টিঁকে থাকার সহজ উপায়ের মতো কোয়ারান্তাইনের সঙ্গে মানিয়ে নেবার অনেক রাস্তাই হয়তো এর মধ্যে আপনারা আবিষ্কার করে ফেলেছেন। আমার মতন যারা সিনেমাখোর, তাদের জন্যে একটা মজার তালিকা রইল। মজার বলছি এই কারণে যে এই ছবিগুলো আপনারা নিশ্চই দেখেছেন। সিনেমা দেখিয়েদের কাছে খুবই পরিচিত নাম। আমি কোনো নতুন তথ্য দিচ্ছি না। কিন্তু আগে কখনো হয়তো মনে হয়নি যে কোনো একদিন আমাদের দশাও এই ছবিগুলোর মুখ্য চরিত্রদের মতো হবে।
আজকে এই লক ডাউনে বাড়িতে বসে মনে পড়ছে ছোটোবেলায় দেখা হোম অ্যালোনের কেভিনের কথা। ১৯৯০ সালের এই ছবিতে কেভিনের চরিত্রে ৭/৮ বছরের ম্যাকলে কালকিন কিরকম একা গোটা বাড়িতে পুরো ক্রিসমাসের ছুটি কাটিয়েছিল! শুধু তাই নয় দু – দুটো সাংঘাতিক গুন্ডাকেও বাড়ি বসে শায়েস্তা করেছিল।
তারপর ধরুন কয়েকবছর আগের স্পেস মুভি গ্র্যাভিটি কিংবা মার্শিয়ান। ২০১৩ সালের আলফানসো কুয়ারন পরিচালিত গ্র্যাভিটি। তাতে জর্জ ক্লুনি আর সান্দ্রা বুলক মহাকাশ অভিযানের পথে দুর্ঘটনায় আটকে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে জর্জ ক্লুনি মারা যায়। তারপর সান্দ্রা বুলক একা লড়াই করে পৃথিবীতে ফিরে আসে। প্রায় গোটা সিনেমাটা জুড়ে মহাকাশে সান্দ্রার বেঁচে থাকার লড়াই দেখতে দেখতে মনে হবে মহাশূন্যের মতো কোন আপাত অসীম বিস্তারও কত ক্লস্ট্রোফোবিক হয়ে উঠতে পারে। ঠিক এরকমই আরেকটি ছবি ২০১৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল। রিডলি স্কট পরিচালিত দ্য মার্শিয়ান। তাতে ম্যাট ড্যামন মঙ্গল অভিযানে গিয়ে সেই ভিন গ্রহে আটকা পড়ে যায়। দিনের পর দিন মঙ্গলের মাটিতে কৃত্রিম উপায় জল তৈরি করে টিঁকে থাকে সে। এছাড়া ২০০০ সালের টম হ্যাঙ্কসের কাস্ট অ্যাওয়ে ছবিটির কথা আশা করি সকলের মনে আছে। প্লেন দুর্ঘটনায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া টমের ঠাঁই হয় একটি জনশূন্য দ্বীপে। সেই একইভাবে প্রকৃতি থেকে রসদ খুঁজে নিয়ে সে বাঁচিয়ে রাখে নিজেকে।
আরো সাংঘাতিক গল্প হল ওয়ান টোয়েন্টি সেভেন আওয়ারস ছবিটির। পর্বত অভিযাত্রী আরন র্যালস্টোনের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ড্যানি বয়েল পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পায় ২০১০ সালে। আরনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জেমস ফ্রাঙ্কো। ইউটার ব্লুজন ক্যানিয়নে আটকা পড়ে যায় আরন। তারপর এক অভিনব কায়দায় ১২৭ ঘণ্টা পর সে নিজেই নিজেকে উদ্ধার করে। কী ভাবে করে সেটা আর বিশদে বললাম না; এই লক ডাউন জীবনে আপনাদের মতো সিনেমাপ্রেমী পাঠক নিজেই ছবিটা দেখে নেবেন এই আশায়। যাই হোক এরকম আরো নানান ছবি হয়তো আপনাদেরও মাথায় আসবে লেখাটা পড়তে পড়তে। সেগুলো জানতে পারলে আমি সমৃদ্ধ হব।
শেষ করার আগে দুটি ছবির নাম করব। ছবি দুটি এই বাধ্যতামূলক বিচ্ছিন্নতা বিষয়ক না হলেও গল্পের কিছু অংশে এরকম জীবন যাপনের কথা দেখানো হয়েছে। ২০১৫ সালের ছবি রুম। জয় নামের এক তরুণী ও তার ৬ বছরের ছোট ছেলে জ্যাককে দীর্ঘ সাত বছর ধরে একটিমাত্র ঘরে বন্দি করে রাখে এক সাইকোপ্যাথ অপরাধী। জয়কে রেপ করায় তার ছেলে জ্যাকের জন্মই হয় ওই ছোট্ট ঘরের মধ্যে। তারপর একদিন ৬ বছরের জ্যাকের বুদ্ধিতে সে আর তার মা মুক্তি পায়। কিন্তু দীর্ঘ সাত বছর ওই ছোট্ট ঘরে থাকতে থাকতে জয় বাইরের জগতের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারে না। কিভাবে ছোট্ট জ্যাকের প্রেরণায় তার মা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে তাই নিয়ে বাকি গল্প। অসাধারণ অভিনয়ের জন্যে সেবছর অস্কার পেয়েছিলেন জয়ের ভূমিকায় ব্রি লারসন।
দ্বিতীয় ছবিটি হল প্যারাসাইট। গত বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাম দি’ওর ও এবছর অস্কার জয় করে রীতিমতো সারা ফেলে দিয়েছে এই ছবিটি। ছবিটির মূল বিষয় যদিও সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু এখানেও এক ধরনের বাধ্যতামূলক নিঃসঙ্গতার কথা বলা হয়। বড়লোক মনিবকে খুন করে ফেরার হয়ে যায় কিম। পুলিশ থেকে শুরু করে তার পরিবারের কেউ জানতে পারে না সে কোথায় গা ঢাকা দিয়ে আছে। ছবির শেষে দেখা যায় মনিবের প্রাসাদের আন্ডারগ্রাউন্ডে এক গোপন কুঠুরিতে সে নিঃশব্দে জীবন কাটাচ্ছে। মনিবের পরিবার যখন বাড়ি থেকে বেরোয়, তখন সে ওপরে উঠে আসে। ফ্রিজ থেকে টুকিটাকি খাবার বের করে খায়, তারপর আবার চলে যায় পাতালের জঠরে। তার মতো মানুষের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় মনিবের বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ড। যে পাতালঘরের অস্তিত্বের কথা স্বয়ং বাড়ির মালিকও জানে না।
আর দু-এক বছরের মধ্যেই নিশ্চই হলিউড থেকে বলিউড, কিংবা অন্য দেশগুলোতেও সর্বত্র করোনা কোয়ারান্তাইন নিয়ে ছবি তৈরি হবে। ভবিষ্যতের অন্য কোনো সংকটের দিনে সেইসব সিনেমাও উদাহরণ হয়ে উঠবে। বন্দি হওয়ার সংকট থেকেই তো আমরা মুক্তির পথ খুঁজি। করোনা কোয়ারান্তাইন নিয়ে তৈরি ছবিও আমাদের নতুন আলো দেখাবে, এটুকুই আশা।
প্রচ্ছদের ছবিটি ‘রুম’ সিনেমার একটি দৃশ্যের