প্রধানমন্ত্রীর ‘জনতা কারফিউ’-এর নিদান শ্রমজীবী বিরোধী: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ আনোয়ার হোসেন
প্রশ্ন: করোনা ভাইরাস কী?
উত্তর: করোনা ভাইরাস, অর্থাৎ এখন যে ভাইরাস নিয়ে মানুষ আতঙ্কিত, তা হলো করোনা ভাইরাস পরিবারের একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির ভাইরাস যা ফুসফুসের প্রদাহ সৃষ্টি করে, যার নাম দেওয়া হয়েছে SARS-COV-2 (Severe Acute Respiratory Syndrome Corona Virus-2) এবং রোগটির নাম ‘করোনা ভাইরাস ডিজিজ-১৯’ বা COVID-19.
প্রশ্ন: কীভাবে ছড়ায়?
উত্তর: ‘করোনা ভাইরাস ডিজিজ-১৯’ বা COVID-19-এ আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, থুথু ইত্যাদি থেকে ড্রপলেট-এর মাধ্যমে নিকটবর্তী মানুষদের (close contact) মধ্যে ছড়ায়।
প্রশ্ন: এই রোগ কতটা বিপদজনক?
উত্তর: কোনো রোগের বিপদের মাত্রা যে যে বিষয়ের নির্ভর করে তার মধ্যে অন্যতম হলো সেই রোগের মারণ ক্ষমতা (case fatality rate) অর্থাৎ ১০০ জন আক্রান্তের মধ্যে কতজনের মৃত্যু হয় ও গৌণসংক্রমণ হার (secondary attack rate) অর্থাৎ রোগীর সান্নিধ্যে আসা ১০০ জন মানুষের মধ্যে যতজন মানুষ আক্রান্ত হন।
‘করোনা ভাইরাস ডিজিজ-১৯’ বা COVID-19-এর ক্ষেত্রে মারণ ক্ষমতা ৩.৫ শতাংশের কাছাকাছি। গৌণ সংক্রমন হার এখনও পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা না গেলেও, মোটামুটি ১০ শতাংশের কাছাকাছি ধরা যেতে পারে।
আরও পড়ুন: সিএএ ২০০৩ বাতিল না হলে এনআরসি রোখা যাবে না, রাস্তার লড়াই ছাড়া উপায় নেই
প্রশ্ন: কাদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি?
উত্তর: ‘করোনা ভাইরাস ডিজিজ-১৯’ বা COVID-19-এ আক্রান্ত মানুষের সান্নিধ্যে আসা সমস্ত বয়সের মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। তবে মৃত্যু-হার বয়স্ক মানুষদের মধ্যে বেশি।
প্রশ্ন: করোনা নিয়ে কি অযথা আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে?
উত্তর: আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে কথাটা ঠিক নয়। তবে মানুষ আতঙ্কিত হচ্ছে এটাও ঠিক। বিভিন্ন সোশাল মিডিয়া কিছুটা হলেও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে তো বটেই।
প্রশ্ন: করোনার চিকিৎসা কী?
উত্তর: এখনও পর্যন্ত এই ভাইরাস মারার কোনও ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। ফলে রোগের লক্ষণ অনুযায়ী চিকিত্সাই একমাত্র অস্ত্র। সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ বন্ধ করাতে।
প্রশ্ন: সাধারণ মানুষ কী কী প্রতিষেধক ব্যবস্থা নিতে পারেন?
উত্তর: প্রতিষেধক টিকা এখনও আবিষ্কার হয়নি। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে মাস্ক পরা, সাবান দিয়ে বার বার হাত ধোয়া, যতটা সম্ভব জনসমাগম থেকে দূরে থাকা প্রয়োজন। জ্বরের সাথে কাশি ও শ্বাসকষ্ট থাকলে সাথে সাথে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া খুব জরুরি।
প্রশ্ন: করোনা প্রতিরোধে সরকারি পরিকাঠামো কি যথেষ্ট?
উত্তর: স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এমনিতেই অপ্রতুল। মনে রাখতে হবে সারা দেশে জনসংখ্যার তুলনায় হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা অনেক কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রতি ১০০০ জনসংখ্যায় যেখানে ১০ টি হাসপাতাল শয্যা থাকার কথা, সেখানে আমাদের দেশে আছে মাত্র ০.৯ টি, যার মধ্যে ০.৫ টি সরকারি হাসপাতালে আর ০.৪ টি বেসরকারি হাসপাতালে। ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট ও ভেন্টিলেটর তো আরোই আশঙ্কাজনক রকমের কম। ফলে সংক্রমণ অসংখ্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে তা মোকাবিলা করার মতো পরিকাঠামো একেবারেই নেই।
প্রশ্ন: করোনার অজুহাতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মজুতদারি বাড়ছে। ফলে মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে। সরকারের করনীয় কি?
উত্তর: কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ান ছয় মাসের চাল, ডাল মজুত করতে বলেছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিজে এ ধরনের কথা বললে কালোবাজারি, মজুতদারি উৎসাহিত হবে। আমাদের রাজ্যে ইতিমধ্যেই জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করেছে। সরকার যদি মজুতদারদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা না নেয় তাহলে সবচেয়ে দুর্ভোগে পড়বেন গরিব মানুষ। এমনিতেই তাঁরা পুষ্টিকর খাদ্য পান না। মূল্যবৃদ্ধি হলে তাঁদের অবস্থা আরও খারাপ হবে। মনে রাখা দরকার যে, ইউনিসেফ-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৮ সালে ভারতে প্রায় নয় লক্ষ শিশু পুষ্টির অভাবে মারা গেছে। করোনার কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়লে অনাহার-অর্ধাহারজনিত স্বাস্থ্য বিপর্যয় নেমে আসবে। সরকারের উচিত প্রত্যেক পরিবারকে সস্তা দামে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করার পরিকাঠামো গড়ে তোলা যা এখনও করা হয়নি। এটা করা গেলে মজুতদারি বন্ধ হবে।
প্রশ্ন: করোনা প্রতিরোধে সরকারের স্বাস্থ্য দফতরের করণীয় কী?
উত্তর: সরকারি হাসপাতালগুলিতে করোনা চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো প্রয়োজনের তুলনায় এখনও খুবই দুর্বল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। সংক্রমণ পরীক্ষার কেন্দ্র পর্যাপ্ত সংখ্যায় গড়ে তুলতে হবে। সম্ভবত এখনও পর্যন্ত আমাদের রাজ্যে মাত্র দুটি এরকম পরীক্ষাকেন্দ্র আছে। চিকিৎসক সহ সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে মাস্ক, সংক্রমণ নিরোধক পোশাক ইত্যাদি সরবরাহ করতে হবে। প্রতিটি আউটডোরে রুগীদের ভিড় থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর আশংকা থাকে। জ্বরের সাথে কাশি ও শ্বাসকষ্ট লক্ষণ নিয়ে আসা রোগীদের জন্য বিশেষ আউটডোর ও ইমারজেন্সির ব্যবস্থা করা খুব জরুরি। করোনা আক্রান্তদের আইসোলেশনে রাখার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক শয্যার ব্যবস্থা করতে হবে। স্পেনে সরকার সমস্ত প্রাইভেট হাসপাতালগুলিকে অধিগ্রহণ করে করোনা চিকিৎসার পরিকাঠামো বাড়িয়েছে। আমাদের দেশেও অবিলম্বে তা করা দরকার। কিন্তু তার কোনও উদ্যোগ দেখছি না। বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিং হোম, বেসরকারি পরীক্ষা কেন্দ্রগুলিকে করোনা নিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ দিলে তার ফল ভয়াবহ হতে পারে।
প্রশ্ন: গ্রামাঞ্চলে করোনার প্রকোপ ঠেকাতে কী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার?
উত্তর: এখনই জেলা, মহকুমা, ব্লক ও গ্রামীণ হাসপাতালগুলিতে করোনার চিকিৎসার পরিকাঠামো গড়ে তোলা দরকার। এটা করা হলে শহরের সরকারি হাসপাতালগুলির ওপর চাপও কমবে। এজন্য গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনা সংক্রমণ রোধের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ শুরু করা দরকার। সেই সঙ্গে জেলার বেসরকারি হাসপাতাল এবং নার্সিংহোমগুলিকে প্রয়োজনে সাময়িকভাবে অধিগ্রহণ করে সরকার করোনা চিকিৎসার পরিকাঠামো বাড়াতে পারে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই ২৫০-৩০০ টাকা দিয়ে মাস্ক কেনা সম্ভব নয়। তাই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আগেই গ্রামের মানুষকে বিনামূল্যে মাস্ক, সাবান প্রভৃতি দেওয়া জরুরি, বিশেষ করে সেই সব মানুষকে যারা কাজের প্রয়োজনে বাসে ট্রেনে নিয়মিত যাতায়াত করেন। রেল স্টেশন ও বাস স্ট্যান্ডে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ করার উদ্যোগ এখনই নেওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। যারা দৈনিক রোজগার করে সংসার চালান, তাঁদের আইসোলেশনে রাখতে হলে বিনা পয়সায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেবার ব্যবস্থাও সরকারকে করতে হবে। কানাডা সরকার এই কাজ শুরু করেছে। কিন্তু আমাদের দেশের সরকার এখনও পর্যন্ত গরিব মানুষকে সুরক্ষা দেবার ক্ষেত্রে উদাসীন।
প্রশ্নঃ বিশেষজ্ঞরা বলছেন করোনা সংক্রমণের ফলে দেশের বহু মানুষের রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এর কি প্রভাব পড়বে?
উত্তর: পরিবহণ-পর্যটন ও সংস্কতি বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে ২.৫ কোটি মানুষ কাজ হারাতে পারেন। সব চেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অসংগঠিত, পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ অনাহারের কবলে পড়বেন। এটা এখন আর কেবল আশঙ্কার বিষয় নয় বরং ভয়ংকর বাস্তবতা। এর ফলে অনাহারজনিত এপিডেমিক দেখা দেবে। যারা কাজ হারাবেন নতুন কাজ পাবার আগে তাঁদের জন্য বিশেষ ভাতা দেবার ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের যদি আইসোলেশনে পাঠাতে হয়, তবে তাঁদের পরিবারকে বিনামুল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস, বিদ্যুৎ, রান্নার গ্যাস প্রভৃতির ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে ছোটো মাঝারি শিল্পগুলিকে বাঁচাতে এখন থেকেই বিশেষ অর্থনৈতিক প্যাকেজ তৈরি করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জনতা কারফিউ এর কথা বলছেন। যাঁদের স্থায়ী মাস মাইনে নেই, যাঁদের প্রতিদিন রোজগারের জন্য বেরোতে হয়, বাড়ি বসে থাকলে তারা খাবেন কী? বিকল্প ব্যবস্থা না করে এরকম ঘোষণা একজন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে অসংবেদনশীলতার পরিচায়ক।
প্রশ্ন: এজন্য যে বিপুল পরিমাণে অর্থের প্রয়োজন তা সরকার কীভাবে জোগাড় করবে?
উত্তর: সরকারের চিরকেলে পদ্ধতিই হল বাজার থেকে বা বহুজাতিক ব্যাংক (বিশ্বব্যাংক, এডিবি প্রভৃতি) থেকে ঋণ নিয়ে অর্থের সমস্যা মেটানো। এর ফলে বিপুল পরিমাণে সুদ এবং অন্যান্য শর্ত সরকারের কাঁধে চাপে যা পরে জনগণের ওপর কর চাপিয়ে তোলা হয়। এর বিপরীতে সরকারের উচিত বড়ো কর্পোরেট সংস্থাগুলির থেকে করোনা-ট্যাক্স আদায় করা। ভারতের ধনীরা বিশ্বের সবচেয়ে ধনীদের তালিকায় জায়গা করে নিচ্ছে। তাঁদের ওপর করোনা কর চাপালে ব্যবসা মার খাওয়ার যুক্তি অজুহাত মাত্র। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো সরকারের শুভবুদ্ধির ভরসায় বসে না থেকে জনমত তৈরি করা ও চাপ সৃষ্টিকারী আন্দোলন গড়ে তোলা। বৃহত্তর আন্দোলন ছাড়া সরকারের কানে জল ঢুকবে না।