ওয়েব পোর্টাল ও সোশাল মিডিয়ার জমানায় সাধারণ পাঠকের কাছে একটি বড়ো সমস্যা হুসেবে সামনে এসেছে ভুয়ো খবর বা ফেক নিউজ। গণ মাধ্যমে ফেক নিউজ বিষয়টা নতুন নয়। হলুদ সাংবাদিকতা বা ইয়েলো জার্নালিজম শব্দবন্ধটির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। কিন্তু সেটা ছিল, ঘটনাকে বিকৃত ভাবে পরিবেশন সংবাদপত্রের বিক্রি বাড়ানোর স্বার্থে বা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর জনপ্রিয়তা বাড়ানো বা কমানোর স্বার্থে। এর জন্য অনেক সময় নির্দিষ্ট ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে লেখা হত বা সত্যের কোনো একটি দিককে লুকিয়ে রাখা হত। আর একটা ছিল(এখনও আছে), পয়লা এপ্রিল তারিখে ভুয়ো খবর প্রকাশ করে নিরীহ মজা, যা এপ্রিল ফুল হিসেবে পরিচিত।
কিন্তু এখন যে সব ভুয়ো খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তা ভয়ঙ্কর। হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী ও দাঙ্গাবাজরা সমাজকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করা, মানুষের মনে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ তৈরি এবং দাঙ্গা লাগিয়ে খেটে খাওয়া মানুষদের নিজেদের মধ্যে লড়িয়ে দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণের জন্য ব্যাপক ভাবে সোশাল মিডিয়া ও ওয়েব পোর্টালকে ব্যবহার করছে। আমরা অনেকেই কোনো একটা খবর দেখে, বিষয়টি খতিয়ে দেখছি না। ঘটনাটি সত্য কিনা, তা যাচাই করার সময় পাচ্ছি না। ফলে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করছে ফ্যাসিস্টরা। এই পরিস্থিতিতে ভুয়ো খবর কী ভাবে বোঝা যাবে, তা জানা দরকার।
১) শুধু শিরোনাম পড়বেন না
আমরা অনেকেই সময়ের অভাবের জন্য সোশাল মিডিয়ার নিউজ ফিডে আসা অনেক খবরের শুধু হেডলাইন পড়েই শেয়ার করে দিই। কখনও বা শুধু প্রথম অনুচ্ছেদটা পড়ি।যারা ফেক নিউজ ছড়ায়, তারা এই প্রবণতাটা জানে। তাই অনেক ক্ষেত্রেই প্রথম অনুচ্ছেদে কিছু ভুয়ো তথ্য দিয়ে পড়ে কিছু ঠিক তথ্য দেয়। অনেক সময় দেখা যায় শিরোনামে যা লেখা আছে, তার সঙ্গে মূল খবরের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই কোনো খবর শেয়ার করার আগে পুরোটা পড়ুন।
২) ওয়েব পোর্টালটি যাচাই করুন
বিজ্ঞাপনে ভর্তি অচেনা ওয়েবসাইটের খবরকে সন্দেহের চোখে দেখুন। অচেনা ওয়েবসাইটে কোনো নজরকাড়া খবর দেখলেই সাইটটি ভালো করে দেখুন। সেটি কতদিনের পুরনো এবং কী ধরনের খবর সেখানে এর আগে প্রকাশ হয়েছে, সেটা বুঝে নিন। তাহলেই বুঝবেন সংশ্লিষ্ট খবরটি বিশ্বাস করা যায় কিনা।
৩) খবর প্রকাশের তারিখ ও সময় দেখুন
ভুয়ো খবরের আর একটি চরিত্র হল, অনেক সময়ই একটি পুরনো খবর ফেসবুক বা অন্যান্য সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পাঠকরা খবরটি দেখার সময় প্রায়ই প্রকাশের তারিখ বা সময় দেখি না। সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। আবার এমনও হয় যে খবরটি সদ্য পোস্ট করা হয়েছে কিন্তু কিন্তু তাতে যে ঘটনার কথা বলা হচ্ছে, সেটি পুরনো। তাই পুরো খবরটি মন দিয়ে পড়া দরকার।
৪) লেখক কে?
লেখকের নামের মধ্যে অনেক কিছু থাকে। কোনো প্রবন্ধ সন্দেহজনক মনে হলে, সেই লেখকের নাম দিয়ে গুগুলে সার্চ করা উচিত। তাতেই দেখা যাবে, তিনি এর আগে কী কী লিখেছেন। তিনি যথাযথ বিশ্বাসযোগ্য বিষয় লেখেন নাকি ভুয়ো তথ্য ছড়ান, সেটাও বোঝা যাবে।
৫) খবরে কী কী লিঙ্ক এবং সূত্র ব্যবহার করা হয়েছে?
বহু ক্ষেত্রে ভুয়ো খবরও নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ করার জন্য কিছু লিঙ্ক ও সূত্র দেয়। সেই সব সূত্রগুলোও যাচাই করা দরকার যে আদৌ সেখানে ঠিক তথ্য দেওয়া রয়েছে কিনা।
৬) উদ্ধৃতি ও ছবি
খবরে ব্যবহৃত উদ্ধৃতিগুলোও যাচাই করা দরকার।কোনো কোটেশন দেওয়া থাকলে যাচাই করা দরকার সেগুলি কোন ক্ষেত্রে কে কোথায় বলেছিল।
একই ভাবে ছবির ক্ষেত্রেও এমনটা হয়। এক জায়গার ছবি তুলে অন্য জায়গার ছবি হিসেবে দেখানো হয় ভুয়ো খবরে। হিন্দুত্ববাদীদের আইটি সেল এটা নিয়মিত করে থাকে। লক্ষ্য থাকে দাঙ্গা লাগানো। গুগুলে ছবি যাচাই করারও সুযোগ আছে ‘রিভার্স ইমেজ সার্চ’ করে। TinEye ধরনের টুলগুলিও আপনাকে বলে দেবে ছবিটি আসলে কোথাকার।
৭) আপনার বিশ্বাস অনুযায়ী খবর প্রকাশ
আমরা সাধারণত যে ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্বাস নিয়ে চলি, সেই ধরনের খবরেই নজর দিই। সেগুলোই শেয়ার করি। ফেসবুকও তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে, আমরা যে ধরনের খবর পড়ি সাধারণত, সেগুলিকেই সামনে নিয়ে আসে। ভুয়ো খবরের কারবারিরাও এটাকে কাজে লাগায়। তারা তাদের সম্ভাব্য পাঠকদের আবেগকে কাজে লাগানোর জন্য ভুয়ো খবর তৈরি করে। তাই খবরটি যদি আপনার পছন্দেরও হয়, তবুও তথ্যগুলো যাচাই করে দেখুন।
৮) অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমও খবরটি প্রকাশ করছে কিনা দেখুন
যদি কোনো খবর পড়ে সন্দেহজনক মনে হয় বা কেউ যদি দাবি করে যে তারা কোনো বিশাল গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রথম প্রকাশ করছে, তাহলে খোঁজ নিন অন্যরাও খবরটি প্রকাশ করছে কিনা বা ওই সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করছে কিনা। কোনো বিষয়ে যদি কোনো সন্দেহজনক সূত্র থেকে একটি মাত্র খবর প্রকাশিত হয়, তাহলে সাবধান হন। বিশ্বাসযোগ্য ও সুপ্রতিষ্ঠিত কোনো সংবাদ মাধ্যও সেটি প্রকাশ করেছে কিনা খোঁজ নিন।
৯) শেয়ার করার আগে ভাবুন
ভুয়ো সংবাদের কারবারিরা চায়, সেই খবরটা ছড়িয়ে যাক এবং তাদের উদ্দেশ্য মতো সমাজে গোলমাল বাঁধুক। এর ফলে ওই ভুয়ো খবরের সঙ্গে যুক্ত সকলেরই ক্ষতি হতে পারে। তাই কোনো খবর শেয়ার করার আগে একটু ভাবুন, সময় নিন, যাচাই করুন।