Home খবর ভারতে জমি নিয়ে চলতে থাকা ৭০৩টি লড়াইয়ের মধ্যে ২৫% আদিবাসী এলাকায়, দলিতদের বেশিরভাগই ভূমিহীন: রিপোর্ট

ভারতে জমি নিয়ে চলতে থাকা ৭০৩টি লড়াইয়ের মধ্যে ২৫% আদিবাসী এলাকায়, দলিতদের বেশিরভাগই ভূমিহীন: রিপোর্ট

ভারতে জমি নিয়ে চলতে থাকা ৭০৩টি লড়াইয়ের মধ্যে ২৫% আদিবাসী এলাকায়, দলিতদের বেশিরভাগই ভূমিহীন: রিপোর্ট
0

পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: ভারতের প্রতিটি জমি সংক্রান্ত বিবাদে ১০,৬০০ জন মানুষের জীবন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আর সেই লড়াই যদি খনি প্রকল্প সংক্রান্ত জমি নিয়ে হয়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ২১,৩০০। দিল্লির গবেষণা গোষ্ঠী ‘ল্যান্ড ওয়াচ কনফ্লিক্ট’ প্রকাশিত সাম্প্রতিক রিপোর্ট ‘লোকেটিং দ্য ব্রিচ’-এ এই তথ্য সামনে এসেছে।  

ওই রিপোর্ট বলছে, ৭০৩-টির মধ্যে ৩৩৫টি ক্ষেত্রে আটকে রয়েছে ১৩.৭ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ। যা মোটামুটি ভাবে ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের জিডিপি-র ৭.২ শতাংশ। ভারতে জমি নিয়ে সংঘাত কেন হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতেই তিন বছর ধরে গবেষণা চালিয়েছে ওই সংস্থা। এতে কোন কোন সামাজিক গোষ্ঠী কতটা ক্ষতিগ্রস্থ, বাণিজ্য ও অর্থনীতি কতটা ধাক্কা খাচ্ছে, তাও দেখা হয়েছে ওই গবেষণায়।

দেশজুড়ে মোট ২.১ লক্ষ হেক্টর জমি নিয়ে এই ধরনের সংঘাত চলছে। সংঘাতের মূলে রয়েছে মূলত ছটি বিষয়। পরিকাঠামো, শক্তি, বনাঞ্চল ও অরণ্য সংরক্ষণ, জমির ওপর অধিকার, খনি ও শিল্প। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমস্যা পরিকাঠামোর জন্য জমি অধিগ্রহণ নিয়ে। ১.৫৬ লক্ষ হেক্টর জমি নিয়ে ওই সমস্যা রয়েছে যা নাগাল্যান্ড রাজ্যের আয়তনের সমতূল্য।   

মোট সংঘাতের ঘটনার ৪৩ শতাংশ পরিকাঠামো সংক্রান্ত জমি অধিগ্রহণ নিয়ে, ৬ শতাংশ খনিপ্রকল্প নিয়ে, বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ ও ক্ষতিপূরণের জন্য অরণ্যায়ন ও বাগান তৈরির জন্য জমি নিয়ে সংঘাত ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে।

৭০৩টি জমি সংক্রান্ত সংঘাতের ঘটনার প্রভাব পড়ছে ৬৫ লক্ষ মানুষের জীবনজীবিকার ওপর। এর মধ্যে পরিকাঠামোর জন্য সমস্যায় পড়ছেন ৩০ লক্ষ মানুষ, খনি প্রকল্পের জেরে জেরবার সাড়ে আট লক্ষেরও বেশি মানুষ। জমি ঘিরে সংঘাতের জেরে যে ১৩.৭ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে রয়েছে, তার মধ্যে ৭ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি পরিকাঠামো ক্ষেত্রে। শক্তি এবং শিল্প সংক্রান্ত ক্ষেত্রে সংখ্যাটা যথাক্রমে ২.৮ ও ২.৭ লক্ষ কোটি।

৭০৩টির মধ্যে ৬৬৭টি ক্ষেত্রে অর্থাৎ ৯৫ শতাংশেরও বেশিতে সরকার কোনো না কোনো ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ২৭ শতাংশ ক্ষেত্রে সংঘাতের এক পক্ষে রয়েছে বেসরকারি সংস্থা। ২৩ শতাংশ ক্ষেত্রে সংঘাত বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে। রিপোর্ট বলছে, ভারতে জমির অধিকার এবং জমিতে উৎপন্ন দ্রব্যের বণ্টন সংক্রান্ত পুরনো আইন রয়েছে, কিন্তু তাতে এই সংঘাতগুলো ঠেকানো যাচ্ছে না। ফলে বহু মানুষের মানবাধিকার খর্ব হচ্ছে।

দেশের ৭০৩টি জমি নিয়ে সংঘাতদীর্ণ এলাকা, সূত্র: ল্যান্ড ওয়াচ কনফ্লিক্ট

সংঘাতের ধরন

সংঘাতের মূল কারণ লুকিয়ে আছে জমির মালিকানার মধ্যে। যে সব জমি নিয়ে সংঘাত, তার অনেকগুলিরই ব্যক্তি মালিকানা নেই। গ্রাম, সম্প্রদায়, পুরসভা, নির্বাচিত সংস্থা এবং/অথবা সরকারের হাতে আছে। সেগুলি বহু মানুষ ব্যবহার করে থাকেন। অন্যদিকে সরকারি খাতায় বহু জমিকে ‘পতিত’ হিসেবে চিহ্নিত করা থাকলেও, প্রান্তিক মানুষ বহুদিন ধরে সেগুলি ব্যবহার করে আসছেন। এই সব জমিগুলি অধিগ্রহণ করতে গেলে সংঘাত তৈরি হচ্ছে। যে সব জমি নিয়ে সংঘাত চলছে, তার ৩৬ শতাংশ সাধারণ মালিকানাধীন, ২৯ শতাংশ ব্যক্তি মালিকানাধীন, বাকি জমি ব্যক্তি ও সাধারহণ মালিকানাভুক্ত।

সংবিধানের পঞ্চম তফসিলের অধীনে রয়েছে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলি। দেশের ১০টি রাজ্যের ১০০টি জেলায় এই ধরনের অঞ্চল রয়েছে। ১৮২টি জমি নিয়ে সংঘাত চলছে এই অঞ্চলে, যা মোট সংঘাতের ২৫ শতাংশ। এর বেশিরভাগই খনি প্রকল্প নিয়ে। খনি প্রকল্প নিয়ে মোটা গোলমালের ৬০ শতাংশই এই অঞ্চলে।

অরণ্যভূমি নিয়ে সংঘাত চলছে ২৭২টি। তার মধ্যে ১৩১টি সংঘাতের মূলে রয়েছে ২০০৬ সালের অরণ্যের অধিকার আইন প্রয়োগ না করা বা অমান্য করা। এর ফলে সমস্যায় পড়েছেন ১২ লক্ষ মানুষ। জমির পরিমাণ ৩,৬৮, ১৩৮ হেক্টর।

রাষ্ট্রের ব্যর্থতা

১৯৯০ সালের পর শিল্পপতিদের জমি দেওয়ার জন্য সরকারগুলি বিভিন্ন রাজ্যে জমি ব্যাঙ্ক তৈরি করা শুরু করে। তারা যাতে সহজেই জমি পায়, তার জন্য বিভিন্ন অব্যবহৃত জমিগুলিকে সরকার চিহ্নিত করে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের জমি বেছে দেওয়ার সুবিধা হলেও জনগণের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। পরে যখন জনগণের সঙ্গে সংঘাতের ফলে সেই সব প্রকল্প বাতিল বা স্থগিত হয়ে যায়, তখন সেই জমিগুলি সরকারের হাতে চলে আসে। কিন্তু জনগণের ব্যবহারযোগ্যও থাকে না। তাদের জীবনজীবিকার সমস্যা তীব্র হয়।

এইসব জমিগুলির মালিকানার বিষয়গুলি পরিষ্কার ছিল না বলেই সেগুলিকে জমি ব্যাঙ্কে যুক্ত করা হয়েছিল, অন্যদিকে মালিকানার বিষয়টি পরিষ্কার ছিল না বলেই সেই জমির ওপর নির্ভরশীল জনগণও ওই জমির ওপর নিজেদের অধিকার দাবি করতে পারেননি। সাধারণ মালিকানাধীন এইসব জমিগুলির মধ্যে অধিকাংশই অরণ্যের অধিকার আইনের সঙ্গে জড়িত। ওই আইন এবং জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন সংক্রান্ত আইন ঠিকমতো প্রয়োগ না হওয়ার জন্যই এই সমস্যা তৈরি হচ্ছে। জনগণ তো সমস্যায় পড়ছেনই, বিনিয়োগকারীদের বহু অর্থও আটকে থাকছে।

অনেক পিছিয়ে দলিতরা  

রিপোর্ট বলছে তফসিলি জাতি বা দলিতরা এখনও ভারতের সবচেয়ে বড়ো ভূমিহীন সম্প্রদায়। এক্ষেত্রে সাধারণ ক্যাটেগরি, অন্যান্য পিছিয়ে থাকা অংশ এবং তফসিলি উপজাতিরাও তাদের থেকে ভালো অবস্থায় আছেন। রিপোর্ট অনুযায়ী ৬০ শতাংশ দলিত পরিবারের হাতে চাষযোগ্য জমি নেই।

এই তথ্যের তাৎপর্য গভীর। কারণ ভারতের জাতিবর্ণ ব্যবস্থায় প্রাচীন কাল থেকে দলিতদের অষ্পৃশ্য করে রাখা হয়েছে, তাদের জমির অধিকার দেওয়া হয়নি। সেই অবস্থাটা এখনও চলছে।

স্বাধীনতার পর থেকে বহু আইন বানিয়ে ভূমি সংস্কার ইত্যাদি করা হলেও তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দলিতরা এখনও সম্পত্তির অধিকার থেকে দূরেই রয়েছেন। জমি সংক্রান্ত সংঘাতের ৩১টি ক্ষেত্রে ৯২,০০০ দলিত ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। ১৩টি রাজ্যে ছড়িয়ে রয়েছেন তাঁরা। মোট জমির পরিমাণ ৩৯, ৪০০ হেক্টর।যা চেন্নাই শহরের আয়তনের সমান। ১৩টি রাজ্যের মধ্যে রয়েছে, পঞ্জাব, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কেরল, বিহার। এই রাজ্যগুলি উন্নয়নের নানা মাপকাঠিতে বিভিন্ন স্তরে থাকলেও দলিতদের ক্ষমতায়ন এবং তাদের জন্য ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে একইরকম পিছিয়ে।  

এই তথ্য থেকেই পরিস্কার, ভারত রাষ্ট্রের আধা সামন্ততান্ত্রিক চরিত্রেই লুকিয়ে রয়েছে দলিতদের দূরবস্থার কারণ। আমূল ভূমি সংস্কার ছাড়া তা পুরোদস্তুর পালটানো অসম্ভব। আম্বেদকরের মতো দলিত নেতার সংবিধান রচনা, একগাদা দলিতদের পার্টি, রঙবেরঙের বাজার গরম করা দলিত নেতানেত্রী, জাতপাত বিরোধী আত্মপরিচয়ের দলিত আন্দোলন ছোটো একটা মধ্যবিত্ত দলিত সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি ছাড়া বেশি কিছু করতে পারেনি। শুধু সংরক্ষণের আন্দোলন নয়, শ্রমের ভিত্তিতে জমি বণ্টনের শ্রেণি রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া দলিতদের অবস্থা পালটানোর কোনো সম্ভাবনা নেই।  

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *