শ্রমিকদের উপর জীবানুনাশক স্প্রে: নয়া অশউইটজ
“The cry of the poor is not always just, but if you don’t listen to it, you will never know what justice is.” (Howard Zinn, A People’s History of United States)
উত্তরপ্রদেশের বেরিলিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরে আসতে বাধ্য করে তারপর তাদের রাস্তার মাঝখানে বসিয়ে ডিসইনফেক্ট্যান্ট স্প্রে করেছে আদিত্যনাথের সরকার। ডিসইনফেক্ট্যান্ট স্প্রে করা হয় জড় পদার্থকে জীবাণুমুক্ত করবার জন্য এবং তাও খোলা রাস্তায় নয়, অনেক নিয়মবিধি মেনে এবং মানুষের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে। অর্থাৎ আদিত্যনাথের সরকার এদেরকে জন্তুরও অধম মনে করে।এই ঘটনা চোখের সামনে সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখে অমানবিক বলে ‘ছিছি’ করছেন বাঙালি মধ্যবিত্তরাও। কিন্তু এখন যারা ‘ছিছি’ করছেন, তাঁরা কি ভেবে দেখবেন এই অমানবিকতার দায় শুধু একা যোগী সরকারের নয়, ছোটোবেলা থেকে শ্রমজীবীদের ‘ছোটোলোক’ বলে গণ্য করার মধ্যবিত্ত মানসিকতাই ফ্যাসিস্ট যোগী সরকারদের এই বর্বর কাজ করবার ‘কনসেন্ট ম্যানুফ্যাকচার’ করায়। এর মানে এই নয় যে শ্রমজীবীরা সবাই সাধুপুরুষ। তাদের যাবতীয় অন্যায় আচরণকেই যে তাদের দারিদ্র দিয়ে বিচার করা যায়না একথাও মানি। কিন্তু প্রশ্নটা হলো এই বিচার করবার অধিকার কি সমাজের উপরের শ্রেণির আছে? করোনার জন্য একটা গোটা দেশ যেভাবে স্তব্ধ হয়ে আছে, দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধেও তা হয়নি। অভূতপূর্ব পরিস্থিতি! আর এই পরিস্থিতি প্রমাণ করেছে, আমাদের দেশে কথায় কথায় বিদেশযাত্রায় সক্ষম তথাকথিত শিক্ষিতরা কতোটা অশিক্ষিত আর দায়িত্বজ্ঞানহীন। আমলার ইংল্যান্ডে পাঠরত ছেলে ক্ষমতার জোরে শপিংমলে ঘুরেবেড়িয়ে হাজার লোককে ইনফেক্ট করে বেরিয়েছে, তালি বাজাবার নামে বেঙ্গালুরু এয়ারপোর্টে সুবেশিত জনতা সোশাল ডিসটেন্সিং-এর গুষ্টির তুষ্টি করেছে(শুধু বস্তিবাসীরাই নয়), করোনা থেকে বাঁচার জন্য চরণামৃতের মতো গোমূত্র পান করেছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে আমাদের সবদিক দিয়ে অশিক্ষিত নেতা-মন্ত্রীরা যাদের আবার নির্বাচিত করি আমরা ‘অরাজনৈতিক’ শিক্ষিতরা। শতশত মানুষদের,যারা প্রাণের দায়ে বাড়ি ফিরছিলো, সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে অনায়াসে ইচ্ছামতো আটকে দেওয়া হলো এই কারণে যে তারা প্যানডেমিক ছড়াতে পারে। অর্থাৎ তারা দেশের জন্য থ্রেট। অর্থাৎ ‘মানবিকতা-ফতা’ এখন গুলি মারো, বিজ্ঞানটা ভাবো। সত্যিই কি তাই? যাদের ফিরিয়ে আনা হলো তাদের এবার কোথায় রাখা হবে? তাদের কি সোশ্যাল ডিসটেন্সিং মেনে আলাদা আলাদা ঘরে রাখা হবে? হাজার হাজার শ্রমিক পরিবারের জন্য সেই ব্যবস্থা করা কি সম্ভব? তার মানে সেই তাদেরকে এক ঘরে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করেই থাকতে হবে। খোলা রাস্তার থেকে বদ্ধ জায়গায় গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকলে, অর্থাৎ ওভারক্রাউডিং করে থাকলে শুধু করোনা নয়, সমস্ত শ্বাসতন্ত্রর রোগসহ চর্মরোগ, চোখ ও কানের সংক্রমণ সবই অনেক বেড়ে যাবে।
আরও পড়ুন: মহামারি সেখানেই পা ফেলে যেখানে দেশ-কাল-সমাজ আগে থেকেই জীর্ণ, বলছে ইতিহাস
আর যদি, রূপকথার গল্পের মতো ধরে নিই তাদের আদর্শ কোয়ারানটিন-এই রাখা হবে, তাহলে সেটা আগে করা হলোনা কেন? তাদের খাবার আর আশ্রয় দিতে সরকারকে বাধ্য করবার জন্য কেন সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন করতে হবে? তার থেকে আগে থেকে লকডাউন ঘোষণা করে সরকার যদি তাদের নিজেদের বাড়ি ফিরে যাওবার জন্য যথেষ্ট সময় দিত এবং তাদের যাতায়াতের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিত তাহলে এই হাজার মানুষের জমায়েতটাকে কিছুটা হলেও এড়ানো যেতো।
অন্যদিকে সেই একই বৈজ্ঞানিক যুক্তিতেই,’মানবিকতা-ফতা’ গুলি মেরেই অনেক বেশি জোরের সাথে বলবো ডিসইনফেক্ট্যান্ট স্প্রে করাটা অনেক বেশি ক্ষতিকর, এতে খুব কম সময়ে অনেক মানুষের শরীরের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট বেশি। এমনকি দুর্বলদের মৃত্যুর সম্ভাবনাও থাকে। এতে যে কোনো লাভ নেই তা ডবলু এইচ ও স্পষ্ট করে জানিয়েছে(উপরের পোস্টার দ্রষ্টব্য)। সেই একই বৈজ্ঞানিক যুক্তিতেই অনেক জোরের সাথে বলবো কণিকা কাপুর এদের থেকে অনেক বড়ো থ্রেট ছিলো। যখন সে নিশ্চিন্তে প্রভাবশালীদের সাথে দহরম-মহরম করেছে, তখন তো এই ‘বিজ্ঞান-ফিজ্ঞান’টা মানা হয়নি! মোদীর ‘তালিমারা’ স্পিচের পরেও বিজেপি যখন শতশত লোক জড়ো করে সভা করেছে তখন তো এই ‘বিজ্ঞান-ফিজ্ঞান’টা মানা হয়নি! জোরের সাথে বলবো, যদি এই বিপুল সংখ্যক মানুষের,যাদের মধ্যে রয়েছে প্রচুর শিশু, প্রসূতি ও বৃদ্ধ, পুনর্বাসন না করলে যে দু্র্ভিক্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তা কম ভয়াবহ নয়। কই, টিভিতে ‘রামায়ন’ দেখার ফোটো পোস্ট করা প্রকাশ জাভাডেকর তো এই ‘বিজ্ঞান-ফিজ্ঞান’টা নিয়ে কিছু বলছে না? গোমূত্র সরকার দরকার মতো ‘বিজ্ঞান’টা প্রয়োগ করে, তবে সেটা ছোটোলোকদের শাসিয়ে রাখার জন্য!
কারণ একটাই, শ্রমজীবীরা সংখ্যায় অনেক, কিন্তু ক্ষমতার জোরে শূন্য! মধ্যবিত্তদের ভাবটা হলো নোংরা, অস্বাস্থ্যকর বস্তিতে থাকা মানুষেরা গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে আর শুধু রোগ ছড়ায়। খুব দুঃখজনক হলেও সত্যি, জনস্বাস্থ্যের অনেক ডিগ্রিধারীদের কাছেও, জনস্বাস্থ্য একটি সমাজবিজ্ঞান হওয়া সত্বেও, এদের পরিচয় শুধু রোগের রিজার্ভার হিসাবে। যেন এরা মধ্যবিত্তদের ঘাড়ে বসেবসে খায়! অর্থনীতির বাকি সব ফেলে দিয়ে যে জিডিপি নিয়ে মোদী সমেত সব সরকারের এতো আদিখ্যেতা, সেই জিডিপি তৈরি করার মুখ্য কারিগর কারা? এরাই। মধ্যবিত্তের মহান নেতা মোদীর স্বপ্নের পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের ইকোনমি কারা তৈরি করবে? এরাই। মধ্যবিত্তের আরেক হাস্যকর অভিযোগ হলো এরা ট্যাক্স দেয় না। আরে ট্যাক্স দেওয়ার মতো ইনকাম করলে তবে তো দেবে!আর ইনকাম ট্যাক্সটাই কি একমাত্র ট্যাক্স? মার্চ মাস পড়লেই যে ভাবে হোক ইনকাম ট্যাক্স ডিডাকশনের জন্য পাগল হয়ে যাওয়া মধ্যবিত্তর মাথাতেও থাকে না ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স বলে একটা বস্তু আছে। একটা সাবান কিনলেও সেই ট্যাক্সটা দিতে হয় এবং সেটা মুকেশ আম্বানি আর রাস্তার ঠেলাওয়ালার ক্ষেত্রে একই। আর ছোটোলোকদের এই গালাগালিটা মারার সময়ে তাঁরা ভুলে যান তাঁদের মেগাস্টার ‘বিগবি’ থেকে ছোটো-বড়ো শিল্পপতিরা কী কী ভাবে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়।
এখনো অবধি লকডাউনের বিজ্ঞানের বিরোধিতা করবার মতো কোনো জোরালো প্রমাণ নেই। সুতরাং লকডাউন সমর্থন করবো। কিন্তু এর নামে যে নৃশংসতা চলছে সেটা বিজ্ঞান নয়, সেটা ঘৃণ্য রাজনীতি। যাঁরা তর্ক করেন এতো লোকের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা সরকারের নেই, সরকারই এই সব ঘৃণ্য কাজ করে তাঁদের দেখিয়ে দেয়, অক্ষম বলে নয়, এদের মানুষ বলে মনে করে না বলেই সরকার দায়িত্ব নেয় না। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় এয়ারইন্ডিয়ার প্লেনে করে ইতালিবাসী ভারতীয়দের, যারা নিজেদের ফেরার খরচ নিজেরাই বহন করতে পারে, তাদের ফেরত নিয়ে এসে পৃথিবীর কাছে নিজের ‘লিডারশিপ’ দেখিয়ে নাম কিনতে সরকারকে ভাবতে হয় না। কারণ তারাই তো দেশে না থেকেও দেশের ‘নাগরিক’!