করোনার ঝাড় খেয়ে জনগণের দাবি
এই নিবন্ধটি ‘Coronavirus: the need for a progressive internationalist response’ থেকে অনুপ্রাণিত। ভারতবর্ষের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে দাবিগুলি নির্দিষ্ট করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে পোর্টালের তরফে ।
পুঁজিবাদের অবিচার দেখিয়ে দিল করোনা-ঝাড়!
দুনিয়া জুড়ে করোনা ভাইরাসের কাছে ঝাড় খেয়ে সত্যিই যদি কিছু শেখার থাকে, তা হলে তা এটাই — পুঁজিবাদ মানবতার সংকটই ডেকে আনে, সংকট প্রতিহত করতে পারে না। কারণ পুঁজিবাদের লক্ষ্য তো প্রফিট, পাবলিকের জীবন বাঁচানো নয়। করোনা দেখিয়ে দিল এ হেন সংকটে গোটা সমাজ তো দূর-কি-বাৎ, একক ব্যক্তি হিসেবেও আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিতে অপারগ পুঁজিবাদী স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা। আর, খাদ্য সুরক্ষা দে-না-সকতা পুঁজিবাদী অর্থনীতি। চলতি করোনা-সংকটে তাই পুঁজির ঢপবাজিতে না-মজে, আসুন দেখি পাবলিকের দাবিগুলো কী কী হতে পারে।
আরও পড়ুন: সুরাটে পরিযায়ী শ্রমিকদের বিক্ষোভ, ভিডিও
গরিব-মধ্যবিত্ত, প্রান্তিক পাবলিকের জন্য আগে থেকে কোনও রকম ব্যবস্থা না-করে, তড়িঘড়ি লকডাউন ডেকে দেওয়ার ফল কী হয়, বিশেষত ভারতের মতো দেশে, তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। কিন্তু এখন এ লকডাউন চলবে। তাই, এটাই সব নয়, আরও ‘অচ্ছে দিন’ আসছে। তার থেকে বাঁচতে কী চাই আমাদের —
১) জনসাধারণের খাদ্য সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সকলের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে চাল-ডাল-গম বা আটা শুধু নয়, তেল-নুন-চিনি-হলুদ-মশলা-চা-সহ যাবতীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করতে হবে। মাল বিলির সময় স্থানীয় স্তরে যেন কোনও দুর্নীতি না হয়, তা সুনিশ্চিৎ করতে হবে। এ জন্য চলতি রেশনিং বা গণবণ্টন ব্যবস্থা যদি অপ্রতুল হয়, তা হলে সরকারের অন্যান্য দফতরের কর্মচারীদেরও এ কাজে শামিল করা হোক। প্রয়োজনে, ইচ্ছুক স্থানীয় মানুষদের থেকে ভলান্টিয়ার নিয়োগ করা হোক।
২) বাজারনির্ভর বীজ, সার, ইত্যাদির সরবরাহে আকালের জন্য যেন চাষের কাজ থেমে না-যায়। তা হলে, চূড়ান্ত খাদ্য সংকট ঘটবে। তাই, স্থানীয় ও আঞ্চলিক স্তরে স্বনির্ভর খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা সুনিশ্চিৎ করতে হবে। এ জন্য কৃষিকাজে জমির ব্যবহার ও পরিবেশবান্ধব স্থিতিশীল কৃষি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর খাদ্য উৎপাদনে সব রকম সরকারি সহায়তা দিতে হবে।
৩) লকডাউনের ফলে বেশির ভাগ মানুষের কাজ ও রোজগার বন্ধ। সেটা চালু না-হওয়া অবধি গরিব, দিনমজুরির আয়ে চলা মানুষ, কর্মচ্যুত পরিযায়ী শ্রমিক-সহ সকল প্রান্তিক মানুষকে মাসে দশ হাজার টাকা করে সরকারি অনুদান দিতে হবে। প্রান্তিক চাষি, ক্ষেতমজুর, মৎস্যজীবী-সহ যাঁরা খাদ্য উৎপাদন জারি রেখেছেন, তাঁদেরকেও এর আওতায় আনতে হবে। আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিক ও নানা কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষদের মতো সমাজের দুর্বলতর অংশগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। লকডাউনে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে নিহত পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৪) শুধু লকডাউন নয়, করোনার টেস্ট বা পরীক্ষা হওয়া জরুরি। এ জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক টেস্ট কিট বা পরীক্ষা সরঞ্জাম ও পরীক্ষাকেন্দ্রের ব্যবস্থা করতে হবে। টেস্ট কিট নিয়ে অনিয়ম বন্ধ করতে হবে।
৫) অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর বেহাল দশা ঠিক করতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে গ্রামে মহামারি প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে। একই ব্যবস্থা করতে হবে শহরের বস্তি এলাকা ও ঘন জনবসতিপূর্ণ অঞ্চলের জন্যও।
৬) করোনা-সংকটে দেশের কোথাও আপৎকালীন পরিস্থিতি তৈরি হলে, মানবাধিকার বজায় রেখে করোনা-বিস্তার ঠেকানোর জন্য জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার মতো পরিকাঠামো থাকতে হবে।
৭) প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে; বিশেষত, সেই সব জনগোষ্ঠীর মানুষকে যাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে নানা অবহেলা ও অপরাধের শিকার — আদিবাসী, নথিবহির্ভূত পরিযায়ী শ্রমিক, যৌনকর্মী, দলিত, ভিখারি, ভবঘুরে, ড্রাগ-আসক্ত, মানসিক রোগী প্রভৃতি।
৮) লকডাউনে ওষুধের আকাল দেখা দিচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে, সুলভ মূল্যে সব রকম জীবনদায়ী ওষুধ ও ক্রনিক রোগের ওষুধের ব্যবস্থা করতে হবে। ওষুধের কালোবাজারি কড়াভাবে রুখতে হবে। ওষুধের কোম্পানিগুলো যাতে মহামারি প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম বেশি দামে বেচে মানুষকে বিপন্ন না-করে, সেটা সরকারকে সুনিশ্চিৎ করতে হবে।
৯) যে সমস্ত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, সাফাইকর্মী করোনা রোগীদের সামলাচ্ছেন, তাঁদের সকলের জন্য পিপিই কিট-সহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এ নিয়ে কোনও দুর্নীতি, চাপানউতোর বা সমঝোতা চলবে না।
১০) করোনা-সংকটে চিকিৎসকেরা ছাড়াও যাঁরা সামনের সারিতে থেকে প্রতিরোধ করছেন, সেই সব পেশার কর্মীদের — যেমন, স্বাস্থ্যকর্মী, আয়া বা রোগীর পরিচর্যা-কর্মী, সাফাই-কর্মী প্রভৃতি, তাঁদের প্রত্যেকের জন্য যথাযোগ্য মজুরির ব্যবস্থা করতে হবে।
১১) শুধু করোনা নয়, দেশ জুড়ে সকলের জন্য বিনামূল্যে সরকারি স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা পরিষেবার ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ বন্ধ করে সরকারিকরণ বা জাতীয়করণ করতে হবে।
১২) সামরিক খাতে মাত্রাতিরিক্ত খরচ ও বড়ো পুঁজির সংস্থাকে ভর্তুকি দেওয়ার খরচ বন্ধ করে জনসাধারণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, সার্বিক চিকিৎসা ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য সরকারি বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
১৩) বড় হোটেল বা রিসর্ট, বেসরকারি হাসপাতাল প্রভৃতি বড়ো সংস্থা যেগুলো বিলাসবহুল পরিষেবা প্রদান করে, সেগুলোকে অধিগ্রহণ করে জনসাধারণের চিকিৎসা ও সামাজিক প্রয়োজনে কাজে লাগাতে হবে সরকারকে।
১৪) করোনা-জনিত আর্থিক মন্দার দোহাই দিয়ে গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি ও মাইনে কাটছাঁট করা চলবে না।
১৫) সরকারি-বেসরকারি, সংগঠিত-অসংগঠিত কোনও ক্ষেত্রের কাজ থেকে শ্রমিক-কর্মচারীদের ছাঁটাই করা চলবে না।
১৬) ব্যবসায়িক সংস্থাগুলোকে যে-কোনও রকম সরকারি সাহায্য দেওয়ার শর্ত হিসেবে সেই সংস্থাগুলোয় শ্রমিক-কর্মচারীদের ছাঁটাই আটকানোর বিষয়টি সরকারকে সুনিশ্চিৎ করতে হবে।
১৭) যাঁরা কাজ ও রোজগার খোয়াচ্ছেন ও খোয়াবেন, তাঁদের আর্থিক দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে। সর্বজনীন বেকার ভাতা চালু করতে হবে।
১৮) ঋণ গ্রহণকারী গরিব-মধ্যবিত্তের লোন ইএমআই বা ঋণ পরিশোধের মাসিক কিস্তি তিন মাসের জন্য স্থগিত ঘোষণার প্রহসন নয়, তিন মাসের সুদ মকুব করে প্রকৃত রেহাই দিতে হবে। প্রয়োজনে, কিস্তি পরিশোধের ক্ষেত্রে আরও ছাড় দিতে হবে।
১৯) বড়ো বড়ো কোম্পানিগুলোকে কড় ছাড় ও ভর্তুকি না-দিয়ে, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়িক সংস্থাগুলোর জন্য সরকারি সাহায্য বরাদ্দ করতে হবে।
২০) করোনা-সংকটের কোনও প্রকার সাম্প্রদায়িকীকরণ চলবে না। ইতিমধ্যেই সে অপপ্রচেষ্টা চালু হয়েছে। এর প্রতিবাদে জনতা পথে নামলে তার দায় সরকারের।
২১) ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে দাগিয়ে দিয়ে পরিয়ায়ী মানুষদের ওপর দমনপীড়ন ও ডিটেনশন ক্যাম্প বা জেলে পাঠানো যাবে না। এনআরসি, এনপিআর, সিএএ বাতিল করতে হবে।
২২) মানুষের জীবনের প্রয়োজনে যা-কিছু দরকার, সে দিকে নজর রেখে আন্তর্জাতিক, আন্তঃ-রাজ্য ও আন্তঃ-জেলা সীমানা তদারকি করতে হবে; চলাচলকারীদের অহেতুক হয়রানি করা বন্ধ করতে হবে।
২৩) জেলে রোগ সংক্রমণ আটকাতে, রাজনৈতিক বন্দি, ছোটোখাটো আইনভঙ্গের অপরাধে বন্দি-সহ সকল অ-হিংস্র বিচারাধীন ও সাজাপ্রাপ্ত বন্দিকে জরুরি ভিত্তিতে মুক্তি দিতে হবে।
২৪) করোনা-জনিত আর্থিক সংকটে জনসাধারণের জন্য প্রয়োজনীয় কোনও সরকারি প্রকল্প যেন বন্ধ না-হয়। সৌন্দর্যায়ন-সহ যাবতীয় অ-জরুরি প্রকল্প স্থগিত বা বাতিল করে সেই অর্থ জনস্বার্থে ব্যয় করতে হবে।
২৫) অর্থ সংকট মেটাতে দেশের অতি-ধনী ও ধনীদের থেকে সম্পত্তি কর-সহ বিশেষ কর আদায় করুক সরকার। জনসাধারণের ওপর যেন কোনও বাড়তি করের বোঝা চাপানো না-হয়।
২৬) আসন্ন অর্থ সংকট থেকে দেশের মানুষকে রেহাই দিতে, অন্যায্য শর্তে নেওয়া যাবতীয় বৈদেশিক ও আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধ স্থগিত রাখুক কেন্দ্রীয় সরকার। প্রয়োজনে, ওই সব ঋণ পরিশোধ বাতিল করুক।
সত্যি বলতে, দাবি আরও বহু ওঠা উচিৎ। কিন্তু কথা হচ্ছে, দাবি আদায়ের জন্য পথে না-নামলে কোনও সরকারই কোনও দিন কোনও দাবি মানে না। আপাতত লকডাউনে পথে যখন নামা যাচ্ছে না, ঘরে থেকেই প্রস্তুতিটা শুরু হোক। দাবিগুলোর সঙ্গে যদি একমত হন, তা হলে এ প্রতিবেদনটা শেয়ার করুন। যদি আরও দাবি তুলতে চান, কমেন্টে জানাতে পারেন।
এটা কি সত্য খবর