সস্তা শ্রমের জন্য দুনিয়া জুড়ে ডিটেনশন ক্যাম্প চালাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ, এবার লক্ষ্য ভারতের শ্রমজীবীরা
সৌম্য মণ্ডল
এনআরসি প্রক্রিয়ার সমর্থনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ বারবার অবৈধ অভিবাসন বা অনুপ্রবেশজনিত জন বিস্ফোরণের সমস্যার কথা বলেছেন। এই কথা বলতে গিয়ে অভিবাসন সমস্যার আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত তিনি টেনে এনে বিরোধীদের দিকে প্রশ্ন ছুড়েছেন যে এমন কোন দেশ আছে যারা অনুপ্রবেশ সমস্যা নিয়ে ব্যবস্থা নেয় না!
এনআরসি বা ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী/ অভিবাসী’ নিয়ে আলোচনা হলে ডিটেনশন ক্যাম্পের কথাও সাথে সাথে এসে পরে। বিশেষত ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে যখন বার বার সরকারি ভাবে জানানো হয় যে এনআরসি একান্ত ভাবেই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়, তখন স্পষ্ট হয়ে যায় যে এনআরসি ছুট অবৈধ অনুপ্রবেশকারী তকমা পাওয়া মানুষদের ঠাঁই হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। অমিত শাহের দেখানো পথেই আমরা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ভারতের অনুপ্রবেশ ও ডিটেনশন ক্যাম্প ব্যবস্থাকে বোঝার চেষ্টা করবো।
‘গ্লোবাল ডিটেনশন প্রজেক্ট’ জানাচ্ছে ২০১০-এর পর ২০১৬ সালে সব চেয়ে বেশি অভিবাসী আটক করা হয়েছে। ইউকে-তে ২০০০ সাল থেকে আশ্রয়ের জন্য আবেদনের সংখ্যা কমার সত্ত্বেও ডিটেনশনে বন্দি রাখার সংখ্যা বেড়েছে। ১৯৯৩ সালে যা ছিলো ২৫০ জন, ২০১৭ তে সংখ্যাটা ৪ হাজারের মত দাড়িয়েছে। একই প্রবণতা দেখা যায় আমেরিকার ক্ষেত্রেও। ২০১৪ সালে বিবিসি একটি ডকুমেন্টারিতে জানিয়েছে আগের ৫ বছর ধরে ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক হওয়া মানুষের সংখ্যা বছরে দ্বিগুন হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে এই সময়পর্বে আশ্রয় পাওয়ার জন্য সীমান্তে আবেদন জমা পরা ৫০% হ্রাস হয়েছে।
২০১৫ সালের ব্রাসেলস থেকে প্রকাশিত কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার যৌথ বিবৃতিতে দেখা যাচ্ছে ওই বছর ইউরোপে আগত ৭ লক্ষের কাছাকাছি অভিবাসীদের মধ্যে ৮৩% মানুষ এসেছেন সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, এরিট্রিয়া এবং প্যালেস্তাইন থেকে যুদ্ধ এবং নিপীড়নের কারণে। এছাড়াও আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ বা দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসীরা আমেরিকা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যায়। এই বিশাল অভিবাসনের বেশিরভাগটারই কারণ আমেরিকা বা ইউরোপীয় সুপার পাওয়ার দেশগুলো সরাসরি উড়ে গিয়ে নিয়মিত বোমা বর্ষণ করে বা আঞ্চলিক এজেন্টদের দিয়ে ছায়া যুদ্ধ চালিয়ে ওই সব দেশের প্রকৃতিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চেয়েছে। অস্ত্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষা অথবা নিদারুণ অর্থনৈতিক শোষনের মাধ্যমে দেশ গুলোর অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে।
ইউকে-তে ২০১৪ সালে অভিবাসী ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে ৪,৯৫,০০০ ঘন্টা শ্রম নেওয়া হয়েছিলো, ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাড়ায় ৯,২৩,০০০ ঘন্টা। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যেই ৫,৩৭,০০০ ঘন্টা শ্রম নেওয়া হয়ে গেছিল।
২০১৬ সালে তথ্যের স্বাধীনতা আইনে আবেদনের ভিত্তিতে জানা গেছে যে ডিটেনশন ক্যাম্পের বন্দিরা যে ঘন্টায় ১ পাউন্ড বা তার কিছু বেশি মজুরি পান তা হলো দেশে প্রচলিত ন্যূনতম মজুরির ১৩% এর কাছাকাছি মাত্র।
২০০৭ থেকে ১৩ সালের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার সমগ্র অভ্যন্তরীণ বাজেটের ৬০% খরচ করেছে অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণে। এই মূহূর্তে সবচেয়ে বেশি ডিটেনশন ক্যাম্প আছে যুক্ত রাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় যার বেশিরভাগই চালায় বেসরকারি সংস্থা। এই সংস্থাগুলো হল কারেকশন কর্পোরেশন অফ আমেরিকা (CAA) Geo Group, G4S, ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং কর্পোরেশন ইত্যাদি।
পূর্ব হিসাব অনুযায়ী ২০১৩ সালে ইউকেতে G4S ১২২ মিলিয়ন পাউন্ড মুনাফা করেছে। অন্যদিকে ২০১৪ সালে Mitie ১২৭.৫. মিলিয়ন পাউন্ড, Geo group ১৮৪ মিলিয়ন পাউন্ড মুনাফা করেছে। (guardian)
জেল বন্দিদের দাস শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগানোর প্রথা আমেরিকায় অনেক পুরনো, সম্প্রতি জেল বন্দিদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আল জাজিরার প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে ‘ম্যাক ডোনাল্ড’ ‘ওয়ালমার্ট’ এর মতো সংস্থা বা কল সেন্টারগুলো নামমাত্র মজুরিতে বন্দিদের সস্তা শ্রম হিসেবে ব্যবহার করে। এবার অবৈধ অভিবাসনের অজুহাত বন্দিদের সস্তা শ্রম ব্যবহারে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ২০১৯ সালের ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে আমেরিকায় ৪৮,০০০ জনের বেশি অনুপ্রবেশকারী ২০০ টি ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক রয়েছেন। ন্যাশনাল ইমিগ্রান্ট জাস্টিস জানিয়েছে ফেডারেল সরকার অন্তত দুই তৃতীয়াংশ ডিটেনশন সেন্টার চালাবার দায়িত্ব দিয়েছে বেসরকারি কোম্পানিদেরকে।
আমেরিকায় বেসরকারি কর্পোরেশনগুলোর হেফাজতে মোট অনুপ্রবেশকারীর ৭০% আছে। ২০১৬ সালে জর্জিয়ার Stewar ডিটেনশন সেন্টার থেকে CoreCivic রাজস্ব কামিয়েছে ৩৮ মিলিয়ন ডলার। ২০১৭ তে ICE-এর সাথে চুক্তি অনুযায়ী ১.৭৬ বিলিয়ন ডলারের ২৫% রাজস্ব তারা পাবে। অন্যদিকে Geo group ICE-র সাথে চুক্তি অনুযায়ী ২.২৬ বিলিয়ন ডলারের ১৯% রাজস্ব পাবে।
এই ডিটেনশন ক্যাম্পগুলোতে দিনে ১ডলার মজুরিতে কাজ করানো হয় যা আমেরিকার দৈনিক নুন্যতম মজুরির ধারে কাছে আসে না। কিন্তু এই ক্যাম্পগুলোতেই আবার বন্দিদের থেকে মাত্রতিরিক্ত দাম নেওয়া হয়। যেমন ১৫ মিনিটের একটি ফোন কলের জন্য ১২.৭৫ ডলার বা চার আউন্স টুথপেষ্টের দাম নেওয়া হয় ১১ ডলার।
মার্কিন সংসদের নীতি নিজেদের পক্ষে আনার জন্য বৃহৎ ব্যবসাদাররা প্রকাশ্যেই দালাল বা লবিইস্ট নিয়োগ করে লবি তৈরি করে সংসদে প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করার জন্য। এটাই মহান মার্কিন গণতন্ত্রের চিত্র। ২০১৬ থেকে ১৮ সালের মধ্যে CoreCivic ২.১৮ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে লবি করার জন্য এবং ৭ লক্ষ ডলার ট্রাম্পের প্রচারে চাঁদা দিয়েছে। এই সময় Geo Group 4.4 মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে লবিং এর জন্য এবং ২.৫ মিলিয়ন ডলার খরচা করেছে ট্রাম্পের প্রচারে। এই কম্পানি দুটো প্রত্যেকে ট্রাম্প সরকারের সূচনার অনুষ্ঠানে ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার করে দান করেছিলো।
দেখা যাচ্ছে আমেরিকা বা ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো এক দিকে এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে বোমা মেরে বা অর্থনৈতিক শোষণের মধ্যে দিয়ে ধ্বংস করে সেখানকার অধিবাসীদের অভিবাসী হতে বাধ্য করছে, তার পর নিজেদের দেশে এই অভিবাসীদের অবৈধ আখ্যা দিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পের ব্যবসা ফেদে বসে আরো মুনাফা কামাচ্ছে। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে সারা পৃথিবীতেই ডিটেনশন ক্যাম্প এবং ডিটেনশন ক্যাম্পের সস্তা শ্রম একটি লোভনীয় ক্ষেত্র হিসেবে উঠে আসছে এবং বিস্তার লাভ করছে। ২০১৯ সালে গ্লোবাল ডিটেনশন প্রজেক্টের হিসাব অনুযায়ী গোটা দুনিয়াতে ১৯৩৫ টি অভিবাসী ডিটেনশন সেন্টার আছে। যার বেশিরভাগই উত্তর গোলার্ধের উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে অবস্থিত। যদিও দক্ষিণ গোলার্ধেও বিভিন্ন বাহানায় ডিটেনশন ক্যাম্পের সংখ্যা বাড়ছে।
এর আগে ছত্তীসগঢ়ে ২০০৫ থেকে শুরু ‘সালভা জুডুম’ অভিযানে আদিবাসী জনগণের থেকে মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টিকে বিচ্ছিন্ন করার নামে গোটা গ্রামকে ধরে নিয়ে গিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে পুরে বেগার শ্রম নিংড়ে নেওয়া হয়েছে। এনআরসি হয়ে গেলে ডিটেনশেন ক্যাম্পের সংখ্যায় ভারত এবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে বলে আমরা আশা করতে পারি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো তার সীমানার কাছাকাছি লিবিয়ার মতো দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোতে ইউরোপে আসতে উৎসাহী অভিবাসীদের আটক করে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখার জন্য অর্থ সহ বিভিন্ন রকম সাহায্য করে থাকে। কারণ ইউরোপের থেকে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোতে বন্দিদের রাখার খরচ কম এবং মানবাধিকার কর্মীদের হইচই সহ বিভিন্ন আইনি জটিলতার সমস্যা কম।
২০ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা এক্সক্লুসিভ প্রতিবেদনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফাঁস হওয়া ১৩ পাতার একটি অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট ঘেঁটে দেখিয়েছে কী ভাবে অনুপ্রবেশ এবং ডিটেনশন ক্যাম্প লিবিয়া সরকারের একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এই রিপোর্ট থেকে ফাঁস হয়েছে লিবিয়ার ডিটেনশন ক্যাম্পগুলোতে কী ভাবে হত্যা, ধর্ষণ, বেগার শ্রম,মানব পাচার এমনকি বন্দিরা দাস বাজারে বিক্রি হয়ে চলেছে।
১৫ এপ্রিল ২০১৯-এর দ্য গার্ডিয়ানের আরেকটি রিপোর্টে উল্লিখিত ডিটেনশন ক্যাম্পের বন্দিদের জবানবন্দিতে দেখা যাচ্ছে যে বন্দিদের আবাসন নির্মাণ বা চাষের জমিতে বেগার শ্রম দিতে হয়। এমনকি যুদ্ধের সব রকম প্রয়োজনে বন্দিদের বেগার শ্রম দিতে হয়। বন্দিরা জানিয়েছে এই বেগার শ্রমের ফলে অন্তত ডিটেনশন ক্যাম্পের ঘিঞ্জি এবং চুড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে বেড়িয়ে সূর্যের আলো, বাতাস পাওয়ার সুযোগ পায় বন্দিরা। কাজে না গেলে বা ফাঁকি দিলে চলে অত্যাচার, কোনো বন্দি পালাতে গিয়ে ধরা পড়লে তাকে হত্যা পর্যন্ত করা হয়।
কিন্তু যে সমস্ত দেশগুলোতে পালে পালে অভিবাসী ভিড় করছে না, তারা ডিটেনশন ক্যাম্পের সস্তা শ্রম আহরণের জন্য বিচিত্র পদ্ধতি আবিষ্কার করছে।
ভিয়েতনাম দুনিয়াতে প্রধান কাজু বাদাম রফতানিকারক দেশ। মুলত এই কাজু বাদাম বাণিজ্য আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে হয়ে থাকে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই বাদাম বাণিজ্যের পিছনে নির্মম শোষণের চিত্র। কুই ফং নামে একজন তার জবানবন্দিতে জানিয়েছে যে তিনি হেরোইন আসক্ত হওয়ায় পরিবার তাকে এক বছরের জন্য নেশা মুক্তি কেন্দ্রে পাঠায়। কিন্তু পাঁচ বছর তাকে জোর করে খাটতে বাধ্য করার পর মুক্তি দেওয়া হয়। এই সময় মজুরি দেওয়া হলেও তা জাতীয় ন্যুনতম মজুরির ভগ্নাংশ মাত্র। কুই ফং-এর বয়ান অনুযায়ী তিনি শেষের দিকে প্রতি মাসে যে পারিশ্রমিক পেতেন তা মাত্র ৩ মার্কিন ডলারের সমান। প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ড্রাগ ডিটেনশানে বন্দি একজনও নেশা ছাড়াবার জন্য কোনো বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি বা কাউন্সিলিং-এর কথা উল্লেখ করেনি শুধু মাত্র সকাল বেলায় শরীরচর্চার সময় ‘সু-স্বাস্থ্য, সু-স্বাস্থ্য’ বলে চিৎকার করে স্লোগান দেওয়া ছাড়া।
শুধু কাজু বাদাম উৎপাদন নয় আলু চাষ, নির্মাণ শিল্প, বস্ত্র শিল্প, বিভিন্ন ধরনের ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে ড্রাগ ডিটেনশন ক্যাম্পের বন্দিদের অতি সস্তা শ্রম নিংড়ে নেয় বেসরকারি বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো। এই নেশা মুক্তি কেন্দ্রগুলোতে স্বেচ্ছায় ঢুকলেও স্বেচ্ছায় বেরনোর উপায় নেই। নেশাগ্রস্তদের দিয়ে জোর করে খাটিয়ে নেওয়ার কেন্দ্রের সংখ্যা গত দশকে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। গোটা ভিয়েতনামে ২০০০ সালে ৫৬ টি নেশাগ্রস্তদের জন্য ডিটেনশন সেন্টার ছিলো, ২০১১ সালের মধ্যে তা বেড়ে দাড়ায় ১২৩টি। ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ৩ লাখ ৯ হাজারের বেশি মানুষ এই সব ডিটেনশন সেন্টারে ভর্তি হয়েছে। ২০০০ সালের শুরুতে একজন নেশাগ্রস্তকে ৩ মাস থেকে ১ বছর অবধি ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হত। ২০০৯ সালে ন্যাশনাল আসেম্বলি আইন পাস করে একজন রুগীকে ৪বছর অবধি রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।
চিনে ইসলামোফোবিয়া প্রচার করে উইঘুর বা কাঝাক মুসলমানদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার নামে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে আসার যে হিরিক লেগেছে গত কয়েক বছর, তাও সস্তা শ্রমের জন্যেই।এই বন্দিদের টেকনিকাল ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে এবং বিভিন্ন কারখানায় সস্তা মজুর হিসেবে কাজ করানো হয়। মূলত টেক্সটাইল শিল্পে এরা কাজ করে।
সল্প দৈর্ঘ্যের প্রবন্ধে উদাহরণ বাড়িয়ে লেখা দীর্ঘতর করার অবকাশ নেই। তাই অল্প পরিসরে দুনিয়া জুড়ে কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্শন করার চেষ্টা করবো। দেখা যাচ্ছে অভিবাসী ডিটেনশন ক্যাম্প সম্পর্কিত এই প্রক্রিয়াটা পৃথিবীর জুড়ে পুঁজিপতিরা নতুন উদ্যমে শুরু করেছে ২০০০ সালের পরে। নির্দিষ্ট ভাবে বললে ২০০১ সালে ৯/১১ ঘটনার পরে। ২০০৮ সালের আন্তর্জাতিক আর্থিক মহামন্দার সময় যা আরো বিস্তার লাভ করে। একদিকে দুনিয়া জুড়ে টেকনোলজির উন্নতি এবং পুঁজির বিশাল ঘনীভবনের তুলনায় মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বিপুল হ্রাসের ফলে লাভজনক ভাবে পুঁজি বিনিয়োগের জায়গা খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। বর্ধিত পুনর্বিনিয়োগ যেহেতু পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য তাই যত দিন যাচ্ছে এই সংকট আরো গভীর হচ্ছে। গোটা পৃথিবী জুড়ে কারখানা বন্ধ হচ্ছে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য সহ সমস্ত জনকল্যাণমুখী ক্ষেত্র থেকে সরকারি ভরতুকি তুলে নিয়ে বৃহৎ পুঁজিপতিদের ভরতুকি দেওয়া হচ্ছে। এই সময় খুব সহজেই ঋণ পাওয়া যাচ্ছে আর সুদের হার ক্রমশ কমেই চলেছে। এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে শ্বাস নিতে একদিকে যুদ্ধ লাগিয়ে চাহিদা বাড়িয়ে যুদ্ধাস্ত্রে বিনিয়োগ করে মুনাফা কামানোর চেষ্টা হচ্ছে, অন্য দিকে উৎপাদন খরচ আরো কমিয়ে মুনাফা টেনে বাড়াতে আরও সস্তায় বা বিনামূল্যে শ্রমিক খাটিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এই দানবিক কর্মসূচিকে কঠোরতার সাথে রূপায়ণ করার জন্য পুঁজিপতিরা বিভিন্ন দেশের শাসন ক্ষমতায় উগ্র দক্ষিণপন্থী উন্মাদদের এনে বসাচ্ছে।
গত শতাব্দীর ২০-৩০-এর দশকে উগ্র জাতীয়তাবাদ, জাতিবিদ্বেষী আবহাওয়া তৈরি করে বৃহৎ পুঁজিপতিদে সমর্থনে ইতালি ও জার্মানিতে ফ্যাসিস্টরা ক্ষমতায় এসে মালিকের মুনাফা টেনে বাড়াবার জন্য বিভিন্ন আইন বানায়। মালিকের বিরুদ্ধে শ্রমিকের বিরুদ্ধতাকে ‘দেশদ্রোহিতা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মালিকের সম্মতি ছাড়া কাজ ছাড়া যেত না। জার্মানিতে হিটলার ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৫-এর মধ্যে ২৪-৪০% মজুরি হ্রাস করে। ইতালিতে মুসোলিনি ১৯২৭ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে ৬০%-৭৫% মজুরি হ্রাস করে। এই ভাবে শ্রমিকদের প্রায় দাসে পরিণত করা হয়।
এই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেই ভারতের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে বুঝতে হবে। ২০০৩ সালে বাজপেয়ী সরকার নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর সংজ্ঞা দেন এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর সন্তানও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ঘোষণা করেন এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা যাতে কখনো ভারতের নাগরিকত্ব না পায় তার ব্যবস্থা করেন। এর সাথে ১৪এ ধারা যুক্ত করে সারা দেশে বাধ্যতামূলক ভাবে এনআরসি করার কথা বলা হয়। এই সংশোধনী আইনটি বিরোধীদের সমর্থনে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়।
বিজেপির থেকে ভোট কাড়তে এই বিরোধী দলগুলো এখন এনআরসির বিরুদ্ধে গলা ফাটাচ্ছে, অথচ ১৪এ ধারা বা ২০০৩ সালের অভিবাসী বিরোধী আইন বিলোপের দাবি করছে না। এই দলগুলোর মধ্যে যারা দেশে বিভিন্ন রাজ্যে সরকার চালাচ্ছে তারা চুপচাপ এনআরসির প্রথম ধাপ এনপিআর প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছিলো। ক্যাব পাস হওয়ার পর গণবিক্ষোভের পর এনপিআর স্থগিত করে। এখনো গোপনে এই প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরা বিজেপির থেকে ভোট কাড়বে আর মানুষের থেকে নাগরিকত্ব। কারণ এই কর্মসূচি শুধুমাত্র বিজেপির নয়, এটা বৃহৎ পুঁজিপতিদের আন্তর্জাতিক কর্মসূচি। ৭ সেপ্টেম্বর সংবাদ সংস্থা স্ক্রোল রিপোর্ট করেছে যে জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় সরকার সমস্ত রাজ্য সরকারকে সমস্ত বড়ো বড়ো শহরে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরির নির্দেশ পাঠিয়েছে। বড়ো বড়ো শহরে জমির অভাব এবং আকাশ ছোঁয়া দাম হওয়া সত্ত্বেও, যেহেতু শিল্প এবং সেবা ক্ষেত্রের উপর ভিত্তি করেই শহরগুলো গড়ে ওঠে তাই এ সমস্ত ক্ষেত্রে আরো সস্তায় মজুর সরবরাহই এই ডিটেনশন ক্যাম্পগুলোর উদ্দেশ্য কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। দেখা গেল এনআরসি বিরোধী কোনো রাজ্য সরকারই কিন্ত এই নির্দেশিকা নিয়ে মানুষকে সচেতন করলো না। তার পর জানা গেল বাংলায় রাজারহাট, বনগাঁ, নবি মুম্বাইয়ের নেরুল সহ দেশের বিভিন্ন প্রদেশে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি হচ্ছে। ইতিমধ্যে লারসেন অ্যান্ড টুবরো (L&T) কোম্পানি অসমের ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে দৈনিক ৯৮ টাকা মজুরিতে লোক নেবে বলে জানিয়েছে।
এনআরসি প্রক্রিয়ায় ভাষাধর্ম নির্বিশেষে বড়ো অংশের মানুষকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী/ অভিবাসীর তকমা দিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে পুরবে। আর সিএএ কাউকেই রক্ষা করবে না। তার দুটি কারণ, প্রথমত ২০১৬ সালে যৌথ সংসদীয় কমিটিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এই আইন এসেছে সেই ৩১,৩১৩ জন মানুষের কথা মাথায় রেখে যারা বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে ভারতে এসেই সরকারকে জানিয়েছে যে তারা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে ভারতে এসেছে। ফলত এনআরসিকে মুসলমান বিরোধী চক্রান্ত বল্লে ৮৬% অমুসলিমদের বোঝানো হয় যে তাদের কোনো ভয় নেই। এই ভাবে তাদের এনআরসি বিরোধী আন্দোলন থেকে দুরে সরিয়ে রাখা হয়। অথচ ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে হিন্দুরাই সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে।
দ্বিতীয়ত দেশের মধ্যে বড়ো সংখ্যক মানুষ যদি নাগরিকত্ব না থাকার ফলে দর কষাকষির ক্ষমতা হারিয়ে আরো সস্তা শ্রমিকে পরিণত হয় তবে যাদের নাগরিকত্ব টিকে যাবে তাদেরও আর কোনো দর কষাকষির ক্ষমতা থাকবে না। তারাও ওই মজুরিতে খাটতে বাধ্য হবে। এনআরসিতে প্রাইভেট হসপিটালের নার্স, জুটমিল শ্রমিক থেকে আইটি ইঞ্জিনিয়ার সব ধরনের শ্রমিকই মিলবে।
সুতরাং এনআরসি-কে যারা নেহাতই বিজেপির হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের শখ পূরণের জন্য মুসলমান বিরোধী চক্রান্ত হিসেবে দেখাতে চাইছেন তারা আসলে আসল দোষী আদানি আম্বানির মত ভারতের বা আন্তর্জাতিক বৃহৎ পুঁজিপতিদের জনগণের ঘৃণা থেকে বাঁচাতে চাইছেন। যারা এই আন্দোলনকে সংবিধান রক্ষার শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বেধে রাখতে প্রাণপাত করছেন, তারা আসলে শোষণমুলক সমাজব্যবস্থাটাকেই রক্ষা করতে চাইছেন এবং শাসকের এক তরফা হিংসাকে মেনে নিতে বলছেন। অর্থনৈতিক সংকট থেকে চোখ ঘোরাতে এনআরসি করা হচ্ছে বললে সমস্যাকে লঘু করা হয় বরং সংকট থেকে সাময়িক ভাবে রক্ষা পেতেই এনআরসি। প্রচলিত আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি এই সময়ের রাজনৈতিক সামাজিক সংকটের জন্য দায়ী। তাই আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির র্যাডিকাল পরিবর্তন ছাড়া সংকট থেকে নিস্তার পাওয়ার উপায় নেই।
“No Replastering, The System is Rotten”
খুব ভালো তথ্যসমৃদ্ধ লেখা।
গোড়া থেকেই এই কথাই বলে এসেছি – মুল লক্ষ – তুলনামূলক দুর্বল শ্রেণী কে আলাদা করে নিয়ে – সুলভ শ্রমিক বানিয়ে তোলা । আরো প্রচেস্স্টা হোলো খনিজ পুষ্ট অঞ্চল থেকে আদিবাসীদের সরিয়ে – খনিজ লুঠ এবং বেগার শ্রমিক পাওয়া । এর জন্য ধর্মীয় বিভাজন সবচেয়ে কার্যকরী । প্রান্তিক লোকেদের ‘ধর্মীয় আচরণ ‘ -ই একমাত্র অবলম্বন । পরে আসবে ভাষাগত বিভাজন , তার পরে আঞ্চলিক / ভৌগলিক বিভাজন । রাজ্যগুলোকে আরো ছোটো ছোটো ভাগ করা হবে ।
সমৃদ্ধ হলাম। অনেক অজানা তথ্য জানলাম। ধন্যবাদ।