অগ্নিদগ্ধ ৪৩ জন শ্রমিক: শ্রমিকদের নিরাপত্তার দায়পালনে ব্যর্থ রাষ্ট্র
দিল্লিতে ৪৩ জন শ্রমিকের গণমৃত্যু। আহত আরও বেশি। ৮ ডিসেম্বর ভোর না হতেই দমবন্ধ মৃত্যুর এই খবর সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। মাঝরাতে রাজধানীর চামড়া কারখানার ভেতরে হঠাৎ আগুন, ঘুমন্ত অবস্থায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ও দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু শ্রমিকদের। দিল্লি প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় সরকারের রুটিন তদন্তনির্দেশ, ক্ষতিপূরণ ঘোষণা, সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষমাপ্রকাশ- সবকিছুই নিয়মমাফিক। আর, নিয়মমাফিক বোধহয় এই মৃত্যুমিছিলও। কারণ শ্রমিকসুরক্ষার প্রশ্নে গাফিলতি, শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, ন্যূনতম শ্রম-আইনের তোয়াক্কা না করা এবং মুনাফার লোভে মালিকের যথেচ্ছাচার- এই সমস্তই ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠেছে ভারতীয় সংস্কৃতিতে।
আরও পড়ুন: সাম্প্রদায়িক ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৯’-এর বিরুদ্ধে লড়েই ঠেকাতে হবে এনআরসি
কারখানায় আগুন লাগার পরে যখন দমকলকর্মীরা উদ্ধারকার্যে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হন, তখন প্রশাসনের টনক নড়ে যে, কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ বিধি যথাযথ মানা হয়নি। আনাজ মান্ডির মতো ঘিঞ্জি এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের পরে তদন্তকমিটি বসে ওর’ম বসতিপূর্ণ এলাকায় কারখানা বানানো হল কী করে। অথচ, দিনের পর দিন সেই কারখানা চলেছে, প্রশাসনিক নীতি ও বিভিন্ন আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে (হয়তো যথাস্থানে প্রদত্ত উৎকোচের বিনিময়ে) মালিক অনুমতি পেয়ে গেছিল কারখানা বানানোর।
মালিকেরা এই অনুমতি পেয়ে যায়। ন্যূনতম পরিকাঠামোর মধ্যে সর্বাগ্রে পড়ে শ্রমিকদের সুরক্ষা। তাঁদের স্বাস্থ্যকর বাসস্থানের দায়িত্ব নেওয়া কারখানা-মালিকের দায়িত্ব। অথচ, ব্যয়সঙ্কোচের কোপ সবার আগে পড়ে এখানেই। শ্রমিকের শ্রম, যা উৎপাদনের মূল চাবিকাঠি, তাকেই সবথেকে কম প্রাপ্য ও সুযোগসুবিধে দেওয়া হয়। আর, এই অনৈতিকতা শুধু দিল্লি নয়, সারা ভারতজুড়েই অনুশীলিত হয়। তারওপরে, শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নিতে পূর্বতন ইউপিএ সরকারের থেকে দ্বিগুন সচেষ্ট মোদি-সরকার। ভারতীয় আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় ক্রমশঃ বেড়ে চলা বৈষম্যে মুষ্টিমেয় যে পুঁজিপতি ও মুৎসুদ্দিরা ক্ষমতাশীর্ষে রয়েছে, তাদেরই স্বার্থরক্ষায় তৎপর রাষ্ট্র। তাদেরই মতাদর্শবাহী আইন-প্রশাসন তাই মালিকের শ্রমআইন বিরোধিতা দেখেও উদাসীন থাকে কিংবা সেই মালিকের থেকে পথে-ঘুরপথে উৎকোচ নিয়ে অনুমতি দিয়ে দেয় কারখানা স্থাপনের। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, অনিয়মিত বেতন, অন্যায্য ছাঁটাই এবং নামমাত্র বেতনে (মৃত ও আহত শ্রমিকদের পরিজনদের দাবি, মাসিক ১০০০ টাকা বেতন ছিল শ্রমিকদের) বাধ্যতঃ শ্রমিকেরা কাজ করে চলেন কারখানাগুলোতে।
আনাজ মান্ডির যে চামড়া কারখানায় আগুন লেগেছিল, চারতলা সেই বিল্ডিঙের প্রতিটি তলাতেই ছিল প্রচুর দাহ্য বস্তু। ভিন রাজ্যের বা ভিন শহরের অভিবাসী শ্রমিকেরা অনেকেই কারখানার ভেতরেই কোনও ঘরে থেকে যান, যাতে আলাদা ঘর ভাড়া নেওয়ার খরচটুকু বাঁচে। নামমাত্র বেতনের ওপর যৎসামান্য ওভারটাইম পাওয়ার আশায় রাত অবধি কাজ ক’রে কারখানারই কোনও ঘরে শুয়ে পড়েন অনেকে। আর, সেটাই কাল হয়েছিল আনাজ মান্ডির চামড়া-কারখানার শতাধিক শ্রমিকের। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, ভোররাতে শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগার পরে যখন আগুন ও ধোঁয়া ভয়ানক রূপ নেয়, তখন আর পালাবার পথ ছিল না ঘুমভাঙ্গা আতঙ্কিত শ্রমিকদের। কারণ, কারখানার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার মতোই কখনও খতিয়ে দেখা হয়নি নির্গমন ব্যবস্থা। চামড়ার কারখানায়, যেখানে প্রচুর দাহ্য বস্তু মজুত রয়েছে, সেখানে প্রবেশ-বাহিরের দরজা মাত্র একটাই। ঘিঞ্জি গলিপথে বহু চেষ্টার পরে দমকল যখন আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে, দেরি হয়ে গেছে অনেকটাই। ঝলসে গেছেন বহু শ্রমিক। আহত প্রায় ৬০ জন। আহতদের উদ্ধারের পর তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী হাসপাতালে। কিন্তু, পরিজনদের অভিযোগ, আহত আত্মীয়দের খোঁজ সঠিকভাবে পাওয়া যাচ্ছিল না পুলিশের কাছে।
উল্লেখ্য, ঠিক এই মুহূর্তেই ভারতের শ্রম আইন সংস্কার চলছে। সিটিজেনশিপ অ্যামেডমেন্ট অ্যাক্টের পাশাপাশি এই বিল পাশ করাতেও উদ্যোগী মোদি সরকার। শ্রমিকদের ইউনিয়নের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে চলেছে রাষ্ট্র; বিশ্বায়িত উদারনৈতিক অর্থনীতিতে শ্রমিকসঙ্কোচ গোটা বিশ্বেরই জ্বলন্ত সমস্যা, সেই সমস্যাকেই ন্যায্যতা দিতে উঠেপড়ে লেগেছে বিজেপি-সরকার। কর্পোরেট পুঁজি ও মালিকদের স্বার্থরক্ষায় শ্রমিকদের হরতালের অধিকারকে নিষিদ্ধ করতে চলেছে, ফলে, মালিকপক্ষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কার্যত নীরব হয়ে থাকতে হবে শ্রমিকদের। শ্রমিকসুরক্ষার যে ন্যূনতম নিয়মকানুন অধিকাংশ মালিকপক্ষ মানতে না-চাইলেও ১৯৪৮ থেকে বলবৎ আছে, সেখানেও বদল আনতে চলেছে রাষ্ট্র। ‘শিল্পস্থাপনে জটিলতামুক্তি’-র নাম ক’রে আসলে পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষায় শ্রমিকনিধনের কল তৈরি করা হচ্ছে। নিরাপত্তা, শ্রমিকদের অধিকার ও স্বাচ্ছন্দ্য খতিয়ে না দেখেই কারখানা তৈরির ও চালানোর অনুমতি দিয়ে দেওয়ার পেছনে শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী ষড়যন্ত্রই কাজ করে। ‘হিউম্যান রিসোর্স’, ’শ্রমিক কল্যাণ’ ইত্যাদি গালভারি নাম দেওয়া বিভিন্ন দফতর থাকলেও, এবং শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হলে তবেই দেশের প্রগতি জিডিপি বাড়বে- তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদ্দের এমত মত থাকলেও, বাস্তবে তার প্রায় কোনও অনুশীলনই যে হয়না, তার প্রমাণ দিল্লির এই শ্রমিকমৃত্যুমিছিল।
দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা যখন তীব্র, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি-বেকারত্ব বৃদ্ধি-কর্মী সঙ্কোচন- এই মিলিত শাসক-আক্রমণে তৈরি হওয়া সংকটময় পরিস্থিতিতে শ্রমিকসুরক্ষা রক্ষার ব্যাপারে সমস্ত শাসিত মানুষকে একজোট হয়ে ভাবতেই হবে। নয়তো এই মৃত্যুমিছিল অব্যাহত থাকবে, ক্রমশঃ শ্রমিকেরা ‘দাসে’ পরিণত হবেন এবং নিকটাগত ফ্যাসিবাদ আরও জাঁকিয়ে বসবে। সংসদে শ্রম আইন সংস্কার করতে এত উদ্যোগী রাষ্ট্র, অথচ, শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে অক্ষম। শ্রম আইনের ‘শ্রমিকবিরোধী’ সংস্কারের ঢক্কানিনাদের আড়ালে চাপা পড়ে থাকছে নিপীড়িত শ্রমিকদের অগ্নিদগ্ধ দেহ।