Home সংস্কৃতি বাংলা টিভি সিরিয়ালের সংস্কৃতি: একটি শ্রেণি বিশ্লেষণ

বাংলা টিভি সিরিয়ালের সংস্কৃতি: একটি শ্রেণি বিশ্লেষণ

বাংলা টিভি সিরিয়ালের সংস্কৃতি: একটি শ্রেণি বিশ্লেষণ
0
অয়ন ব্যানার্জি

যে কোনো সমাজে উৎপাদন হছে মানুষের বেঁচে থাকার সবচেয়ে মৌলিক শর্ত। কোনো সমাজেই উৎপাদন বিমূর্ত ভাবে হয় না। যেকোনো সমাজেই উৎপাদন চলে মানুষে মানুষে একটা নির্দিষ্ট সম্পর্কের ভিত্তিতে। সে সম্পর্ক হতে পারে শোষণহীন বা শোষণভিত্তিক। কোনো একটি সমাজের উৎপাদন সম্পর্কই হল সেই সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো বা ভিত্তি, যার উপর দাঁড়িয়ে সেই সমাজের উৎপাদনের  কাজকর্ম চলে। আর এই ভিত্তির উপর গড়ে ওঠে সেই সমাজের উপরিকাঠামো তথা আইন-কানুন, শিল্প- সাহিত্য, দর্শন সংস্কৃতি সমস্ত কিছু। সাধারণ ভাবে কাঠামো এবং উপরিকাঠামোর মধ্যে কাঠামোই উপরিকাঠামো কে নির্ধারণ করে।

আমাদের দেশের উৎপাদন সম্পর্ক শোষণভিত্তিক। এই শোষণভিত্তিক  অর্থনৈতিক কাঠামোর চরিত্র হল আধা সামন্ত্রতান্ত্রিক আধা ঔপনিবেশিক। আর এই অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে গড়ে উঠেছে আমাদের দেশের উপরিকাঠামো, আইন- কানুন, শিল্প-সাহিত্য, দর্শন সমস্ত কিছু। এই উপরিকাঠামোর একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল চলচ্চিত্র শিল্প(সিনেমা- সিরিয়াল- ওয়েব) এই শিল্প একটি উন্নততর মাধ্যম। খুব সহজেই এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে পৌছানো যায়। তাই বর্তমানে এই মাধ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। চলচ্চিত্র ও রাজনীতি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যে শ্রেণি থাকে সেই শ্রেণি তার মতাদর্শকে খুব সহজেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে এই মাধ্যমের ভিতর দিয়ে। চলচ্চিত্র শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল সিরিয়াল ইনড্রাস্টি। আমার এখানে মূলত বাংলা সিরিয়ালে আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির জোরালো উপস্থিতি নিয়ে কথা বললেও সমগ্র ভারতের চলচ্চিত্র শিল্প সম্পর্কে এই মতামত খাটে বলে মনে করি।

 একটা বিশেষ সংস্কৃতি হচ্ছে সেই সমাজের অর্থনীতি ও রাজনীতির ভাবাদর্শগত প্রতিফলন।  বাংলা তথা ভারতের শিল্প সাংস্কৃতিক জগতে(যার অন্তর্গত চলচ্চিত্র শিল্প) আধা সামন্ত্রতান্ত্রিক আধা ঔপনিবেশিক অর্থনীতি রাজনীতির ভাবাদর্শগত প্রতিফলন তাই আমরা জোরালো ভাবেই টের পাই। যেমন প্রতিটি সিরিয়ালে আমরা পাই অতি প্ৰাকৃতিক শক্তির মাহাত্ম্য প্রদর্শন, জন্মান্তরবাদ, জ্যোতিষচর্চা, দিব্য চক্ষুর মাধ্যমে অতীত- ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়া প্রভৃতি অবৈজ্ঞানিক কুসংস্কারমূলক গল্প যা আদ্যোপান্ত সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতিরই ছাপ। আর যারা এইগুলো পালন করছে তারা কম বেশি প্রত্যেকেই ‘আধুনিক’ শিক্ষায় শিক্ষিত, আধুনিক ফোন,গাড়ি বাড়ি ব্যবহারকারী মানুষ। আর কী পাই? আর পাই সিরিয়ালের কেন্দ্রীয় চরিত্রে আদর্শ এক নারীকে। সেই নারী ব্রাহ্মণ্যবাদী সামন্ততান্ত্রিক পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির সমস্ত চিহ্ন যথা শাখা সিঁদুর ইত্যাদি শুধু নিজের শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে না তার মাহাত্ম্যও প্রচার করছে। তাকেই আদর্শ নারী হিসাবে সামনে আনা হচ্ছে যে স্বামীর সেবার জন্য বিভিন্ন ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কার যথা বিভিন্ন পূজো – আচার নিষ্ঠা ভরে পালন করছে। এমন কোনো নারী চরিত্র আমরা দেখতে পাই না যার কার্যকলাপ হবে পুরানো আত্মমর্যাদাহীন ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক যাবতীয় আচার ব্যবহারের বিরুদ্ধে যে রুখে দাঁড়াচ্ছে।  বিবাহ সম্পর্ক দেখাতে গিয়ে রেজিস্ট্রি যেমন আছে ( যা মূলত এক সিনে শেষ হয়ে যায়), তেমনি আছে জাতি- বর্ণের ভিত্তিতে নির্ধারিত ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক আচার- অনুষ্ঠান যথা সম্প্রদান- সিঁদুর প্রদান ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে ‘বিবাহ পর্ব'( যা কয়েকটা এপিসোড জুড়ে থাকছে)। একেই বলে আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির সহবাস। সাম্রাজ্যবাদ ও তার সেবায় নিয়োজিত আমাদের দেশের দালাল শাসক শ্রেণি খুব সচেতন ভাবে এই সংস্কৃতিকে মেহনতি জনতার মধ্যে টিকিয়ে রেখে তাদেরকে বাস্তববিমুখ করে রাখতে চায়। যার ফলে মেহনতি মানুষ বেশি বেশি করে ভাগ্য-দৈবশক্তি ইত্যাদির মধ্যে তার সমস্যার সমাধানের পথ খোঁজে। ভারতের পরজীবী শাসকরা সাম্রাজ্যবাদী শোষণ টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এই সিরিয়ালগুলোর ভিতর দিয়ে এক ধরনের দাস সুলভ মূল্যবোধ মেহনতি জনতার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাইছে। তাই আজ সময়ের দাবি এই আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির শেকড় উপরে ফেলে এক নয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পথ উন্মুক্ত করা। আশার বিষয় এই যে আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলমান মেহনতি জনতার সংগ্রাম ভ্রূণ আকারে হলেও এক নতুন ধরনের সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে। 

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *