আমি প্রশ্ন দিয়েই লেখা শুরু করছি। প্রথম প্রশ্ন সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ এর মাধ্যমে বিজেপি যাদের নাগরিকত্ব দিতে চাইছে এত দিন কেউ তাদের নাগরিকত্ব দেয়নি কেন ? দ্বিতীয় প্রশ্ন তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন আইন গত বাধা ছিল কি ? তৃতীয় প্রশ্ন বাধা থাকলে তা তৈরি করেছিল কে ? চতুর্থ প্রশ্ন যে দল বাধা তৈরি করেছিল সে দল বাদ দিয়ে অন্যান্য দলগুলোর ভূমিকা কী ছিল ? সিএএ না করে কি উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়া যাবে না ? আপাতত এগুলোই আলোচনা করি।
দেশের সংবিধানে এবং নাগরিকত্ব আইনে ২০০৪ সালের আগে এনআরসি করার কোনো কথা ছিল না। ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনকে সংশোধন করে দেশে এনআরসি করার আইন তৈরি করে। রাষ্ট্রপতি তাতে স্বাক্ষর করেন ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বর। সেই তারিখ থেকেই দেশে এনআরসি করার আইন চালু আছে। ধারাটি আছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০০৩ এর ১৪এ ধারায়।
ঐ সময় আমাদের রাজ্যের লোকসভায় ৪২ জন সাংসদের মধ্যে ২৯ জন ছিলেন বামফ্রন্টের। ৮ জন ছিলেন তৃণমূলের। কংগ্রেসের ছিলেন ৩ জন এবং বিজেপির ছিলেন ২ জন। সেই সংশোধনীতে প্রধান তিনটি বিষয় ছিল। ক) এনআরসি করা কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক। খ) অনুপ্রবেশকারীর সংজ্ঞা নির্ধারণ। গ) নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্মগত অধিকারকে শর্তযুক্ত করা। অনুপ্রবেশকারীর সংজ্ঞায় ধর্মের ভিত্তিতে কোন পার্থক্য করা হয়নি। জন্মগত অধিকারকে শর্তযুক্ত করে বলা হল ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বর এর পর থেকে ভারতে জন্মগ্ৰহণকারী শিশুর মা-বাবা দুজনেই ভারতের নাগরিক বা একজন বৈধ নথিপত্রধারী বিদেশি না হলে সে শিশু ভারতের নাগরিক হতে পারবে না। শিশুর নাগরিকত্ব হওয়ার জন্মগত অধিকারকে শর্তযুক্ত করার সূচনা আরো আগে। ১৯৮৭ সালে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনকে সংশোধন করে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্মগত অধিকারকে প্রথম শর্তযুক্ত করা হয়। সেই সংশোধনী অনুযায়ী ১৯৮৭ সালের ১ জুলাই এর পর থেকে জন্ম হওয়া শিশুর মা-বাবার যে কোনো একজন ভারতীয় নাগরিক না হলে সে শিশু ভারতের নাগরিক হতে পারবে না। সে সময় দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন রাজীব গান্ধী। রাজ্য থেকে লোকসভায় যাওয়া ৪২ জন সাংসদের মধ্যে ২৬ জন ছিলেন বামফ্রন্টের। ১৬ জন ছিলেন কংগ্রেসের। অনুপ্রবেশকারীর সংজ্ঞা বলা হয় যারা বৈধ অনুমতিপত্র নিয়ে ভারতে প্রবেশ করার পর অনুমতি কালের সীমা পার হওয়ার পরেও এ দেশে থেকে গেছে বা বৈধ অনুমতিপত্র ছাড়াই এ দেশে প্রবেশ করেছে তারা সবাই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। এখানে ধর্মের ভিত্তিতে বিভেদ করা হয়নি। হিন্দু-মুসলমান ভাগ করা হয়নি। যে উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বার বার বলা হচ্ছে এই প্রথম তাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ঘোষণা করা হল। নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত বাধা তৈরি হল। নাগরিকত্ব আইনের ২০০৩ সালে সংশোধনীর আগে উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো আইনগত বাধা ছিল না।
এর পর ২০১৬ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০০৩-এ আবার সংশোধনী আনতে চায়। এই নতুন সংশোধনী প্রস্তাবে ( বিল ) মুসলিম বাদে অন্যদের বৈধ অনুপ্রবেশকারী বলা হয়। অর্থাৎ এই বিল অনুযায়ী মুসলিমরা থেকে গেলেন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী আর অমুসলিমরা হয়ে গেলেন বৈধ অনুপ্রবেশকারী। সেই সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং নোট দিয়ে বলেছিলেন উদ্বাস্তুরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হওয়ার কারণে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার যোগ্য নয়। ওদের যোগ্য করার জন্য বৈধ অনুপ্রবেশকারী করা হল। সেই বিলই এখন সামান্য পরিবর্তন করে আইনে পরিণত হল। ২০০৩ সালের সংশোধিত আইনের মাধ্যমে হিন্দু উদ্বাস্তুদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ঘোষণা করে যে পাপ করেছিলেন সেই পাপ মোচনের জন্য ২০১৬ থেকে চেষ্টা করে ২০১৯-এ সফল হল।
এই আইনেও উদ্বাস্তুরা অত সহজে নাগরিকত্ব পাবেন না যত সহজে পাবেন বলে বিজেপি প্রচার করছে। এতক্ষণের আলোচনায় বোঝা গেল আজকের সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ করার লক্ষ্যে অনেক আগেই রাষ্ট্র কাজ শুরু করেছে এবং দুটি ধাপ পার করে তৃতীয় ধাপে সিএএ করল। প্রথম ধাপে শিশুর নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্মগত অধিকারকে শর্তযুক্ত করল। দ্বিতীয় ধাপে তিনটি কাজ করল। এক নং কাজ, শিশুর নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্মগত অধিকারকে সম্পূর্ণ শর্তযুক্ত করল। দুই নং কাজ, তিনটি দেশ থেকে আসা সব ধর্মের মানুষদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ঘোষণা করল। তিন নং কাজ, এনআরসি করার কাজকে কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক করল। তৃতীয় ধাপে, বর্তমান সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯-এ তিনটি দেশ থেকে আসা মানুষদের মধ্যে মুসলিমদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে রেখে দিয়ে অমুসলিমদের বৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ঘোষণা করল। আর সমগ্ৰ প্রক্রিয়ায় সব রাজনৈতিক দলই বুঝে বা না বুঝে ভূমিকা পালন করেছে।
আজকে যদি সিএএ বাতিল করা হয় বা প্রত্যাহার করা হয় তা হলেও কিন্তু নাগরিকত্ব নিয়ে চলমান সংকটের সমাধান হবে না। শুধু এতটুকুই হবে, তিনটি দেশ থেকে আসা অমুসলিমরা বৈধ অনুপ্রবেশকারী থেকে পুনরায় অবৈধ অনুপ্রবেশকারীতে পরিণত হবে। এনআরসি, এনপিআর করার আইন বাতিল হবে না। ভারতে জন্মগ্ৰহণকারী শিশুর নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্মগত অধিকার শর্তমুক্ত হবে না। হ্যাঁ, বর্তমান সিএএ না করে উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা যেত না। বাধা হয়ে ছিল ২০০৩-এর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। তবে সিএএ বর্তমান রূপে না এনে শুধু মাত্র ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনকে বাতিল বা রদ করে দিলেই বর্তমান সংকট তৈরি হত না এবং উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকত না। তখন সব ধর্মের উদ্বাস্তুদের আইন করে নাগরিক ঘোষণা করলেই সব সমস্যা মিটে যেত।