Home রাজনীতি নতুন আইনে সত্যিই কি হিন্দুরা নাগরিকত্ব পাবেন? সত্যিটা বলতে পারছে না বিজেপি

নতুন আইনে সত্যিই কি হিন্দুরা নাগরিকত্ব পাবেন? সত্যিটা বলতে পারছে না বিজেপি

নতুন আইনে সত্যিই কি হিন্দুরা নাগরিকত্ব পাবেন? সত্যিটা বলতে পারছে না বিজেপি
0

সৌম্য মন্ডল

একই ব্যক্তি যদি ভিন্ন ভিন্ন ব্যাক্তির কাছে  ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত হন এবং সমস্ত ব্যক্তি যদি এক সাথে মুখোমুখি হন তাহলে যে বিভ্রান্তি ঘটতে পারে তা নিয়ে বলিউডি কমেডি সিনেমার অভাব নেই। বাস্তব রাজনীতিতেও যে এরকম কিছু ঘটতে পারে কেই বা জানতো? 

 নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল পাস হয়ে আইনে পরিণত হওয়ার পর বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। 

মতুয়া বা হিন্দু সম্প্রদায়ের এক অংশ আনন্দে মেতেছে এবং বিজেপিকে ক্যাবের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছে। কারণ তারা মনে করছে ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত হওয়া হিন্দুরা নতুন সংশোধনীতে নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন।  

উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা খুশি হয়েছেন কারণ এনআরসি-তে বাদ যেতে চলা মুসলমানদের নাগরিকত্ব বাতিল করে টাইট দেওয়া যাবে। 

সংসদীয় বিরোধী, লিবারেল ও মুসলমান সংগঠনগুলো এই আইনের বিরোধিতা করছে কারণ এতে এনআরসি-তে বাদ হতে চলা হিন্দুরা পুনরায় নাগরিকত্ব পেয়ে যাবে কিন্তু মুসলমানরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত হবেন। তারা বলছে এই আইন বৈষম্যমূলক ও সাম্প্রদায়িক।   

অন্যদিকে ত্রিপুরা ও অসমের মানুষ এই আইনের বিরোধিতা করছে কারণ তারা মনে করছে এর ফলে আসামে এনআরসি তালিকা থেকে বাদ যাওয়া ১২ লক্ষ হিন্দু পুনরায় নাগরিকত্ব পেয়ে যাবে! 

নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে কলকাতায় সমাবেশ

কিন্তু সত্যি কি ক্যাব মুসলমানদের বাদ দেবে এবং হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেবে?  ২০১৯ সালে শীতকালীন অধিবেশনে কেন্দ্র সরকার নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল ২০১৯ পাস করেছে। এর আগে কেন্দ্রীয় সরকার নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, ২০১৬ উত্থাপন করেছিল ২০১৬ সালে। কিন্তু সেই বিল প্রথম মোদি সরকারের আমলে লোকসভায় পাস হয়ে গেলেও রাজ্যসভায় পাস হয়নি। এইবার দ্বিতীয় মোদি সরকার শীতকালীন অধিবেশনে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল ২০১৯ নিয়ে এসেছে। নতুন বিলে ভারতে ঢোকার দিন থেকে নাগরিকত্ব প্রার্থীদের উপর অবৈধ অনুপ্রবেশের পুরনো মামালা প্রত্যাহার, কিছু রাজ্যে এই বিল লাগু না হওয়া ইত্যাদি কিছু নতুন সংশোধনী যোগ করা হয়েছে।

সামান্য কিছু সংস্কার করা হলেও বিল দুটি আসলে একই। এই বিলে মূল নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-এর উপর মূলত  ৩টি সংশোধনী আনা হয়েছে।      

প্রথমটি হল – পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বৈধ কাগজপত্র ছাড়াও যদি ভারতে এসে থাকেন বা ভিসার মেয়াদ শেষের পরেও ভারতে রয়ে যান, তবে তাদের আর অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য করা হবে না। অর্থাৎ তাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকতে হবে না।  কোথাও কিন্তু নাগরিকত্ত্ব দেওয়ার কথা লেখা নেই।  

দ্বিতীয়টি হল – ওভার সি সিটিজেন (যারা ভারতীয় বংশোদ্ভুত বিদেশি নাগরিক কিন্তু ভারতের নাগরিকত্ব পেয়েছেন) তারা যদি  যেকোনো ভারতীয় আইন ভাঙে অর্থাৎ ট্রাফিক আইনও যদি ভাঙে, তবে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যাবে। এই সংশোধন স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় যে নাগরিকত্বের মর্যাদাকে কোন স্তরে নামিয়ে আনা হচ্ছে এবং গণতন্ত্র নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা কি! 

তৃতীয়টি হল – বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আসবেন, তারা ১১ বছরের জায়গায় ৬ বছর ( নতুন আইনে ৫ বছর) পর নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানাবার সুযোগ পাবেন। এখানেও কিন্তু নিশ্চিত ভাবে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়নি। 

নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের বিক্ষোভ


২০১৬ সালে বিলটি সংসদে উত্থাপিত হলে তা পর্যালোচনার জন্য যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে কাছে পাঠানো হয়। এই কমিটি সরকার পক্ষ এবং বিরোধী পক্ষ মিলিয়ে মোট ৩০ জন সাংসদ নিয়ে গঠিত ( রাজ্যসভা ১০ জন, লোকসভা ২০ জন)। ২০১৬ সালে গঠিত হওয়া এই কমিটির রিপোর্ট ২০১৯ সালে ৭ জানুয়ারি লোকসভা ও রাজ্যসভায়  পেশ করা হয়। এই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে এই কমিটি সরকারকে জিজ্ঞাসা করে যে, এই বিল পাস হলে আফগানিস্তান, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘুরা ভারতে আসলেই তাকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে কিনা? বা বিলে কেন ধর্মীয় নিপীড়নের কথা লেখা নেই? 

 সরকার পক্ষ জানিয়েছে, এই বিলটি ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালের গেজেট নোটিফিকেশনের সঙ্গে সংযুক্ত। ২০১৫ সালের এই গেজেট  নোটিফিকেশন অনুযায়ী  তিনটি বিষয় দেখাতে হবে প্রার্থীকে – 

  • তিনি ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে এসেছেন।   
  • তিনি ধর্মীয় হিংসার কারণে বা আশঙ্কায় দেশান্তরী হয়েছেন তার প্রমাণ  দিতে হবে। 
  • পাকিস্তান বা আফগানিস্তান বা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে তাকে। কারণ এই বিল এই তিন দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। 

বলাবাহুল্য শেষ দুটি প্রমাণ দাখিল করা প্রায় অসম্ভব। কমিটি জিজ্ঞাসা করে, কেউ ধর্মীয় হিংসার কারণে দেশান্তরিত হয়েছেন তা বোঝা যাবে কীভাবে? সরকার উত্তরে জানায়, যারা ভারতে এসে সরকারকে জানিয়েছিলেন যে ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছেন, তাদেরকেই ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে দেশান্তরী হিসেবে  ধরা হয়েছে। 

কমিটি সরকারকে জিজ্ঞাসা করে, নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল পাস হলে কতজন মানুষ এর ফলে উপকৃত হবেন? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রতিনিধি হিসেবে  আই বি প্রধান  উত্তরে জানিয়েছেন, সংখ্যাটা ৩১,৩১৩ জন মাত্র। এর মধ্যে হিন্দু-  ২৫,৮৪৭ জন, শিখ- ৫,৮০৭ জন,  ক্রিস্চান – ৫৫ জন, বৌদ্ধ- ২ জন,  পার্সি – ২ জন।  কারণ এরা ভারতে এসেই সরকারকে জানিয়েছিলেন যে তারা ধর্মীয় হিংসার কারণে দেশ ছেড়েছেন। পাতা ৩৯, ( ২.১৭)।

কমিটি জিজ্ঞাসা করে, যারা ধর্মীয় হিংসার শিকার হয়ে এ দেশে এসেছেন কিন্তু আসার সময় সরকারকে জানায়নি তাদের কী হবে? সরকার জানিয়েছে যে, তাদের প্রমাণ দিতে হবে যে তারা ধর্মীয় হিংসার কারণে এ দেশে এসেছেন। কিন্তু তারা যদি ভারতে আসার সময় সরকারকে না জানিয়ে থাকেন, তবে এখন এটা প্রমাণ করা খুবই কঠিন যে তারা ধর্মীয় হিংসার কারণে এসেছেন। পরবর্তীতে কেউ যদি ধর্মীয় হিংসার কারণে ভারতে আসার দাবি করে থাকেন তবে তার দাবি ‘র’ কে দিয়ে পরীক্ষা  করানো হবে। পাতা ৩৯(২.১৮)

এরপর কমিটি সরকারকে জিজ্ঞাসা করে, এই বিল কি মাত্র ৩১,৩১৩ জন মানুষের জন্য? এর উত্তরে আই বি প্রধান নির্দ্বিধায় উত্তর দিয়েছেন ‘হ্যাঁ’। তিনি আরও বলেছেন, বহু মানুষ আছেন যারা নাগরিক না হলেও বিভিন্ন ভাবে ভারতের পাসপোর্ট, রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড ধারণ করেন। ফরেনার্স ট্রাইবুনালে খতিয়ে দেখা হবে যে, তারা প্রতারণা করে এই কার্ড পেয়েছেন কিনা! 

যৌথ সংসদীয় কমিটির রিপোর্টের অংশ(৩৯ পৃষ্ঠা)

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেছেন যে, বাংলায় দু কোটি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী আছে! অসমে ইতিমধ্যে ১৯ লক্ষ মানুষ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। আমরা যদি আন্দাজ করি সারা ভারতে কমপক্ষে ৪ কোটি মানুষ নাগরিকত্ব হারাবেন  এবং এরা সবাই নিজেকে ধর্মীয় কারণে দেশান্তরী বলে আবেদন জানাবেন। একজন আবেদনকারীর আবেদন তদন্ত করতে ভারতের গুপ্তচর সংস্থা ‘র’এর গড়ে যদি একদিন সময় লাগে তবে তবে  সবার আবেদন তদন্ত করতে ৪ কোটি দিন বা ১১৩ বছর সময় লাগবে। এটা বিপদগ্রস্ত মানুষের সাথে পৈশাচিক মসকরা ছাড়া আর কী? সুতরাং যদি বলা হয় এই বিল ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান করছে,  তবে তার মানে দাঁড়ায় যে মুসলমানদের নাগরিকত্ব হবে না কিন্তু হিন্দু বা অ-মুসলমানদের হয়ে যাবে। আদতে কিন্তু এই বিল কাউকেই নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। 

সংসদের দুই কক্ষে নাগরিকত্ব বিল নিয়ে যে বিতর্ক হলো তা দেখে মনে হতে পারে ব্রাহ্মি সাক বা ব্রেনোলিয়া এক মাত্র ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারে! ঝানু উকিল কপিল সিব্বল সহ সমস্ত সাংসদ সরকারের দিকে এমন সব প্রশ্নবাণ ছুঁড়লেন যার উত্তর জেপিসি-তে সরকার আগে দিয়েছে। কিন্তু বেমালুম ভুলে মেরে দিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  ৩১,৩১৩ জনের প্রশ্নটি ! একে বিরোধীদের গণস্মৃতিভ্রম ছাড়া আর কী বলা যায়? নাকি বিরোধীদের ধারণা এই কয়জনই অমুসলমান দেশ ভাগের শিকার হয়ে ভারতে এসেছেন! স্মৃতিভ্রমের আরেক শিকার শান্তনু ঠাকুর ও তার অনুগত মতুয়ারা। এরা ভুলে গেছে ২০০৩ সালে বিজেপি সরকারই আইন পাস করিয়ে তাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী তকমা সেঁটে ক্রিমিনাল বানিয়েছিলো! ভুলে গেছে বলেই বিজেপি নেতাদের মুখের কথায় তাঁরা গলে যাচ্ছেন।

নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে অসমে বিক্ষোভ

যদি এমন হত যে আগামীদিনে যে সমস্ত ধর্মীয় কারণে নিপীড়িতরা ভারতে আসবেন তাদের জন্য এই বিল, তবে প্রশ্ন তোলা সংগতিপূর্ণ হত যে প্রতিবেশী দেশের শিয়া,আহমুদিয়া, নাস্তিক বা ফকিরদের কেন আশ্রয় দেওয়া হবে না! যদি এই বিল সমস্ত ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত হিন্দুদের নাগরিকত্ব দিত তবে ধর্মীয় বৈষম্যের প্রশ্ন তোলা যেত। এই আইন ইতিমধ্যে যারা আবেদন জানিয়েছেন শুধু মাত্র সেই কয়জনের জন্য। এই নতুন আইন যা নয় বিরোধীরা তার বিরোধিতা করছে! আর বিজেপি যা করেনি তার জন্য অসমিয়াদের কাছে ধোলাই খাচ্ছে!                   

এনআরসি-র মতো রাষ্ট্রীয় অপরাধের পক্ষে দেশে হিন্দুদের সমাবেশিত করতে, বিশেষত বাংলার হিন্দুকে বোকা বানাতে বিজেপি এই মিথ্যা প্রচার করেছে যে নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নাকি খুব সহজেই সব হিন্দুকে নাগরিকত্ব দেবে।  আর এই মিথ্যাই বিশ্বাস করেছে অসমের মানুষ। ফলে অসমে বিজেপির ঘটি বাটি চাঁটি হওয়ার জোগাড় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী  অমিত শাহ সহ বিজেপি নেতারা বার বার অসমের মানুষকে বোঝাবার চেষ্টা করছে নাগরিকত্ব(সংশোধনী)আইন নিয়ে তাদের এই বিক্ষোভ অমূলক। কিন্তু  স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারছে না ! এই সত্য যদি জনসমক্ষে স্পষ্ট ভাবে  ঘোষণা করা হয় তাহলে অসমে হয়তো বিজেপি রক্ষা পাবে কিন্তু দেশের অন্য অঞ্চলে বা বাংলায় যে এক ঘা’ও ফসকাবেনা সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।    

                     

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *