Home খবর নাগরিকত্বের নথি নিয়ে মিথ্যা প্রচার বিজেপির, গরিব মানুষের টুঁটি চিপে ধরতেই এনআরসি-র আয়োজন

নাগরিকত্বের নথি নিয়ে মিথ্যা প্রচার বিজেপির, গরিব মানুষের টুঁটি চিপে ধরতেই এনআরসি-র আয়োজন

নাগরিকত্বের নথি নিয়ে মিথ্যা প্রচার বিজেপির, গরিব মানুষের টুঁটি চিপে ধরতেই এনআরসি-র আয়োজন
0

সৌম্য মণ্ডল

এর আগে বিজেপির মিথ্যা প্রচারের জবাবে  সরকারি নথিপত্র সহযোগে আমরা দেখিয়েছি যে সিএএ আদৌ হিন্দুদের এনআরসি থেকে রক্ষা করবে না এবং এনপিআর-এর জন্ম এনআরসি তৈরির জন্যেই। এই আলোচনায় নাগরিকত্ব প্রমাণের প্রয়োজনীয় নথিপত্র নিয়ে বিজেপির মিথ্যাচার ফাঁস করা হবে।  বিজেপি বা কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে প্রয়োজনীয় নথিপত্র নিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে বিভিন্ন রকম প্রচার করা হচ্ছে।  কখনও বলা হচ্ছে বার্থ সার্টিফিকেট দেখালেই নাগরিকত্ব প্রমাণ করা যাবে, কখনও বলছে ভোটার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমান! মোদ্দা কথা সরকার পক্ষ বলতে চাইছে চিন্তা করার কোনো কারণ নেই, নাগরিকত্ব প্রমাণ করা খুবই সহজ। শুধু সরকার পক্ষ নয়, কিছু অতি উৎসাহিত ব্যাক্তি ও সংগঠন প্রয়োজনীয় নথিপত্র নিয়ে বিভিন্ন প্রকার প্রচারে নেমেছেন। বিজেপি বা বিভিন্ন বিজ্ঞ ব্যাক্তিরা নন বরং ভারতের নাগরিকত্ব আইন নির্ধারিত করে কে নাগরিক আর কে নয়।  

আরও পড়ুন: ভুয়ো খবর কীভাবে চিনবেন?

১৯৮৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধি অসম চুক্তি সাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে বলা হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যে যারা অসমে এসেছেন তাদের অসমের বাসিন্দা ধরা হবে। এর পরে যারা এসেছেন তাদের বিতাড়িত করতে হবে। ফলে অসমে এনআরসি করার সময় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চকে ভিত্তি বর্ষ ধরা হয়েছে।  অসম চুক্তি শুধু অসমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, সারা ভারতের জন্য কিন্ত অসম চুক্তি প্রযোজ্য নয়। যদিও ২০১৯ সালে  সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন অসমে নতুন করে এনআরসি হবে। কারণ ব্যাখ্যা করে অমিত শাহ বলেছেন অসম চুক্তি অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট ১৯৭১ সালকে ভিত্তি বর্ষ ধরে এনআরসি কর্মসূচি রূপায়ণ করে, এক দেশে দু’রকম ভিত্তি বর্ষ হতে পারে না, তাই এক নিয়মে সারা দেশে এনআরসি করার জন্য অসমে আবার এনআরসি হবে। সুতরাং অসমে  এনআরসি করতে খরচ হওয়া নাগরিকদের ১৬০০ কোটি টাকা জলে ফেলে দেওয়া হলো। যদিও সেই ভিত্তি বর্ষ কী হবে তা নিয়ে এখনও পর্যন্ত কিছু জানাননি মন্ত্রীমশাই। তবুও আমরা দেখে নেব দেশের নাগরিকত্ব আইনের চোখে কারা নাগরিক আর কারা নাগরিক নয়।                                         

সরকার বলছে ভোটার, আধার, রেশন ইত্যাদি কার্ড থাকলেই কেউ নাগরিক হয়ে যায় না। নাগরিক হলে তবেই ঐ সমস্ত কার্ড পাওয়া যায়। কারো যদি ঐ সব কার্ড থাকে, কিন্তু যদি সে নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে না পারে, তবে ধরে নেওয়া হবে যে প্রতারণা করে ঐ কার্ড তিনি পেয়েছেন।(জেপিসি রিপোর্ট ২.১৯, পৃ.৩৯)

সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে লেখা আছে ‘আমরা ভারতের জনগণ’। সুতরাং কারা এই ভারতের জনগণ বা নাগরিক? যারা কিনা সংবিধান গ্রহণ করছে, তা নির্দিষ্ট করা প্র‍য়োজন ছিলো। সংবিধানের ৫নং ধারায় কারা ভারতের নাগরিক নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। 

৫(এ), ৫ (বি) ধারা অনুযায়ী ভারতে যারা স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন তাদের ভারতে জন্ম হয়ে থাকলে অথবা  মা-বাবার মধ্যে অন্তত একজন ভারতে জন্মে থাকলে তারা ভারতের নাগরিক। ৫(সি)  অনুযায়ী যারা সংবিধান গ্রহণের আগে অন্তত ৭ বছর ভারতে বসবাস করেছেন তারা ভারতের নাগরিক। ৬(এ) (বি)(i)  ধারায় বলা হয়েছে কোনো ব্যক্তির অথবা কোনো ব্যক্তির বাবা মায়ের দাদু ঠাকুমার মধ্যে অন্তত একজন যদি ভারতে জন্মগ্রহণ করে থাকেন এবং তিনি যদি পাকিস্তানভুক্ত এলাকা (বর্তমানে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) থেকে ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাই এর মধ্যে ভারতে এসে থাকেন তবে তিনি ভারতের নাগরিক। 

সুতরাং এই চার প্রকার মানুষ বাদে সবাই বিদেশি হিসেবে গণ্য হবেন। সুতরাং এরাই হলেন সংবিধানের ‘আমরা ভারতের জনগণ’ এবং ১৯৫১ সালের প্রথম নাগরিকপঞ্জির নাগরিক। এদের বংশধরেরা ভারতের স্বাভাবিক নাগরিক। ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ের পরে যদি কেউ এসে থাকেন তবে তিনি স্বাভাবিক ভাবে আর ভারতের নাগরিক হয়ে যাচ্ছেন না। তাকে ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানাতে হবে।   

এর পর ১৯৫৫ সালে সংসদে গৃহীত হয় ভারতের প্রথম নাগরিক আইন। এই আইন অনুযায়ী ভারতের মাটিতে, দূতাবাসে,জাহাজে বা উড়োজাহাজে জন্মেছে এরকম যে কেউ ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন।  

এরপর কংগ্রেস সরকার ১৯৮৬ সালে আইনটি সংশোধন করেন। এই সংশোধনে বলা হয় ভারতে জন্মালেই কেউ আর ভারতীয় হয়ে যাবে না। শিশুর মা বাবার মধ্যে অন্তত একজনকে ভারতের বৈধ নাগরিক হতেই হবে। এই আইনটি ১৯৮৭ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর।    

২০০৩ সালে বিজেপি সরকার নাগরিক আইনটিকে পুনরায় সংশোধন করেন। এই সংশোধনে বলা হয় ভারতে জন্মানো শিশুটির বাবা মায়ের মধ্যে একজনও যদি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হয় তবে শিশুটি নাগরিকত্ব পাবে না। অর্থাৎ বাবা মায়ের মধ্যে একজন বিদেশি নাগরিক হলেও সমস্যা নেই। কিন্তু অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হলে চলবে না।     

কিন্তু প্রশ্ন হল কারা এই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী? এই আইনে বলা হয় যারা বিনা ভিসা পাসপোর্ট বা বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই ভারতে চলে এসেছেন বা ভারতে বসবাসের অনুমতির মেয়াদ শেষের পরেও ভারতে রয়ে গেছেন তারা সবাই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর সন্তানও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। এই আইনে আরও বলা হয় অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা কখনও ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানাতে পারবেন না। এই আইনে কিন্তু অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নির্ধারণে ধর্মের বাছবিচার করা হয়নি। এর মানে বিজেপি সরকার ২০০৩ সালে যে আইন তৈরি করেছে তা হিন্দু হোক বা মুসলমান ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর তকমা দিয়েছে। 

সুতরাং পাকিস্তান বা বাংলাদেশ ভুক্ত অঞ্চল থেকে ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ের পর  থেকে আজ পর্যন্ত যারা বিনা ভিসা পাসপোর্টে ভারতে এসেছেন বা ভারতে বসবাসের অনুমতির মেয়াদ শেষের পরেও ভারতে রয়ে গেছেন তারা প্রত্যেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। কিন্তু তাদের সন্তান যদি ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে ভারতে জন্মায় সে ভারতের নাগরিক।  ১৯৮৭ সালের ১জুলাই থেকে ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বরের মধ্যে যে শিশু জন্মেছে তার বাবা মায়ের দুজনাই যদি ভারতের বৈধ নাগরিক না হন তাহলে শিশুটি নাগরিকত্ব পাবে না। কিন্তু বাবা মায়ের মধ্যে একজন ভারতের বৈধ নাগরিক হলে শিশুটি নাগরিকত্ব পাবে। ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বরের পরে মা বাবার মধ্যে একজনও যদি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হয় তবে শিশুটি নাগরিকত্ব পাবে না। অর্থাৎ মা বাবার মধ্যে একজন ভারতের নাগরিক অন্যজন বিদেশের নাগরিক হলেও শিশু নাগরিকত্ব পাবে কিন্ত বাবা মায়ের মধ্যে একজনও যদি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হয় তবে শিশু নাগরিকত্ব পাবে না। 

এ এছাড়াও ভারতে বহু মানুষ আছেন যারা উপরোক্ত আইনি বিচারে নাগরিক হলেও তারা সেটা প্রমাণ করতে পারবেন না। কেইবা জানতো যে এত বছর পরে সরকারের মাথায় এরকম উদ্ভট খ্যাপামি চাপবে, তাই দাদুর নথিপত্র যত্নে জমিয়ে রাখতে হবে! ভারত দরিদ্র, অশিক্ষা, অনাহারের দেশ। মানুষ যত গরিব তত তার নথিপত্র কম। বিপুল সংখ্যক মানুষের কাগজপত্র নিয়ে সচেতনতার অভাব আছে। দীর্ঘদিন  পর্যন্ত নারীদের সম্পত্তির ভাগ দেওয়া হতো না। এমনকি এখনও মেয়েদের সম্পত্তির ভাগ দেওয়ার ব্যাপক প্রচলন হয়নি। যাদের সম্পত্তিই নেই তারা সম্পত্তির পারিবারিক হস্তান্তরের দলিল দেখাবেন কী ভাবে? তা ছাড়া  বহুমানুষের আত্মীয় পরিজন, গরু ছাগল, ঘটি বাটির সাথে নথিপত্র ভেসে গেছে বন্যায়। কালের নিয়মে অনেকের নথিপত্র সরকারি দফতরে পোকা ধরে নষ্ট হয়ে গেছে।দেশে দীর্ঘ দিন বাড়িতেই শিশুর জন্ম হত। এখনও হয়। ফলে অনেকই ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে ভারতে জন্মালেও জন্মের শংসাপত্রের অভাবে তা প্রমাণ করতে পারবেন না। অসমে দেখা গেছে যে সরকারি কাগজে নামের ভুল বা নামের বানান ভুলের কারণে অনেকে প্রমাণ করতে পারছে না তিনি নির্দিষ্ট ব্যক্তির বংশধর। ফলে প্রতিবেশী দেশ থেকে যারা এদেশে এসেছেন বা যাদের পূর্বপুরুষরা এসেছেন তারা শুধু নয় যারা আইনি বিচারে এই ভূখণ্ডের নাগরিক তারাও প্রমাণের অভাবে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত হবেন। নিজের দেশে বসেই বিদেশি তকমা পাবেন। যে বিদেশির কোনো দেশ নেই। 

উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক আজই জন্মানো  শিশুটির কথা। এই শিশুটিকে নাগরিক হতে গেলে নিজের বার্থ সার্টিফিকেট দেখিয়ে প্রমাণ দিতে হবে যে সে ভারতে জন্মেছে এবং তার বাবা এবং মা দুজনেই এদেশের নাগরিক বা একজনও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নয়। 

ধরা যাক এই শিশুটির বাবা ও মায়ের জন্ম ১৯৯০ সালে। সুতরাং শিশুটির মা বাবা তখনই নিজেদের নাগরিক প্রমাণ করতে পারবে যখন তারা নিজেদের বার্থ সার্টিফিকেট দেখিয়ে প্রমাণ করবে যে তারা ভারতে জন্মেছে এবং তাদের মা বাবার মধ্যে একজন অর্থাৎ শিশুটির দাদু দিদা বা ঠাকুরদা ঠাকুমার মধ্যে অন্তত একজন করে ভারতে জন্মেছে। 

ধরা যাক শিশুটির দাদু দিদা বা ঠাকুরদা ঠাকুমার জন্ম ১৯৬৫ সালে।  সুতরাং এরা যদি নিজেদের নাগরিক প্রমাণ করতে চান তবে শুধুমাত্র নিজেদের বার্থ সার্টিফিকেট দেখালেই হবে, যা প্রমাণ করে তিনি ভারতে জন্মেছেন। কিন্তু ১৯৬৫ সালে বার্থ সার্টিফিকেটের ব্যাপক প্রচলন হয়নি।  সুতরাং তার বার্থ সার্টিফিকেট থাকার কথা নয়। সুতরাং এবার তাদের প্রমাণ করতে হবে  যে এনাদের পূর্ব পুরুষ ১৯৪৮ সালের  ১৯ জুলাইয়ের আগে ভারতে এসেছেন বা ১৯৫১ সালের ভোটার লিস্টে নাম ছিলো। 

সুতরাং শিশুটির দাদু দিদা বা ঠাকুরদা ঠাকুমার মধ্যে কোনো একটা জোড়া যদি নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হয় তবে শিশুটিও নাগরিকত্ব খোয়াবে।      অসমে ডিটেনশন ক্যাম্পে মৃত দুলাল পাল ও ফালু দাসের কথা আমরা সংবাদপত্রে পড়েছি। এদের দুজনের পরিবার দেহ নিতে অস্বীকার করে এবং বলে যে মৃত ব্যাক্তিরা যদি বাংলাদেশি হয়ে থাকে তবে দেহ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দাও। এদের দুজনেরই কিন্তু প্রশাসনের দাবি মত  জমির দলিল বা ভোটার লিস্টে নাম ছিল বলে জানিয়েছে পরিবার, তবুও অজানা কারণে বিদেশি চিহ্নিত হয়েছেন। মনে রাখতে হবে অসমে এনআরসি-তে ভিত্তি বর্ষ ছিলো ১৯৭১। তাতেই ১৯ লক্ষ মানুষ নাগরিকত্ব হারিয়েছেন। সারা ভারতে এনআরসি-তে কিন্তু এই সুবিধা পাওয়া যাবে না। ফলত এনআরসি শুধু বাঙালি নয়, তামিল, বিহারি, আদিবাসী সহ সবার জন্য ক্ষতিকারক। ফলত ভাষা ধর্ম নির্বিশেষে এনআরসি রুখতে ১ এপ্রিল থেকে বয়কট করতে হবে এনপিআর। দাবি করতে হবে ২০০৩ সালের ক্ষতিকারক সংশোধনী সমূহ বাতিল কর। ভারতে জন্মেছে বা স্থায়ীভাবে বসবাসকারী সবাইকে নাগরিক মেনে নিতে হবে।      

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *