এনআরসি-এনপিআর-সিএএ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন রাজ্য সহ দেশ জুড়ে এক অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছে। যারা রাজনীতি থেকে শত হাত দূরে থাকতেন তাঁরাও আজ রাস্তায় নেমেছেন। বিশেষ করে মুসলিম মহিলারা মুসলিম সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতির বেড়াজাল ভেঙে চার দেওয়ালের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন। যা এই আন্দোলনের সব থেকে বড় পাওয়া। এটা যেমন এই আন্দোলনের একটা দিক তেমনি আর একটা দিক হল এই ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণ প্রতিরোধ যাতে এই পচা গলা রাষ্ট্র ব্যবস্থা বদলের বিপ্লবী লড়াইয়ের সাথে কোনো ভাবেই যুক্ত না হয়ে যায় তার জন্য শাসক দলগুলোর তৎপরতা। সংবিধানকে সামনে রেখে এই তৎপরতা শুরু হয়েছে। উদেশ্য একটাই মেহনতি জনতার প্রতিরোধ সাংবিধানিক গন্ডির মধ্যে বেঁধে রাখা, স্থিতাবস্থাকে বহাল রাখা। এনআরসি-এনপিআর-সিএএ বিরোধী গণ আন্দোলন যখনই মারমুখী হয়ে উঠল ঠিক তখনই তাকে সামাল দিতে স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট কংগ্রেস থেকে সামাজিক ফ্যাসিস্ট সিপিএম আসরে নেমে পড়ল। এনআরসি-র প্রথম ধাপ যে এনপিআর, এই নিয়ে এত দিন এরা মুখে কুলুপ এঁটেই ছিল। আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নাকি জানতেনই না এনপিআর সম্বন্ধে। তিনি এত দিন ভাবতেন এনপিআর হচ্ছে জনগণনা। কাগজহীন মেহনতি জনতার প্রতিরোধ তাঁর জ্ঞানচক্ষু খুলে দিল। শুধু তাঁর নয় শাসক শ্রেণিরই জ্ঞানচক্ষুর উন্মেষ হল। মেহনতি জনতার সামনে সংবিধানকে হাজির করা হল। তাই সংবিধান নিয়ে মিছিল, মিছিলে সংবিধান পাঠ, ডিফেন্ড কনস্টি টিউশন। প্রতিরোধী জনতাকে ঘরে ঢোকানোর বহু পুরনো কৌশল শাসক শ্রেণি নতুন মোড়কে সামনে হাজির করেছে। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রশ্ন আসে যে আমাদের দেশের সংবিধান সত্যি কি মেহনতি শ্রেণির গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার হাতিয়ার? ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ফ্যাসিস্ট বিজেপির এনআরসি-এনপিআর-সিএএ কি দেশের সংবিধান বিরোধী পদক্ষেপ? এ প্রসঙ্গে পরিষ্কার বলা যেতে পারে বিজেপির এনআরসি-এনপিআর-সিএএ সংবিধান বিরোধী পদক্ষেপ নয়। যে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে গুজরাটের গণহত্যাকারী দাঙ্গাবাজ মোদি-শাহ প্রধানমন্ত্রী- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়, সেই সাংবিধানিক পদ্ধতিতেই এনআরসি-এনপিআর-সিএএ লাগু করেছে বিজেপি। স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট ইন্দিরা-সিদ্ধার্থশংকর, সামাজিক ফ্যাসিস্ট জ্যোতি-বুদ্ধ, ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ফ্যাসিস্ট বাজপেয়ী-আদবানী মোদি -শাহ সবাই এই সংবিধানেরই বাই প্রোডাক্ট।
ভারতের সংবিধান যে সংবিধান সভা রচনা করেছিল সেই সংবিধান সভাটি ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশন এবং ভারতের ভাইসরয়-এর ১৬ মে ১৯৪৬-এর একটি বিবৃতির উপর ভিত্তি করে গঠিত হয়েছিল। সংবিধান সভার সদস্যরা এসেছিলেন ১৯৩৫-এর গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া আইন অনুসারে ‘ব্রিটিশ ভারত’-এর প্রাদেশিক বিধানসভাগুলো থেকে, যারা ভারতের জনগণের ১১.৫ অংশের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে এসেছিলেন। দেশের এই ১১.৫ শতাংশ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা সৃষ্ট তাদের দালাল ধনিক শ্রেণি ও জোতদার- জমিদার। সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের এই মিত্র শ্রেণির স্বার্থেরই প্রতিফলন ঘটেছে দেশের সংবিধানে। তাই এই সংবিধানে নেই জনতার কর্মসংস্থানের অধিকার, নেই মেহনতি জনতার চিকিৎসার অধিকার, কোথাও রক্ষিত হয়নি গরিব মানুষের ভর্তুকি পাবার অধিকার। এই সংবিধানে রক্ষিত হয় সর্বগ্রাসী দেশি বিদেশি কর্পোরেট মুনাফা শিকারি-খনিজ সম্পদ লুটেরা গোষ্ঠীর অধিকার।ভারতের সংবিধান বৃহৎ ফাটকাবাজ এবং তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি ভোটবাজ দলগুলোর গণতন্ত্রই সুনিশ্চিত করে।
তাই এনআরসি-এনপিআর-সিএএ বিরোধী গণআন্দোলনকে ডিফেন্ড কনস্টিটিউশন আন্দোলনে পরিণত করা আদ্যোপান্ত শাসকশ্রেণির ষড়যন্ত্র, কাগজহীন মেহনতি জনতার বিদ্রোহকে শাসকশ্রেণির পক্ষে নিরাপদ খাতে বইয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ফ্যাসিবাদ কে পরাজিত করার জন্য যে সব বুদ্ধিজীবী সংবিধান হাতে সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতি বহনকারী গান গাইতে গাইতে রাস্তায় নেমেছেন হয় তাঁরা শাসক শ্রেণির ষড়যন্ত্রের শিকার নতুবা এই ষড়যন্ত্রের অংশ। সৃজনশীলতার নাম করে আমরা যদি সংস্কারবাদ,সামন্ততান্ত্রিক পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরি, তার সাথে আপস করি তাহলে শুরুতেই সংগ্রাম মুখ থুবড়ে পড়বে। নাগরিকত্বের সাথে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক, সামাজিক, শিক্ষাগত ও বিনোদন সব ক্ষেত্রের গণতন্ত্রিকরণের লড়াই ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।আর এই নয়া-গণতন্ত্রিকরণের লড়াইয়ের গতিশীলতার সাথে ভারতের সংবিধান বেমানান শুধু নয় বিরোধীও। আশা রাখবো ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করার সদিচ্ছাসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীরা নিশ্চয়ই সেটা বুঝবেন- লড়াইয়ের ময়দানে থেকেই বুঝবেন।