ডায়াগনসটিকস ।

এখনও  পর্যন্ত কোরোনা পরীক্ষার জন্য যে র‍্যাপিড টেস্ট কিট ব্যবহৃত হচ্ছে তা মূলত অ্যান্টিবডি নির্ভর। এক্ষেত্রে কোরোনা ভাইরাসের আক্রমণের বিরুদ্ধে শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধ হিসেবে যে নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তার শনাক্তকরণের মাধ্যমে কোরোনা আক্রান্ত রোগীকে শনাক্ত করা হয় । এই পদ্ধতির নির্ভরযোগ্যতা কম । অর্থাৎ এই পরীক্ষায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংক্রমণ অনেক ক্ষেত্রেই  নাও ধরা পড়তে পারে ।

 দ্বিতীয় পদ্ধতিটি  তুলনায় কিছুটা খরচসাপেক্ষ হলেও অনেক বেশি সুনিশ্চিত এবং নির্ভরযোগ্য । এর নাম ন্যাট(NAT) । ন্যাট-এর পুরো কথা হলো নিউক্লিক অ্যাসিড টেস্ট। যেকোনো জীবের শরীরে দু ধরনের নিউক্লিক অ্যাসিড- ডিএনএ এবং আরএনএ-র মধ্যে যে কোনো একটি অথবা দুটিই উপস্থিত থাকে । মিডিয়ার সৌজন্যে ইতিমধ্যেই প্রায় সকলেই জেনে গেছেন যে SARS cov2 বা নোভেল কোরোনা ভাইরাস এক ধরনের আরএনএ ভাইরাস অর্থাৎ এই ভাইরাসের শরীরে উপস্থিত থাকে শুধুমাত্র  আরএনএ। এখন এই ডিএনএ বা আরএনএতথা জিন  যেহেতু প্রতিটি জীবের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র তাই  কোনো জীবকে শনাক্ত করার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায় হলো তার স্বাতন্ত্র্যসূচক এক বা একাধিক  জিনকে শনাক্ত করা । কোরোনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে  N1, N2, N3, RP প্রভৃতি জিনের মধ্যে এক বা একাধিক জিনকে শনাক্ত করা হচ্ছে যা একমাত্র কোরোনা ভাইরাসের আরএনএ- তেই পাওয়া যায় ।

এই শনাক্তকরণের পরীক্ষা কীভাবে করা হয় ? 

এর প্রথম ধাপে রোগীর লালারসের নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়।  এই নমুনা থেকে শুধুমাত্র আরএনএ অংশটিকে আলাদা করে নেওয়া হয় (আরএনএ আইসোলেশন) । এরপর  Reverse Transcriptase Polymerase Chain Reaction বা RT PCR পদ্ধতিতে  প্রথম ধাপে এই আরএনএ-কে cDNA-তে রূপান্তরিত  করে পরের ধাপে সেই  cDNA থেকে  কোরোনা ভাইরাসের উপরোক্ত জিনগুলির(N1, N2, N3,RP) মধ্যে যে কোনো একটি বা একাধিক জিনের প্রতিলিপি তৈরি করার চেষ্টা করা হয় । নমুনাতে নোভেল  কোরোনা  ভাইরাস উপস্থিত থাকলে নির্দিষ্ট জিনগুলির প্রচুর প্রতিলিপি তৈরি হয় যা থেকে নিশ্চিতভাবে রোগটিকে শনাক্ত করা যায় । সেক্ষেত্রে পরীক্ষাধীন ব্যক্তিকে করোনা  পজিটিভ বলা হয়। আর নমুনায় ভাইরাস না থাকলে কোন প্রতিলিপিই তৈরি হয় না। সেক্ষেত্রে পরীক্ষাধীন ব্যক্তিকে করোনা নেগেটিভ বলা হয়। মোটামুটি ভাবে ৫-৬ ঘন্টা লাগে পরীক্ষার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া শেষ হয়ে ফলাফল আসতে। একটি 96 well এর RT PCR যন্ত্রে একবারে ৯০টি নমুনা পর্যন্ত পরীক্ষা করা সম্ভব । এই পরীক্ষার খরচ  মোটামুটি ভাবে হওয়া উচিত ৭০০ টাকার আশেপাশে । (যদিও সরকারি তরফে এই পরীক্ষার খরচ দেখানো হচ্ছে ৪৫০০ টাকা!! )

যে ট্রু ন্যাট প্রযুক্তি ছাড়পত্র পেলো তা পদ্ধতিগত ভাবে একই । অর্থাৎ PCR নির্ভর নিউক্লিক অ্যাসিড (RNA) পরীক্ষা । শুধু এক্ষেত্রে আলাদা করে RNA ISOLATION এর প্রয়োজন থাকছে না । অর্থাৎ উপরোক্ত প্রক্রিয়ার সবকটি পর্যায়কে প্রযুক্তিগত ভাবে একত্রিত করা হয়েছে । ফলে সময় লাগছে অনেক কম । খরচ পড়বে দেড় হাজার টাকার কাছাকাছি । কিন্তু সমস্যা হলো প্রথমত এই প্রক্রিয়াটিও কিট নির্ভর । দ্বিতীয়ত এই  প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজন ট্রু ন্যাট প্রযুক্তির বিশেষ pcr যন্ত্র যে ধরনের যন্ত্র এখন Tuberculosis বা HIV শনাক্তকরণের কাজে ব্যবহৃত হয় । প্রচলিত PCR যন্ত্রের থেকে এটি  প্রযুক্তিগত ভাবে স্বতন্ত্র । এটি তিন ধরনের হতে পারে । সিঙ্গল ওয়ে যাতে এক একবারে মাত্র ৮ থেকে ১২ টি নমুনা পরীক্ষা করা যাবে, টু ওয়ে যাতে ১৬ থেকে ২৪টি নমুনা পরীক্ষা করা যাবে এবং ফোর ওয়ে যাতে  সবচেয়ে বেশি  ৩২ থেকে ৪৮ টি নমুনা এক একবারে পরীক্ষা করা যাবে (যা সংখ্যায় ৯৬- well regular RT PCR এর অর্ধেক)  ।

কেন্দ্রের গবেষণাকেন্দ্র এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মিলিয়ে সারা ভারতবর্ষে কয়েক হাজার গবেষণাগার রয়েছে যেখানে  বিভিন্ন জিন-এর রেগুলেশন বা  এক্সপ্রেশন নিয়ে গবেষণার কাজ হয় । তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই এই পরীক্ষাটি করার জন্য প্রয়োজনীয় RT PCR যন্ত্র সহ সমস্ত ধরনের পরিকাঠামো এবং দক্ষতা দুইই  রয়েছে । পজিটিভ কন্ট্রোল  অর্থাৎ কোরোনা আক্রান্তের শরীর থেকে পাওয়া প্রামাণ্য নমুনা সরবরাহ করলেই কোনোরকম কিট ছাড়াই এই সব পরীক্ষাগার থেকে কোরোনা শনাক্তকরণ সম্ভব । কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় সহ IISER, NIBMG-এর মতো বিশ্বমানের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর তরফ থেকে বারেবারে ICMR-এর কাছে জানানো হয়েছে যে তারা পরীক্ষা করার জন্য প্রস্তুত ।  এমনকি এবিষয়ে বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের নামের তালিকাও পাঠানো হয় । কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে ICMR থেকে স্বাস্থ্য দফতর  সকলেই এই বিষয়ে একেবারেই উদাসীন এবং অনিচ্ছুক।

দ্রুত ফলাফল দেওয়ার ক্ষেত্রে ট্রু ন্যাট প্রযুক্তি খানিকটা এগিয়ে থাকলেও এ ধরনের যন্ত্রের সংখ্যা এবং একসাথে বেশি সংখ্যক নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা বর্তমান সময়ের প্রয়োজনের নিরিখে একেবারেই অপ্রতুল।

এই অভাব মেটাতে বিপুল পরিমাণ যন্ত্র এবং কিট বানানোর বরাত দেওয়া হয়েছে ব্যাঙ্গালোর গোয়া ভিত্তিক  মোলবায়ো ডায়াগনসটিকস-কে, সারা দেশে এর বিপুল সরবরাহের জন্য যারা গাঁটছড়া বেঁধেছে টাটা ট্রাস্টের সঙ্গে । অথচ এটা একবারও ভেবে দেখা হলো না যে শুধুমাত্র কিট নির্ভর ব্যবস্থার মুখাপেক্ষি হয়ে না বসে থেকে উপযুক্ত যন্ত্র, পরিকাঠামো এবং দক্ষতা নিয়ে বসে থাকা অজস্র গবেষণাগারকে ব্যবহার করেও এই অভাব মেটানো যেত । যেখানে হু- এর গাইডলাইন বলছে টেস্ট, আইসোলেশন এবং টেস্ট, বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রচুর পরিমাণ পরীক্ষা না করলে লকডাউন অর্থহীন, সেখানে বিজ্ঞানীরা আবেদন জানানো সত্ত্বেও কেন তাতে কর্ণপাত করা হচ্ছে না? কেন এরকম একটা সংকটের মুহূর্তে যখন বিপুল পরিমাণ নমুনা পরীক্ষা করার প্রয়োজন তখন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অনুমতি পাচ্ছে না বিভিন্ন গবেষণাকেন্দ্র এবং বিশ্ববিদ্যালয়-এর  পরীক্ষাগারগুলো ?

মূল কারণ সম্ভবত দুটো – এক, এদের ছাড়পত্র দিলে কিট নির্মাতা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর বিপুল মুনাফার সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দুই ,এর ফলে কোরোনা আক্রান্তের সংখ্যা সংক্রান্ত প্রকৃত তথ্য আইসিএমআরের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তথ্য বিকৃতির অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে কেন্দ্র-রাজ্যের ঘোলাজলে মাছ ধরার সুযোগ সেক্ষেত্রে আর থাকবে না।

(লেখক আনবিক জীববিদ্যা বিষয়ে গবেষণারত)

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *