বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৯ (ক্যাব) লোকসভায় পেশ হল। কী আছে এই বিলে? আগের বিলের সঙ্গে সত্যিই কি মৌলিক কোন পার্থক্য আছে এই বিলের? গণতন্ত্রপ্রেমী, সচেতন মানুষ কেন এই বিলের বিরুদ্ধে এত সরব?
বিলে মূলত দুটো বিষয় আছে। প্রথমতঃ ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে সংখ্যালঘু অমুসলিমরা অর্থাৎ হিন্দু, বৌদ্ধ, ক্রিস্টান, পার্শি ,জৈন ধর্মাবলম্বীরা , ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এসে বেআইনি ভাবে ভারতে বসবাস করলে তাদের আর ‘বে-আইনি অনুপ্রবেশকারি’ বলা হবে না।
আরও পড়ুন: উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে ভারতের শ্রম ‘সংস্কার’
দ্বিতীয়তঃ তাঁরা অর্থাৎ ঐ অমুসলিমরা ভারতের নাগরিকত্ব নিতে চাইলে বর্তমান ১১ বছরের বদলে ৫ বছর পরেই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
বিলে কিন্তু একবারও বলা হয়নি যে তাঁদের উদ্বাস্তু বা শরণার্থী হিসাবে থাকতে দেওয়া হবে। বলা হয়েছে, বে-আইনি অনুপ্রবেশকারি বলা হবে না। আসলে উদ্বাস্তু বা শরণার্থী বললেও সরকারের কিছু দায়দায়িত্ব থাকে। তাই এড়িয়ে যাওয়া।
২০১৮ সালে মোদি সরকার যে নাগরিকত্ব বিল লোকসভায় পাশ করিয়েও আর রাজ্য সভায় পেশ করেনি তাতেও এই দুটোই ছিল মূল বিষয়। নতুন হল উপস্থাপনার ঢং। আগের বিলে ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে পালিয়ে আসার শর্তটা সরাসরি বলা ছিল। এখানে সেটা নিয়ে কিছুটা লুকোচুরি করার, আড়াল করার চেষ্টা আছে। বলা হয়েছে ২০১৫ সালে পাসপোর্ট আইনে যাদের আর বে-আইনি অনুপ্রবেশকারি বলা হবে না বলা হয়েছে এই আইনেও তাদেরি আর অনুপ্রবেশকারি বলা হবে না। পাসপোর্ট আইনের ২০১৫র সংশোধনী বিজ্ঞপ্তিতেও বলা হয়েছে, ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে আসা অমুসলিমদের কথা।
২০১৮ র পেশ করা বিলে নাগরিকত্বের জন্য আবেদনের যোগ্যতা ছিল ন্যূনতম ৬ বছর বসবাস। নূতন বিলে এটা ৫ বছর করা হয়েছে। এছাড়া উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু অঞ্চলে আইনটি কার্যকর হবে না বলা হয়েছে। কাজেই পশ্চিমবাংলার মানুষের জন্য বিলটাতে কোনো মৌলিক পরিবর্তন নেই। অপেক্ষাধীন থাকার সময়সীমা শুধু এক বছর কমবে।
ভারতের সংবিধানের ৬ নং ধারায় বলা আছে ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাই পর্যন্ত যারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে এসেছেন তাঁরা ভারতের নাগরিক। এরপরে যারা আসবেন তাদের আইন মেনে আবেদন করে নাগরিকত্ব নিতে হবে। এই আবেদন করার বিষয়টি কিন্তু খুব কম মানুষই জানতেন।ফলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে আইন মেনে বা লুকিয়ে এপারে চলে এলেও আবেদন করে নাগরিকত্ব নেননি। কেউ বলেওনি নিতে। পরে বাংলাদেশ হওয়ার পরেও যারা এসেছেন তারাও তাই। স্বাভাবিক নিয়মেই এসব মানুষ এদেশে থেকেছেন, কাজ করেছেন, লেখাপড়া করেছেন, সংসার করছেন, বাড়িঘর বানিয়েছেন। তাঁদের রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড সবই হয়েছে। বছরের পর বছর ভোট দিয়েছেন, ভোটে দাঁডিয়ে এম পি, এম এল এ, কাউন্সিলর হয়েছেন। কেউই নিজেদের অনাগরিক ভাবেনি। ভাবার কোন কারণও হয়নি। আইন অনুযায়ী নাগরিকরাই কেবল ভোট দিতে বা প্রার্থী হতে পারেন বা প্রচার করতে পারেন। নাগরিকদের ভোটেই কেবল সরকার গঠিত হতে পারে। ফলে ঘটি-বাঙালের মধুর খুনসুটি, ইস্টবেঙ্গল – মোহনবাগান নিয়ে সুখেদুঃখে এক সাথেই ছিলেন সবাই। দ্বন্দ্ব বৈরিতায় পৌঁছায়নি কখনও। ২০০৩ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকার নাগরিকত্ব আইনে মারাত্মক একটি সংশোধন করে। এরাজ্যের সব রাজনৈতিক দলই তাকে সমর্থন জানায়। বলা হয়, যারাই অন্যদেশ থেকে ভারতে এসে নাগরিকত্ব আইন মেনে আবেদন করে রেজিষ্ট্রেশন করিয়ে নাগরিকত্ব নেননি তাঁরা সবাই ‘বে-আইনি অনুপ্রবেশকারি’। আরও বলা হয় ভারত সরকার দেশে নাগরিকদের রেজিস্টার, ন্যাশানাল রেজিস্টার অব ইন্ডিয়ান সিটিজেন ( এন আর আই সি) তৈরি করবে। অসতর্ক নাগরিকদের নিয়ে আস্তে আস্তে শুরু হয়ে যায় ভয়ংকর এক অন্য রাজনীতি – যা এদেশের রাজনীতিকে আমূল নাড়া দিতে চলেছে। এরই অংশ হিসাবে এসেছে এই ক্যাব।
ক্যাবে কেন আপত্তি? প্রস্তাবিত এই আইনে বলা হয়েছে শুধু অমুসলিমদেরই বে-আইনি অনুপ্রবেশকারি বলা হবে না। অর্থাৎ শুধু মুসলমানরাই অন্য দেশ থেকে এসে এদেশে বসবাস করলে তাঁরা বে-আইনি অনুপ্রবেশকারি। তাদের আইন অনুযায়ী বিচার ও সাজা হবে। পাসপোর্ট আইনেও ২০১৫ সালে এটারই ব্যবস্থা করা হয়েছে। অথচ ভারতের সংবিধান বলছে ভারত একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ভারতের সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ ধারা দেখুন। বলা আছে এদেশে সব ধর্মের মানুষের সমানাধিকার। ধর্ম, জাতি, লিঙ্গের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য করা যাবেনা। আইনের চোখেও সবাই সমান। তাহলে শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে কেউ বে-আইনি অনুপ্রবেশকারি হবেন আর কেউ বিশেষ সুবিধা পেয়ে নাগরিক হয়ে যাবেন – এটা কিভাবে সম্ভব?
তাই এই বিল যদি আইনে পরিণত হয় তাহলে তা হবে সরাসরি সংবিধান বিরোধী কাজ। তাছাড়া, কেশবানন্দ ভারতী মামলা ও তারপরে বহুবার ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে – সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার বা মূল কাঠামো বদল করা যাবেনা। এমনকি ভারতের সংসদও সংবিধানে এমন কোনো সংশোধন, সংযোজন বা বিয়োজন করতে পারবে না যাতে সংবিধানের মূল কাঠামো আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ধর্ম নিরপেক্ষতা ভারতের সংবিধানের মূল কাঠামোর অন্তর্গত নীতি। কাজেই এই বিল আইন হলে সংবিধানে আমূল পরিবর্তন আসবে। তাই এই বিলের আইনে পরিবর্তন কখনই গ্রহণীয় নয়। সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ ধারা, যা আবার সংবিধানের অন্যতম ভিত্তি, অর্থহীন হয়ে যাবে। এরপর শুধু ধর্ম নয়, জাতি, লিঙ্গের ভিত্তিতে পার্থক্য করে আইন প্রণয়নের রাস্তা খুলে যাবে। সবরিমালায় সুপ্রিম কোর্টের রায় মানতে অস্বীকারের মধ্যে সে বিপদও ইতিমধ্যেই টের পাওয়া যাচ্ছে।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আইন হলে এদেশের প্রায় বিশ কোটি মুসলমান এক ধাক্কায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হবেন। এতদিন যা ছিল অঘোষিত, সেই বঞ্চনা, বৈষম্য হবে বুক ফুলিয়ে। মুসলমানদের এক অসন্মানের দুর্বিষহ জীবনে ঠেলে দিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে সংঘ পরিবারকে অনেকটাই এগিয়ে দেবে এই ক্যাব। হিন্দু মুসলমানের পাশাপাশি শান্তিতে বাসের সাংস্কৃতিক-সামাজিক কাঠামো শেষ হয়ে যাবে চিরতরে।
অন্যদিকে হিন্দুরা সত্যিই কি ভীষণভাবে উপকৃত হবেন? সে গুড়েও বালি। জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটিতে ভারত সরকারের প্রতিনিধিরাই বলেছেন মাত্র ৩১৩১৩ জন নতুন করে নাগরিকত্ব পাবেন। কারণ একমাত্র এরাই ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে এদেশে আসার কথা ঘোষণা করে আবেদন করে অপেক্ষায় আছেন। তাছাড়া প্রত্যেক আবেদনকারিকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা ধর্মীয় নিপীড়নের কারণেই বাধ্য হয়ে এদেশে এসেছেন। যা এক প্রকার অসম্ভব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল এই যে কয়েক কোটি মানুষ ওপার বাংলা থেকে এপারে এসে ঘর বেঁধেছেন, এদেশকে নিজের দেশ বলে আপন করে নিয়েছেন, তাঁরা কেন আবার বে-নাগরিক ঘোষণা করবেন নিজেদের। আবেদন করা মানেই তো অন্তত পাঁচ বছর বে-নাগরিক হয়ে থাকা। বে-নাগরিকের সন্তান এদেশের মাটিতে জন্মালেও নাগরিকত্ব পাবেনা। ভয়ংকর এই ভবিষ্যৎ কেন মেনে নেবে মানুষ! কাজেই ক্যাবের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সুযোগই নেই। হিন্দু মুসলমানকে এক সঙ্গেই লড়তে হবে সে লড়াই।