করোনা সবাইকে আক্রমণ করলেও এর সমাধান শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই করতে হবে, বলছে গ্রিসের কমিউনিস্টরা
করোনাভাইরাস অতিমারি প্রসঙ্গে গ্রিসের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-র পলিটব্যুরোর এই বক্তব্য সে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে হলেও তাদের মূল বক্তব্য ও দাবিগুলি সর্বজনীন, ফলে তা আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই এটি আমরা অনুবাদ করে প্রকাশ করলাম।
৩/১৩/২০২০
পরিবেশ ও সমাজে পুঁজিবাদের ক্ষতিকারক প্রভাবের জেরেই আজ এই ফ্লুয়ের অতিমারিতে জনগণকে ভুগতে হচ্ছে। এটার উৎস যেখান থেকেই হয়ে থাক, সব ক্ষেত্রেই মানুষের খাদ্যাভাস এবং পুষ্টির প্রশ্নটি জড়িয়ে রয়েছে। ভাইরাসের যে পরিবর্তনের(মিউটেশন)ফলেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ুক না কেন, তার সঙ্গে পরিবেশ এবং বুভুক্ষু মানুষের সম্পর্ক অবশ্যই রয়েছে। মাওবাদী চিনের সমাজতান্ত্রিক জমানায় সে দেশের মানুষ অপুষ্টি ও অনাহারের এই যন্ত্রণা থেকে মুক্ত ছিল।
সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ভেঙে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে পুঁজিবাদ যে অপরাধ করেছে, তারই ফল হল এই অতিমারি। চিনের পুঁজিবাদকে ‘অপরিণত’ বলে দেগে দিয়ে সেই সত্যটা লুকনোর চেষ্টা করা হচ্ছিল, কিন্তু উত্তর ইতালির মর্মান্তিক পরিস্থিতি বাস্তবটাকে নির্মম ভাবে সামনে নিয়ে এসেছে।
শুধু করোনাভাইরাস থেকে উদ্ভূত সংকটই নয়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার জেরেই নিয়মিত হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, অঙ্গহানি ঘটছে। সত্যি বলতে, পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যেকার প্রতিযোগিতা এবং তার ফলে যে ভয়ঙ্কর শোষণ তারা জনগণের ওপর চালায়, সেটাও করোনা-সংকটের অন্যতম কারণ। সে তারা গরিব মানুষকে কিছু দানধ্যান করে নিজেদের অমানবিক মুখে যতই মুখোশ আঁটার চেষ্টা করুক।
একটা বিষয় নিশ্চিত, আমাদের দেশের সরকারগুলো ধারাবাহিক ভাবে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবমূল্যায়ন ও বিনির্মাণ ঘটানোর ফলে আজ সেটা জনগণের কাজে লাগছে না। এই দায়িত্ব অবশ্যই সরকার এবং তার নীতির।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কেবলমাত্র হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই পরিস্থিতি চূড়ান্ত খারাপ অবস্থায় পৌঁছয়নি। সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত(দেরি করে স্কুল বন্ধ করা, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি, শেষ মুহূর্তে কিছু নিয়োগ, যদিও সেটা ২০১৯ –এর গ্রীষ্মে যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার থেকেও কম) এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রগুলির ব্যর্থতা(জনস্বাস্থ্য পরিষেবার জাতীয় সংগঠন, বি৫আনীদের ভন্ডামিপূর্ণ বিবৃতি)দেখায় যে জনগণের যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে তাদের বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই।
সম্পূর্ণ ভাবে সরকারের এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জনগণ, শ্রমজীবী মানুষ ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে অবশ্যই সকল নাগরিক ও উদ্বাস্তুদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার দাবি জানাতে হবে(বয়স, ধর্ম, চাকরি বা জাতিগত কোনো বঞ্চনা করা চলবে না)। এই ফ্লু আক্ষরিক ভাবে যে কোনো মানুষকে আক্রমণ করলেও, এর সমাধানের শ্রেণি চরিত্র থাকবে।
সরকারি ঘোষণাগুলির প্রতি জনগণের যে ন্যায্য অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, তা আতঙ্ক তৈরি করে বা সমস্যাকে ছোটো করে দেখিয়ে সমাধান করা যাবে না। বরং যৌথ উদ্যোগ, বিতর্ক এবং সক্রিয়তাকে হাতিয়ার করেই সমাধান আসবে।
আমাদের অবশ্যই দাবি তুলতে হবে-
• সরকারি এবং বেসরকারি সব জায়গায় জনগণকে নিখরচায় এবং বাধাহীন ভাবে রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা পরিষেবার সুযোগ দিতে হবে।
• এখনই সব হাসপাতালে নতুন শয্যা ও আইসিইউ-র বন্দোবস্ত করতে হবে।
• সব হাসপাতালের সব শূন্য পদে এখনই স্থায়ী কর্মী নিয়োগ করতে হবে।
• সমস্ত বৈধ পদ্ধতি ও সরঞ্জাম দিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা দিতে হবে। তাদেরকে খারাপ পরিবেশে ঘণটার পর ঘণ্টা কাজ করানো চলবে না।
• সকলকে ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিখরচায় দিতে হবে (Free delivery to the people of all the necessary material of individual protection (জীবানুনাশক জেল, মুখোশ ও দস্তানা)। জনগণ ব্যবহার করেন, এমন সমস্ত জায়গাকে জীবানুবিহীন করতে হবে।
• সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে কোনো মাইনে কাটা, চাকরি যাওয়া, কোনো অধিকার কেড়ে নেওয়া(ছুটি, বাড়তি কাজের বাড়তি পয়সা) চলবে না। যেসব সংস্থা বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের সব কর্মীদের পুরো বেতন দিতে হবে। যাদের বাড়ি থেকে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে, তাদেরকেও পুরো টাকা দিতে হবে।
• পাঠক্রম শেষ করার নামে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করানো চলবে না। কোনো কায়দা করেই পরীক্ষা নেওয়া যাবে না।স্কুলের ছুটি কেড়ে নেওয়া যাবে না।
• উদ্বাস্তুদের সব বন্দি শিবির এখনই বন্ধ করতে হবে। সব উদ্বাস্তু ও অভিবাসীদের জন্য বসবাসের উপযুক্ত বাড়ি ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের ব্যবস্থা করতে হবে। .
প্রচ্ছদের ছবিটি গ্রিস-তুরস্ক সীমান্তে অভিবাসীদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তির।