সৌম্য মন্ডল
পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস যে প্রবল ভাবে এনআরসি-বিরোধী সেটা গোটা ভারত জানে। আজ থেকে নয়, ২০১৬ সালে বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহ যখন এনআরসি করে বিদেশি বিতাড়িত করার হুমকি দিচ্ছিলেন তখন থেকেই এনআরসি-র বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঘিনী গর্জন শোনা যাচ্ছে। এমনকি রাজ্য সরকারের তরফে পোস্টার ছাপিয়ে বাংলার মানুষকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে পশ্চিম বঙ্গে এনআরসি হচ্ছে না। সম্প্রতি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস হওয়ার পরে তাঁর ব্যাঘ্র গর্জনের তীব্রতা বেড়েছে বই কমেনি।
আরও পড়ুন: এনআরসি-নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ- ফটো গ্যালারি
কিন্তু এত সব হালুম হুলুমের মধ্যেই রাজ্য স্বরাষ্ট্র দপ্তর নবান্ন থেকে একটি নোটিশ জারি করে NPR সংক্রান্ত কাজকর্ম পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত আপাতত স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে। নোটিশের শেষ লাইনে এর কারণ হিসেবে গণ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল কেনই বা এনপিআর-এর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল রাজ্য সরকারের কর্মচারীদের?
কেন্দ্র সরকারের ওয়েবসাইট হোক বা এনপিআর-এর গেজেট নোটিফিকেশন, সর্বত্র কিন্তু বলা হয়েছে এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জি প্রস্তুতির জন্যেই এনপিআর করা হচ্ছে, আগামী ১ এপ্রিল থেকে অসম বাদে সারা দেশে এনপিআর শুরু হবে।
তবে কেন এনপিআর-এর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো রাজ্য সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতর! ভাবছেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুষ্টু লোক, বিজেপির চর? রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই।
ভুলে গেলে চলবে না এনআরসি শুধুমাত্র বিজেপির কর্মসূচি নয়। এক অংশের মানুষকে দর কষাকষির ক্ষমতাহীন বেনাগরিক বানিয়ে সস্তা শ্রম আহরণ বা সমগ্র দেশের মজুরি স্তর টেনে নামানোই এনআরসি-র উদ্দেশ্য। ফলে বিজেপি কংগ্রেস তৃণমূল সহ সমস্ত সংসদীয় মূল ধারার পার্টিগুলো একে অন্যের বিগ কর্পোরেট তুতো ভাই। ভাইদের মধ্যে একটু আধটু প্রতিযোগিতা থাকেই। এই প্রতিযোগিতায় মমতার স্ট্র্যাটেজি চমৎকার। এনআরসি ইস্যুতে বিজেপির থেকে ভোট কাড়বেন আর জনতার থেকে নাগরিকত্ব।
আরও পড়ুন: নতুন আইনে সত্যিই কি হিন্দুরা নাগরিকত্ব পাবেন? সত্যিটা বলতে পারছে না বিজেপি
এনপিআর স্থগিতের পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে জয়ধ্বনি দিতে শুরু করেছেন কিছু সংখ্যালঘু নেতা ও কিছু এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের সংগঠকরা। তারা বাংলায় মমতা ব্যানার্জির হাত শক্ত করার আবদার জুড়েছেন জনতার কাছে। মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর এনপিআর প্রশিক্ষণ শিবিরের বাইরে বিক্ষোভ, এনআরসি বিরোধী সংগঠনগুলোর লাগাতার প্রচার এবং সিএএ পাস হওয়ার পরে গণবিক্ষোভ রাজ্য সরকারকে গোপনে কসাই-এর ছুরি শান দেওয়া থামাতে বাধ্য করেছে। ভেবে দেখবেন বাঘিনীর থাবা শক্ত হলে আন্দোলন গুড়িয়ে দেবে না তো?
অন্যদিকে রাজ্যের অন্যতম বিরোধী দল সিপিআই(এম) এনআরসি-র বিরোধিতা করলেও তিনচারদিন আগে পর্যন্ত এনপিআরের নাম মুখে আনছিলেন না। তারপর যখন তারা দেখলেন ‘এনপিআর বন্ধ কর’টা জনগণের দাবি হিসেবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, তখন তারাও সেই দাবি করলেন। লক্ষ্য, এনপিআর-বিরোধী আন্দোলনের সুফল ঘরে তোলা অর্থাৎ ভোট ঘরে তোলা। কিন্তু মজা হল, তারা যে রাজ্যে শাসক দল সেই কেরলে মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করলেও এনপিআর নিয়ে কোনো কথা বলেননি এখনও। আমরা জানি, তাদের দ্বিচারিতাময় ইতিহাস ও রাজনীতি অনুসরণ করে এরপর তারা বলবেন: পশ্চিমবঙ্গের বাস্তব পরিস্থিতিতে তারা এনআরসি-র বিরোধী কিন্তু কেরলের ক্ষেত্রে নয়। দেশ-বিদেশি কর্পোরেট পুঁজির সঙ্গে তারা ‘দ্বান্দ্বিক’ সম্পর্ক বজায় রাখেন কিনা!