বড়ো সংস্থার ওপর করোনা-কর চাপিয়ে শ্রমজীবীদের মাসে ১০ হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া সম্ভব
পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: করোনার সংক্রমণ এড়াতে নরেন্দ্র মোদীর সরকার ১৩০ কোটি ভারতবাসীকে আগামী ২১ দিনের জন্য জোর করে ঘরে বন্দি করে দিয়েছে। আর বলেছে ৩ টাকা কিলো দরে চাল আর ২ টাকা কিলো দরে গম মিলিয়ে মাথা পিছু সাত কিলো করে প্রতি মাসে দেওয়া হবে আগামী তিন মাসের জন্য। কিন্তু শুধু কাঁচা চাল আর গম খেয়ে মানুষ কি বাঁচতে পারে? এক দিন রোজগার না হলে যাঁদের হাঁড়ি চড়ে না, সেই দিন আনা দিন খাওয়া মানুষরা চাল গম রান্না করার জ্বালানি, গ্যাস প্রভৃতি কিনবেন কীভাবে? অন্তত বাচ্চাদের জন্য ডাল, সবজি, মাছ-ডিম, দুধ প্রভৃতি কিনবেন কী করে? বিদ্যুতের বিল মেটাবেন কীভাবে? দিন মজুর, কৃষি মজুর, অটো-টোটো চালক, রিক্সা চালক, বাস- ট্রাকের ড্রাইভার-খালাসি, ছোট দোকানের মালিক-কর্মচারী প্রভৃতির রোজগার তো লক ডাউনের ফলে সম্পূর্ণ বন্ধ। এই সব মানুষকে আইসোলেশনে রেখে করোনা সংক্রমণকে সত্যিই ঠেকাতে হলে চাল- গম ছাড়াও তাদের আর্থিক সাহায্য দিতেই হবে। না হলে আজ না হোক কাল কয়েক কোটি দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ স্রেফ পেটের টানেই লক ডাউন উপেক্ষা করে পথে বেরোতে বাধ্য হবেন। এর ফলে করোনা ছড়াবে। মৃত্যুর মিছিল শুরু হবে। আর সরকার যদি পুলিশ মিলিটারি দিয়ে এই সব মানুষকে ঘরে বন্দি করে রাখতে পারে (যা বাস্তবত অসম্ভব), তাহলে শুরু হবে অনাহারে মৃত্যুর মিছিল।
সরকারের নেতা, মন্ত্রী, অফিসারদের অজুহাত হল এত মানুষকে আর্থিক সাহায্য দেবার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন এবং এত অর্থ সরকারের হাতে নেই। অথচ ভারতের অতি ধনীদের ওপর কর বসিয়ে সরকার কিন্তু অনায়াসেই প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করে নিতে পারে। কিন্তু বড়লোকদের ওপর কর বসানোর নীতি নিয়ে তো মোদি সরকার চলছে না। অন্য কোনও সংসদীয় দলও বড়োলোকদের ওপর কর বসানোর দাবি করছে না। আমরা দেখাব কিভাবে কর্পোরেট সংস্থা এবং দেশের উচ্চ বেতনভুক কর্মচারীদের ওপর কর চাপিয়ে সরকার অনায়াসেই ছয় মাসের জন্য গরিব মানুষদের অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা করে তাঁদের আইসোলেশনে রাখা সম্ভব।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে শ্রমিক- কর্মচারির সংখ্যা এখন প্রায় ৪০ কোটি। যদিও এদের সকলেই দিন মজুর শ্রেণিভুক্ত নন, অনেকেরই মাস মাইনে আছে। তবু যেহেতু এই ৪০ কোটি শ্রমিকের প্রায় ৯৩ শতাংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন এবং এদের অধিকাংশই এক দিন কাজে না গেলে সেই দিনের বেতন পান না, অনেকেই দিন মজুর তাই আমরা ধরে নিচ্ছি যে আইসোলেশনে থাকা এই ৪০ কোটি মানুষকেই আর্থিক সাহায্য বা ভাতা দিতে হবে। প্রত্যেককে মাসে ১০,০০০ টাকা করে ভাতা দিলে প্রতি মাসে চার লক্ষ কোটি টাকার প্রয়োজন পড়বে। যদি ছয় মাসের জন্য এই ভাতা চালু রাখতে হয় তবে ২৪ লক্ষ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু এর চেয়ে অনেক কম অর্থ প্রয়োজন হবে। যাদের মাস মাইনে রয়েছে বা যারা সবেতন ছুটি পাচ্ছেন, তাঁদের ভাতা দিতে হবে না। যাদের পে-কাট হয়েছে কিন্তু কিছু বেতন পাচ্ছেন, তাদের ভাতার পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই কম হবে। আর করোনাকে ছয় মাসের আগেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে ছয় মাস ধরে ভাতা দেবার প্রয়োজন হবে না। তবু আমরা ধরে নিচ্ছি ২৪ লক্ষ কোটি টাকাই প্রয়োজন হবে।
কোথা থেকে এত টাকা আসবে?
দেশের মাত্র ১৫ টি বড় কোম্পানির ২০১৯ সালের নিট মুনাফার হিসেব নিয়েছি আমরা। এই মুনাফার পরিমাণ হল ৪ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। প্রথম ৫০০ টি কোম্পানির নিট মুনাফা ১০০ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি (সূত্রঃ ইটি ৫০০, ২০১৯ র্যাঙ্কিং)। মনে রাখতে হবে যে এই মুনাফা হল কোম্পানিগুলির অন্যান্য সমস্ত খরচ এবং কর দেবার পরে নিট মুনাফা। সরকার যদি এই মুনাফার ওপর ২৫ শতাংশ কর বসায়, তাহলেই প্রয়োজনীয় ২৪ লক্ষ কোটি টাকা উঠে আসবে। আর এই টাকা থেকে গরিব মানুষকে ভাতা দিলে তাদের আর ক্ষুধার জ্বালায় লক ডাউন ভেঙ্গে রোজগারের আশায় পথে নামতে হবে না। আইসোলেশন সফল হবে। ফলে করোনা সংক্রমণ ছড়াবে না।
অনেকেই বলতে পারেন যে কোম্পানির মুনাফার ওপর এভাবে কর বসানো ন্যায় সংগত হবে না। আমাদের প্রশ্ন, সরকার যদি গরিব মানুষের রুটি রুজি বন্ধ করে তাদের ঘরে বসিয়ে দিতে পারে, তবে এই সংকটের সময়ে ধনী কোম্পানিগুলির ওপর কর বসাতে পারবে না কেন? তাছাড়া শ্রমিকদের শ্রমের ফলেই তো কোম্পানিগুলি মুনাফা করে। রিলায়েন্স ইন্ডাসস্ট্রিস গত বছর নিট মুনাফা করেছিল ৩৯,৫৮৮ কোটি টাকা। আইটিসি-র সংস্থাগুলি এ বছর প্রথম কোয়ার্টারেই মুনাফা করেছে ১২,০০০ কোটি টাকার বেশি। উইপ্রো’র মুনাফা ছিল ৯০০৩ কোটি। এশিয়ান পেইন্টসের ১৯,৬০৯ কোটি। হিন্দুস্তান ইউনিলিভারের ৩৯,৮৬০ কোটি। ইনফোসিসের ১৫,৪০৪ কোটি। অভাবনীয় এই দুর্যোগের সময় বিশাল মুনাফা করা এই কোম্পানিগুলির ওপর করা বসানো অন্যায় হবে কেন?
করোনা মোকাবিলার জন্য কর বসিয়ে অর্থ সংগ্রহের আরও উৎস রয়েছে। আমাদের দেশে রয়েছেন বিভিন্ন উচ্চ বেতনভুক অফিসাররা যাঁদের ওপর করোনা-কর বসানো যেতেই পারে। ২০১৯ সালে টেক মহিন্দ্রর সিইও জিপি গুড়ানির বাৎসরিক বেতন ছিল ১৫০.৭ কোটি টাকা। হিরো মোটোকর্প-এর সিইও পবন মুঞ্জাল বেতন হিসাবে নিয়েছিলেন ৬০ কোটি টাকা। ইনফোসিস-এর বিশাল সিক্কা বেতন পেয়েছেন ৪৫ কোটি টাকা। টাটা গ্রুপের নটরাজন চন্দ্রশেখরণ পেয়েছিলেন ২৬ কোটি টাকা। ভারতে প্রায় ৯৭,০০০ উচ্চ বেতনভুক অফিসার রয়েছেন, ২০১৭-১৮ সালে যাঁদের বাৎসরিক আয় ছিল এক কোটি টাকা বা তার বেশি। (সুত্রঃ রিপোর্ট, সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস ২০১৯)। এই স্তরের অফিসারদের ওপরেও ২৫ শতাংশ হারে করোনা-কর বসানোই যায়। দেশের সিনেমা তারকারা বিশাল অর্থ রোজগার করেন। ২০১৮ সালে সালমান খানের আয় ছিল ২৫৩ কোটি টাকা। অক্ষয় কুমার আয় করেছিলেন ১৮৫ কোটি, আমির খান ৯৮ কোটি, অমিতাভ বচ্চন ৯৭ কোটি, শাহরুখ খান ৫৬ কোটি, রজনিকান্ত ৫০ কোটি। ক্রিকেটার বিরাট কোহলি আয় করেছিলেন ২২৮ কোটি টাকা, ধোনি ১০১ কোটি, শচিন তেন্ডুলকর ৮০ কোটি। (সুত্রঃ বিজনেস ইনসাইডার) এদের থেকেও কর নেওয়া যেতে পারে। দেশের ৪৭৫ জন সাংসদ কোটিপতি। বিজেপির ৩০৩ সাংসদের মধ্যে ২৬৫ জনই কোটিপতি। কংগ্রেসের ৫১ জনের মধ্যে ৪৩ জন কোটিপতি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত ৪২ জন সাংসদের মধ্যে ৩১ জন কোটিপতি। ‘গরিব দরদি’ এই সব রাজনীতিকরাই বা করোনা মোকাবিলার জন্য কর দেবেন না কেন? এই ভাবে সমস্ত উৎস থেকে করোনা-কর ওঠালে যে অর্থ সংগ্রহ করা যাবে, তা দিয়ে অনায়াসেই দেশের হাসপাতালগুলির পরিকাঠামো উন্নত করে আরও ভাল ভাবে করোনার চিকিৎসা করা সম্ভব হবে। আইসোলেশনে থাকা গরিব মানুষদের মুখেও ভাত তুলে দেওয়া যাবে।
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে ধনীদের ওপর কর বসিয়ে ভারত সরকার অনায়াসে আরও ভাল ভাবে করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে। আইসোলেশনে থাকা অবস্থায় দিন মজুরদের আর্থিক সাহায্য দিতে পারে। কিন্তু তা না করে সরকার করোনা-আইসোলেশনের নামে গরিব মানুষের রুটি-রুজি বন্ধ করে তাঁদের অনাহারে রাখতে চাইছে। গরিব মানুষকে ভাতা না দিলে দেশে অনাহারে মৃত্যু বাড়বে। লক ডাউন বা আইসোলেশনও সম্ভব হবে না।
সবই তো বুঝলাম! কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে?